ওপেন ডেটা থেকে বাণিজ্যিক ঝুঁকি মডেল
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বোঝা ও মাপার কাজটা ক্রমেই নতুন রূপ পাচ্ছে, আর এর বড় অংশই ঘটছে আলোচিত জলবায়ু সম্মেলনের মঞ্চের বাইরে। যুক্তরাষ্ট্রে বহু বছর ধরে চলা জলবায়ু গবেষণা কর্মসূচির বাজেট কাটছাঁট ও রাজনৈতিক চাপের ফলে সরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রম সীমিত হয়েছে। সেই শূন্যতা পূরণ করতে এখন দ্রুত বেড়ে উঠছে নানান বেসরকারি “আরথ ইন্টেলিজেন্স” বা পৃথিবী পর্যবেক্ষণ কোম্পানি। বড় বড় রিয়েল এস্টেট গ্রুপ, বীমা প্রতিষ্ঠান ও জ্বালানি কোম্পানিগুলো প্লাবন, বনআগুন কিংবা চরম তাপপ্রবাহের ঝুঁকি দীর্ঘমেয়াদে নির্ণয় করতে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিস্তারিত মডেল কিনছে। কয়েক দশক আগে যেখানে জলবায়ু তথ্যকে কেবল বিজ্ঞানীদের বিষয় হিসেবে দেখা হতো, এখন সেখানে এটি সরাসরি বিনিয়োগ ও ঋণ সিদ্ধান্তের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে।
এই বেসরকারি প্ল্যাটফর্মগুলোর অনেকটাই ভিত্তি করে তৈরি সরকারি ওপেন ডেটার ওপর। নাসা, নোয়া ও অন্যান্য মার্কিন সংস্থার স্যাটেলাইট তথ্য, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা, ঐতিহাসিক বৃষ্টিপাতের রেকর্ড ইত্যাদি দীর্ঘ দিন ধরে যে ডেটাবেস তৈরি করেছে, তা এখন বাণিজ্যিক জলবায়ু ঝুঁকি মডেলের মেরুদণ্ড। নতুন কোম্পানিগুলো এসব উন্মুক্ত তথ্যের সঙ্গে নিজস্ব অ্যালগরিদম, বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক ও মাটির সেন্সর যুক্ত করে গ্রাহকদের জন্য চমকদার ড্যাশবোর্ড ও সাবস্ক্রিপশন সেবা বানাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই খাতে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে; গ্রীনহাউস গ্যাস নির্ণয়কারী স্যাটেলাইট, সমুদ্র উপকূলের মানচিত্র তৈরির কোম্পানি ও অবকাঠামো ঝুঁকি বিশ্লেষণকারী স্টার্টআপগুলো বিনিয়োগকারীদের বিশেষ আগ্রহ পাচ্ছে।
অসমতা, প্রবেশাধিকার ও ন্যায্যতার প্রশ্ন
সমর্থকরা বলছেন, হোয়াইট হাউজের জলবায়ু গবেষণা বাজেট কমানো ও নিয়ন্ত্রণ নীতি শিথিল করার প্রেক্ষাপটে এই প্রবণতা বাজারের বাস্তব চাহিদা থেকেই জন্ম নিয়েছে। ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক থেকে শুরু করে সড়ক ও বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত এখন সম্পদভিত্তিক ঝুঁকি স্কোর চাইছে, যাতে ভবিষ্যৎ বন্যা বা ঝড়ের আঘাত আগেভাগে হিসাব করা যায়। তাদের ভাষ্য, সরকারি সংস্থার সীমিত বিশ্লেষণের তুলনায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আরও সূক্ষ্ম ও প্রয়োগযোগ্য মডেল তৈরি করতে পারছে; প্রতিযোগিতার কারণে অকার্যকর সমাধান বাজার থেকে নিজে থেকেই ছিটকে যাবে।
কিন্তু সমালোচকেরা ভিন্ন চিত্র তুলে ধরছেন। জলবায়ু সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যখন ক্রমে পে-ওয়ালের আড়ালে চলে যায়, তখন দরিদ্র দেশ, ছোট পৌরসভা বা দুর্বল অর্থনীতির গবেষকরা পুরোনো ও সাধারণ ডেটার ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন, আর বড় কর্পোরেশনগুলো কিনে নেয় সবচেয়ে উন্নত পূর্বাভাস। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, যদি মার্কিন জলবায়ু সংস্থাগুলোর মূল বাজেট ও ম্যান্ডেট কমে যায়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণ ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে, যা ছাড়া কোনও মডেলই প্রকৃত অর্থে নির্ভরযোগ্য থাকে না। একই সঙ্গে, যে সব কোম্পানি ঝুঁকি স্কোর বিক্রি করে তারাই আবার বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত ও নীতি পরামর্শে প্রভাব রাখলে স্বার্থসংঘাতের ঝুঁকি তৈরি হয়; এতে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের মানুষ নয়, বরং কেবল সম্পদধারীর নিরাপত্তাই অগ্রাধিকার পেতে পারে।
ফলে এক জটিল সহাবস্থার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে এ খাত। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মহাকাশ সংস্থাগুলো নতুন স্যাটেলাইট পাঠিয়ে বৈশ্বিক তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ করছে, অন্যদিকে বেসরকারি কোম্পানিগুলো উচ্চ রেজোলিউশনের ছবি ও প্রস্তুত বিশ্লেষণী পণ্য বানিয়ে বাজার বাড়াচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এখনো জলবায়ু ঝুঁকি প্রকাশের মানদণ্ড, মডেলের স্বচ্ছতা এবং ডেটা ব্যবহারের ন্যায্যতা নিয়ে স্পষ্ট নিয়ম বানানোর প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য প্রশ্নটা আরও স্পর্শকাতর; সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় বা দীর্ঘস্থায়ী খরার ঝুঁকিতে যারা সবচেয়ে বেশি ভুগছে, তাদের অনেকেরই নিজস্ব ডেটা অবকাঠামো গড়ে তোলার সামর্থ্য নেই। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, সময় মতো নীতি না বদলালে আগামী দশকে জলবায়ু তথ্যের বাজার এমনভাবে গড়ে উঠতে পারে যেখানে বৈজ্ঞানিক সত্যের চেয়ে ব্যবসায়িক গোপনীয়তাই বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠবে—আর তাতে জলবায়ু ন্যায়বিচারের স্বপ্ন আরও দূরে সরে যেতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















