জাতীয় নির্বাচনের আর অল্প সময় বাকি থাকলেও বিএনপি এখনো জোটসঙ্গীদের জন্য আসন বণ্টন চূড়ান্ত করতে পারেনি। প্রায় তিন সপ্তাহ আগে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা প্রকাশের পর যে আশাবাদ ছিল, তা এখন জোটে উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা ও হতাশায় রূপ নিয়েছে। মাঠপর্যায়ে নিজেদের প্রতীকেই লড়তে হবে—এমন নতুন বিধান জটিলতা আরও বাড়িয়েছে, আর অনেকে ইতোমধ্যেই বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার কারণে প্রচারণায় পিছিয়ে পড়ার অভিযোগ করছেন।
জোটে অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তা
বিএনপি ২৩৬টি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা প্রকাশের পর জোটের ভেতরে যে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল, সময়ের সাথে তা কমে গিয়ে এখন উদ্বেগে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যাশিত আসন বণ্টন নিয়ে কোনো অগ্রগতি না থাকায় মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো বিভ্রান্ত ও উদ্বিগ্ন। এ কারণে তারা নিজ নিজ এলাকায় আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করতে পারছেন না।
জোটের নেতাদের আশঙ্কা, যেসব আসনে তাদের প্রার্থী হওয়ার কথা, সেখানে স্থানীয় বিএনপি নেতারা স্বাধীন প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন, ফলে জোটের সমন্বয় ভেঙে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। তাদের মতে, বিএনপির উচিত দ্রুত আসন বণ্টনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা এবং তৃণমূলকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, যাতে কেউ সিদ্ধান্ত অমান্য না করে। জোটের প্রায় সব নেতাই সময়ক্ষেপণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন,
“নির্বাচন প্রস্তুতির জন্য প্রতিটি দিন গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপির প্রার্থীরা প্রচারণায় নেমে পড়েছে, কিন্তু আমরা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারি না।”

আসন বণ্টনে জটিলতা ও দ্বন্দ্ব
বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ স্বীকার করেছেন—জোটের প্রত্যাশা ও বিএনপির প্রস্তুতির মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হয়েছে। সংশোধিত রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার (আরপিও) অনুযায়ী মিত্রদলগুলোকে নিজেদের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে—এটি জটিলতা আরও বাড়িয়েছে।
বিএনপি নেতাদের মতে, তারা সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০টি আসন ভাগ করতে প্রস্তুত, কিন্তু জোটের দাবির পরিমাণ বাস্তবতার সাথে মিলছে না।
এক স্থায়ী কমিটির সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“অতিরিক্ত আসন দিলে আমরা ঝুঁকিতে পড়ব। আমাদের প্রতীক ধানের শীষ মিত্ররা ব্যবহার করতে পারবে না। তাদের অনেকেরই মাঠপর্যায়ে শক্তি কম। নিজস্ব প্রতীকে লড়লে জয়ের সম্ভাবনা কমে যাবে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।”
তিনি আরও জানান, এনসিপি নেতাদের বিএনপি ও শীর্ষ নেতৃত্বকে নিয়ে অসৌজন্যমূলক মন্তব্যের কারণে দলটি হয়তো তাদের সাথে আসন ভাগাভাগির পরিকল্পনা বাদ দিতে পারে।
মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ও নতুন জটিলতা
জোটের এক নেতা জানান, তারা এখন এক ধরনের “অচলাবস্থায়” আছেন। বিএনপি অধিকাংশ আসনে ইতোমধ্যে প্রার্থী ঘোষণা করায় সম্ভাব্য প্রার্থীরা র্যালি, উঠোন বৈঠকসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। এতে জোটের সম্ভাব্য প্রার্থীদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ছে।
এক ছোট দলের নেতা বলেন,
“যে আসনে বিএনপি ভোট চাইতে নেমে গেছে, সেখানে আমরা কীভাবে প্রচারণা শুরু করব? এতে ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি বাড়বে।”

আরেক নেতা বলেন,
“আগাম প্রচারণার কারণে ভোটাররা ইতোমধ্যেই ওই আসনগুলোকে ধানের শীষের সাথে সম্পর্কিত করে ফেলেছে। কিন্তু যদি পরে বিএনপি সেই আসন আমাদের দেয়, তাহলে আমাদের নিজস্ব প্রতীকে লড়তে হবে—যা এই অল্প সময়ে ভোটারদের কাছে পরিচিত করা প্রায় অসম্ভব।”
জোটের নেতাদের অবস্থান
গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন,
“বিএনপি এখনো আসন বণ্টন নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসেনি। কোন আসনে কাকে বিবেচনা করছে—এসব বিষয়ে কোনো তথ্য আমরা পাইনি।”
তার মতে, বিএনপি নিজেদের অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি সেরে নিতে সময় নিচ্ছে, কিন্তু এই বিলম্ব জোটের উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলছে।
১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম জানান—বিএনপি কিছু নেতাকে সম্ভাব্য মনোনয়নের ইঙ্গিত দিলেও চূড়ান্তভাবে কিছু জানায়নি। তিনি বলেন,
“যে আসনগুলো দিতে চায়, সেগুলো যত দ্রুত আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবে, তত ভালো সমন্বয় হবে।”
লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ড. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান জানান—আসন বণ্টন নিয়ে বিএনপি এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেনি, যা তাদের প্রস্তুতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। তিনি নিজ নির্বাচনী এলাকায় কাজের ইঙ্গিত পেলেও স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সমর্থন পাচ্ছেন না, কারণ তার মনোনয়ন এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা
ইরান জানান—লেবার পার্টিসহ ছোট দলগুলো নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে, যাতে তারা জোটের প্রতীক কিংবা নিজেদের প্রতীকে লড়তে পারে।

তিনি বলেন,
“মনে হচ্ছে বিএনপি ইসির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে। যদি আবেদন মঞ্জুর হয়, তাহলে বিএনপি আসন বণ্টনে আরও নমনীয় হতে পারে।”
বিএনপির প্রতিক্রিয়া ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকনির্দেশনা
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান—মিত্রদলগুলো যে তালিকা দিয়েছে, বিএনপি তা গুরুত্বসহকারে পর্যালোচনা করছে।
তিনি বলেন,
“মাঠের বাস্তবতা, জনসমর্থন ও প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা—এসব বিবেচনায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।”
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন—২০১৮ সালের মতো এবার জোটের জন্য এত আসন রাখা সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০টি আসন দেওয়া হতে পারে, বিশেষ করে জামায়াত আলাদা লড়াই করায়।
আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু জানান,
“আসন বণ্টন এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সবাইকে তাদের চাওয়া মতো আসন দেওয়া সম্ভব হবে না, তবে কিছু আসন দেওয়া হবে।”
তিনি আরও বলেন—বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিষয়টি পর্যালোচনা করছেন এবং স্থায়ী কমিটির আলোচনার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















