মারিউপোলের ধ্বংস আর পুনর্গঠনের চেষ্টা
জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের মারিউপোলে রুশ বাহিনীর অবরোধ চলাকালে শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ আবাসিক ভবন ও ৬০ শতাংশ ব্যক্তিগত বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রায় ৪৫০,০০০ লোকের শহরের অর্ধেকের বেশি মানুষ যুদ্ধের সময় পালিয়ে যায়।
২০২২ সালের মে মাসে দখলের পর তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও, রাশিয়া এখনো বিপুল অর্থ ঢেলে নতুন অ্যাপার্টমেন্ট ভবন, রাস্তা, পার্ক, সৈকত–সহ পুরো শহরটিকে নতুন করে সাজাচ্ছে। রুশ প্রশাসনের হিসাবে এখন পর্যন্ত ১,২০০টি ভবন সংস্কার হয়েছে—যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম।
অধিগ্রহণ আর নাগরিকত্বের শর্তে ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা
অলেক্সান্দ্রা স্টোলিয়ার—একদা মারিউপোলে থাকা একজন কিন্ডারগার্টেন সংগীত শিক্ষক—যখন জানতে পারেন তার ফ্ল্যাটকে “পরিত্যক্ত” ঘোষণা করে রুশপন্থী প্রশাসন বাজেয়াপ্ত করেছে, তখন তিনি ইতিমধ্যেই শহর ছেড়ে চলে যান। তিনি রুশ নাগরিক না হওয়ায় পুনরায় নিবন্ধন করতে পারেননি।
তিনি বলেন, “আমার বাসা, আসবাব, সবকিছু হারানোর কথা মেনে নিয়েছিলাম, কিন্তু জীবনের সেই অংশটুকু কেড়ে নেওয়া হয়েছে—এটাই কষ্টের।”
এমন অভিযোগ আরও বহু বাসিন্দার। কেউ নতুন অ্যাপার্টমেন্টের দাম—প্রায় ১,০০,০০০ ডলার—কিনা তো দূরের কথা, স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। অনেকেই অনলাইনে ভিডিও বার্তা দিয়ে জানান যে শহর প্রশাসন যুদ্ধাহত মানুষদের নতুন বাসা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি মানছে না।
পুনর্গঠন না প্রতীকী প্রদর্শনী—দ্বিধায় শহরবাসী
কিছু বাসিন্দা উন্নয়ন দেখে খুশি হলেও অনেকে এটিকে “পতেমকিন ভিলেজ”—অর্থাৎ বাহ্যিক সৌন্দর্যে আড়াল করা বাস্তব সমস্যার শহর—বলে মনে করেন।
কিয়েভে বসবাসরত মারিউপোলের সাবেক টিভি প্রধান নিকোলাই ওসিচেঙ্কো বলেন, “এত কাজ হলেও শহরের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন নিয়ে কোনো সামগ্রিক পরিকল্পনা দেখা যায় না।”
শহরের রূপ বদলে দিচ্ছে ‘রাশিয়াকরণ’
মারিউপোলে এখন সর্বত্র রুশ পতাকা, রুশ প্রতীক ও “মুক্তি দিবস” লেখা বিশাল ব্যানার। ইউক্রেনীয় কোনো স্মৃতিস্তম্ভ আর নেই।
আজভস্তাল স্ট্রিটের নাম বদলে রাখা হয়েছে ‘তুলা অ্যাভিনিউ’। সেখানে তুলা শহরের প্রতীক—একটি বিশাল স্যামোভার আর জিঞ্জারব্রেড—স্থাপন করা হয়েছে।
ওসিচেঙ্কো মনে করেন, “প্রতিরোধের ইতিহাস মুছে ফেলার জন্যই এসব নাম পরিবর্তন।”
দুর্নীতি আর অস্পষ্ট বাজেটের অভিযোগ
মারিউপোল পুনর্গঠনের বাজেট বিশাল, কিন্তু হিসাব স্বচ্ছ নয়। রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী তিমুর ইভানোভ ২০২৫ সালে দুর্নীতির দায়ে ১৩ বছরের সাজা পান—অভিযোগের মধ্যে ছিল মারিউপোলের নির্মাণ প্রকল্পে ঘুষ গ্রহণ।
বিশ্লেষকদের ধারণা, আগামী তিন বছরে শহরের জন্য আরও ৪ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রয়েছে।
পুরোনো শহর পরিকল্পনা বদলে নতুন রুশ পরিকল্পনা
রাশিয়ার তৈরি নতুন মাস্টারপ্ল্যান আংশিকভাবে ইউক্রেনের আগের “মারিউপোল রিবর্ন” প্রকল্প থেকে ধারণা নিলেও সেটিকে রুশ কাঠামোর সঙ্গে মানিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
কিছু ঐতিহাসিক ভবন মেরামত করা হচ্ছে, যেমন—ড্রামা থিয়েটার, যেখানে “চিলড্রেন” লেখা থাকা সত্ত্বেও রুশ হামলায় সাধারণ মানুষ মারা যায়।
ফিরে আসার পথে বাধা: কাগজপত্র, নাম পরিবর্তন ও নিষেধাজ্ঞা
মারিউপোল ফিরতে হলে ইউক্রেনীয়দের প্রথমে মস্কোর শেরেমেতিয়েভো বিমানবন্দরে গিয়ে ‘মনোভাব পরীক্ষা’ পেরোতে হয়। কারও মতামত রাশিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে তাকে ১০ বছর বা তার বেশি সময় শহরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
রুশ প্রশাসন রাস্তা ও ভবনের নম্বর পরিবর্তন করায় পুরোনো ইউক্রেনীয় দলিল কার্যত অকার্যকর হয়ে যায়। ফলে বহু বাসিন্দা তাদের বাড়ির পরিবর্তে তৈরি নতুন অ্যাপার্টমেন্ট দাবি করার সুযোগ হারান।
নতুন বাসিন্দা রুশরা—পুরোনো বাসিন্দারা অনিশ্চয়তায়
যারা ক্ষতিপূরণ নেন, তারা খুব সামান্য অর্থ পান। কিন্তু নতুন অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে আসা রুশরা পায় মাত্র ২ শতাংশ সুদের সরকারি মর্টগেজ—যা রাশিয়ার বাকি অংশের ২২ শতাংশ সুদের তুলনায় অনেক কম।
নাটালিয়া সভিদলোভা বলেন, “যারা তাদের পুরোনো জায়গাতেই বাসা চান, তারা আজও বাড়ি–বাড়ি ঘুরছেন।”নতুন অবকাঠামো গড়ে উঠলেও অনেক পুরোনো বাসিন্দা ফিরতে পারছেন না
নতুন এলাকা ‘নেভস্কি’: সমস্যার পাহাড়
পুরোনো শহর থেকে বিতাড়িত অনেককে শহরের প্রান্তে নেভস্কি এলাকায় রাখা হয়েছে, যেখানে ১২টি পাঁচতলা ভবন ও একটি হাসপাতাল আছে।
২০২৩ সালে পুতিন নিজে এই এলাকা পরিদর্শন করেন।
কিন্তু বাসিন্দাদের অভিযোগ—
সঠিক গণপরিবহন নেই
হাসপাতাল কর্মী সংকটে ভুগছে
শহরের বাইরে হওয়ায় জীবনযাত্রা কঠিন
উন্নয়ন যতই হোক, ক্ষত-ভরা স্মৃতি মুছে না
অনেকে লুকানো সমস্যার কথাও বলেন—
শহরের বহু এলাকায় এখনো যুদ্ধের সময়ের ধ্বংসস্তূপ
পথেঘাটে ভবঘুরে কুকুরের দল
নির্মাণ কাজের সময় মাঝে মাঝে কবরহীন মানবদেহের সন্ধান
এক বাসিন্দা বলেন, “মারিউপোল ছাড়ার সময় যা হারিয়ে এসেছি ভেবে কাঁদতাম। ফিরে গিয়ে যা দেখেছি, সেটার জন্য আরও বেশি কেঁদেছি।”
# মারিউপোল পুনর্গঠন #রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ #অধিগ্রহণ সংকট #সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 





















