১০:৩৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

মেটা কি সত্যিই একচেটিয়া শক্তি নয়?

যুক্তরাষ্ট্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিট্রাস্ট মামলায় ফেডারেল বিচারক জেমস বোয়াসবার্গের রায় বড় বিতর্ক তৈরি করেছে। বিচারক ঘোষণা করেছেন যে ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি মেটা ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগের বাজারে কোনো একচেটিয়া অবস্থানে নেই। সরকার যে প্রমাণ দেখিয়েছে এবং সাধারণ যুক্তি — দুটোকেই উপেক্ষা করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। শুধু যুক্তির সীমাবদ্ধতাই নয়, রায়ে এমন বার্তা গেছে যেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী কোম্পানিগুলো আইনের ঊর্ধ্বে।


অ্যান্টিট্রাস্ট আইন ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব

১৮৯০ সালের শেরম্যান অ্যান্টিট্রাস্ট আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট করা: দেশটি কার নিয়ন্ত্রণে। ১৯০১ সালে থিওডর রুজভেল্ট বলেছিলেন, বড় করপোরেট শক্তিগুলোকে সরকার কি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম — সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী করপোরেট আধিপত্য জনগণের ক্ষোভ বাড়ায়।


বিচারকের যুক্তি কোথায় দুর্বল

সরকারের অভিযোগ ছিল মেটা (তৎকালীন ফেসবুক) ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা ধ্বংস করেছে এবং আইন ভঙ্গ করেছে। কিন্তু বিচারক মামলাটি বাতিল করেন এই যুক্তিতে যে বর্তমানে মেটার একচেটিয়া ক্ষমতা নেই। অথচ বিচার হওয়া উচিত ছিল অধিগ্রহণের সময় তাদের অবস্থান কী ছিল।

এমনকি এখন মেটার একচেটিয়া শক্তি নেই — এ দাবিও টিকিয়ে রাখতে বিচারককে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ উপেক্ষা করতে হয়েছে। সরকারের নথিতে দেখা যায়, ২০২৪ সালে মেটার ১৬৪.৫ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব থেকে ৮৭.১ বিলিয়ন ডলার অপারেটিং মুনাফা হয়েছে — যা স্পষ্ট একচেটিয়া বাজার শক্তির লক্ষণ। মেটা বিজ্ঞাপনের চাপ বাড়িয়েছে, গোপনীয়তা নীতি কমিয়েছে, পরিষেবার মান কমলেও ব্যবহারকারী হারায়নি — প্রতিযোগিতামুখী বাজারে যা প্রায় অসম্ভব।

Meta has won the antitrust case that could have forced it to spin off  Instagram and WhatsApp - Yahoo News UK

টিকটক—ইউটিউব শর্টস যুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য

বিচারকের মতে, টিকটক বা ইউটিউব শর্টসের উত্থান দেখায় মেটা একচেটিয়া নয়। কিন্তু ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগ (বন্ধু–পরিবারের যোগাযোগ) বাজার ও সংক্ষিপ্ত ভিডিওর বাজার সম্পূর্ণ আলাদা ক্ষেত্র। তাই এই যুক্তির ওপর ভর করে মেটাকে ছাড় দেওয়া অত্যন্ত দুর্বল আইনগত ব্যাখ্যা।


অ্যান্টিট্রাস্ট আইনের লক্ষ্যবস্তু কী সত্যিই সুরক্ষিত?

কেউ কি সত্যিই সন্দেহ করেন যে মেটা সেই ধরনের করপোরেট শক্তি নয়, যাদের নিয়ন্ত্রণ করতেই এসব আইন তৈরি করা হয়েছিল? অতীতে এ টি অ্যান্ড টি ও মাইক্রোসফটের মতো কোম্পানিকেও আদালত কঠোরভাবে জবাবদিহির মুখে দাঁড় করিয়েছিল।

১৯৪০-এর দশকে বিচারক লার্নড হ্যান্ড অ্যালকোকে নিয়ে রায় দেওয়ার সময় বলেছিলেন, আইনের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণে বিভ্রান্ত হওয়া যায়, কিন্তু যদি বলা হয় অ্যালকো একচেটিয়া নয় — তবে সাধারণ মানুষ আমাদের বোকা বলবে। সেটিই যৌক্তিক।


গুগল মামলার উদাহরণ: বড় কোম্পানির প্রতি ‘দয়া’

গত বছর বিচারক অমিত মেহেতা গুগলকে অবৈধ একচেটিয়া বলেছিলেন, কিন্তু এ বছর কঠোর শাস্তি আরোপে দ্বিধায় পড়েন। এই ধরনের সিদ্ধান্ত বড় টেক কোম্পানিকে ভুল সংকেত দেয় — আইনজীবীর পেছনে মিলিয়ন ডলার খরচ করলে বিলিয়ন ডলার লাভ রক্ষা করা যায়। এতে দায়মুক্তির মানসিকতা আরও শক্তিশালী হয়।


মেটাকে এখনো জবাবদিহির মুখে দাঁড় করানো হয়নি

মেটার এক দশকের কেলেঙ্কারি, ডেটা অপব্যবহার, হুইসেলব্লোয়ারদের অভিযোগ — কোনো কিছুর পরও যুক্তরাষ্ট্রে কোম্পানিটিকে প্রকৃত জবাবদিহির মুখে দাঁড় করানো হয়নি। এটি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার এক লজ্জাজনক ব্যর্থতা।


গণতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষাকারী নীতির দুর্বলতা

২০শ শতকের শ্রম আইন, আর্থিক নিয়ন্ত্রণ, টেলিকম নীতি, করব্যবস্থা — এসব ব্যবস্থা বহু দশক যুক্তরাষ্ট্রকে দুই শ্রেণির সমাজে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল। এখন সেসব নীতি দুর্বল বা অকার্যকর।


রুজভেল্টের যুগ বনাম বর্তমান সময়

১৯০২ সালে রুজভেল্ট অ্যান্টিট্রাস্ট অভিযান শুরু করেছিলেন গণতন্ত্র রক্ষার প্রয়োজনে। তখন অর্থনীতি ছিল ভয়াবহ ভারসাম্যহীন, উগ্র মতাদর্শ ছড়াচ্ছিল, কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছিল। রেলপথ, ব্যাংক ও করপোরেট শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে সরকার সেই ক্ষোভ অনেকটাই প্রশমিত করেছিল।

বর্তমানেও পরিস্থিতি প্রায় একই — বরং আরও জটিল। কিন্তু সরকার ও আদালত বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন; কংগ্রেসও সেভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফলে জনসাধারণ হতাশ হচ্ছে এবং এমন মতাদর্শের দিকে ঝুঁকছে যা পুরো ব্যবস্থাকেই উল্টে দিতে চায়।


# politics # tech  #antitrust # Meta  #US_law

জনপ্রিয় সংবাদ

মেটা কি সত্যিই একচেটিয়া শক্তি নয়?

০৮:৪৬:১৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিট্রাস্ট মামলায় ফেডারেল বিচারক জেমস বোয়াসবার্গের রায় বড় বিতর্ক তৈরি করেছে। বিচারক ঘোষণা করেছেন যে ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি মেটা ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগের বাজারে কোনো একচেটিয়া অবস্থানে নেই। সরকার যে প্রমাণ দেখিয়েছে এবং সাধারণ যুক্তি — দুটোকেই উপেক্ষা করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। শুধু যুক্তির সীমাবদ্ধতাই নয়, রায়ে এমন বার্তা গেছে যেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী কোম্পানিগুলো আইনের ঊর্ধ্বে।


অ্যান্টিট্রাস্ট আইন ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব

১৮৯০ সালের শেরম্যান অ্যান্টিট্রাস্ট আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট করা: দেশটি কার নিয়ন্ত্রণে। ১৯০১ সালে থিওডর রুজভেল্ট বলেছিলেন, বড় করপোরেট শক্তিগুলোকে সরকার কি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম — সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী করপোরেট আধিপত্য জনগণের ক্ষোভ বাড়ায়।


বিচারকের যুক্তি কোথায় দুর্বল

সরকারের অভিযোগ ছিল মেটা (তৎকালীন ফেসবুক) ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা ধ্বংস করেছে এবং আইন ভঙ্গ করেছে। কিন্তু বিচারক মামলাটি বাতিল করেন এই যুক্তিতে যে বর্তমানে মেটার একচেটিয়া ক্ষমতা নেই। অথচ বিচার হওয়া উচিত ছিল অধিগ্রহণের সময় তাদের অবস্থান কী ছিল।

এমনকি এখন মেটার একচেটিয়া শক্তি নেই — এ দাবিও টিকিয়ে রাখতে বিচারককে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ উপেক্ষা করতে হয়েছে। সরকারের নথিতে দেখা যায়, ২০২৪ সালে মেটার ১৬৪.৫ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব থেকে ৮৭.১ বিলিয়ন ডলার অপারেটিং মুনাফা হয়েছে — যা স্পষ্ট একচেটিয়া বাজার শক্তির লক্ষণ। মেটা বিজ্ঞাপনের চাপ বাড়িয়েছে, গোপনীয়তা নীতি কমিয়েছে, পরিষেবার মান কমলেও ব্যবহারকারী হারায়নি — প্রতিযোগিতামুখী বাজারে যা প্রায় অসম্ভব।

Meta has won the antitrust case that could have forced it to spin off  Instagram and WhatsApp - Yahoo News UK

টিকটক—ইউটিউব শর্টস যুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য

বিচারকের মতে, টিকটক বা ইউটিউব শর্টসের উত্থান দেখায় মেটা একচেটিয়া নয়। কিন্তু ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগ (বন্ধু–পরিবারের যোগাযোগ) বাজার ও সংক্ষিপ্ত ভিডিওর বাজার সম্পূর্ণ আলাদা ক্ষেত্র। তাই এই যুক্তির ওপর ভর করে মেটাকে ছাড় দেওয়া অত্যন্ত দুর্বল আইনগত ব্যাখ্যা।


অ্যান্টিট্রাস্ট আইনের লক্ষ্যবস্তু কী সত্যিই সুরক্ষিত?

কেউ কি সত্যিই সন্দেহ করেন যে মেটা সেই ধরনের করপোরেট শক্তি নয়, যাদের নিয়ন্ত্রণ করতেই এসব আইন তৈরি করা হয়েছিল? অতীতে এ টি অ্যান্ড টি ও মাইক্রোসফটের মতো কোম্পানিকেও আদালত কঠোরভাবে জবাবদিহির মুখে দাঁড় করিয়েছিল।

১৯৪০-এর দশকে বিচারক লার্নড হ্যান্ড অ্যালকোকে নিয়ে রায় দেওয়ার সময় বলেছিলেন, আইনের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণে বিভ্রান্ত হওয়া যায়, কিন্তু যদি বলা হয় অ্যালকো একচেটিয়া নয় — তবে সাধারণ মানুষ আমাদের বোকা বলবে। সেটিই যৌক্তিক।


গুগল মামলার উদাহরণ: বড় কোম্পানির প্রতি ‘দয়া’

গত বছর বিচারক অমিত মেহেতা গুগলকে অবৈধ একচেটিয়া বলেছিলেন, কিন্তু এ বছর কঠোর শাস্তি আরোপে দ্বিধায় পড়েন। এই ধরনের সিদ্ধান্ত বড় টেক কোম্পানিকে ভুল সংকেত দেয় — আইনজীবীর পেছনে মিলিয়ন ডলার খরচ করলে বিলিয়ন ডলার লাভ রক্ষা করা যায়। এতে দায়মুক্তির মানসিকতা আরও শক্তিশালী হয়।


মেটাকে এখনো জবাবদিহির মুখে দাঁড় করানো হয়নি

মেটার এক দশকের কেলেঙ্কারি, ডেটা অপব্যবহার, হুইসেলব্লোয়ারদের অভিযোগ — কোনো কিছুর পরও যুক্তরাষ্ট্রে কোম্পানিটিকে প্রকৃত জবাবদিহির মুখে দাঁড় করানো হয়নি। এটি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার এক লজ্জাজনক ব্যর্থতা।


গণতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষাকারী নীতির দুর্বলতা

২০শ শতকের শ্রম আইন, আর্থিক নিয়ন্ত্রণ, টেলিকম নীতি, করব্যবস্থা — এসব ব্যবস্থা বহু দশক যুক্তরাষ্ট্রকে দুই শ্রেণির সমাজে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল। এখন সেসব নীতি দুর্বল বা অকার্যকর।


রুজভেল্টের যুগ বনাম বর্তমান সময়

১৯০২ সালে রুজভেল্ট অ্যান্টিট্রাস্ট অভিযান শুরু করেছিলেন গণতন্ত্র রক্ষার প্রয়োজনে। তখন অর্থনীতি ছিল ভয়াবহ ভারসাম্যহীন, উগ্র মতাদর্শ ছড়াচ্ছিল, কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছিল। রেলপথ, ব্যাংক ও করপোরেট শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে সরকার সেই ক্ষোভ অনেকটাই প্রশমিত করেছিল।

বর্তমানেও পরিস্থিতি প্রায় একই — বরং আরও জটিল। কিন্তু সরকার ও আদালত বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন; কংগ্রেসও সেভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফলে জনসাধারণ হতাশ হচ্ছে এবং এমন মতাদর্শের দিকে ঝুঁকছে যা পুরো ব্যবস্থাকেই উল্টে দিতে চায়।


# politics # tech  #antitrust # Meta  #US_law