যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে ২৮ দফার একটি শান্তি পরিকল্পনা তৈরি করেছে, যা এখন ইউক্রেন, রাশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ পর্যালোচনা করছে। প্রস্তাবটি রাশিয়ার জন্য কিছু বড় সুবিধা রাখলেও এমন কিছু শর্তও রয়েছে, যা মস্কোর জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে এবং তাদের দখল করা কিছু এলাকা থেকে সরে আসতে বাধ্য করতে পারে।
নিচে পরিকল্পনার সবচেয়ে বিতর্কিত অংশগুলো তুলে ধরা হলো।
অঞ্চলগত সমঝোতা
প্রস্তাব অনুযায়ী ইউক্রেনকে ডোনেৎস্ক অঞ্চলের অবশিষ্ট অংশ রাশিয়াকে ছেড়ে দিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ শহর স্লোভিয়ান্স্ক ও ক্রামাতোর্স্ক—যা এখনও ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আগে থেকেই জানিয়েছেন, তিনি রাশিয়াকে কোনো ভূখণ্ড ছাড়তে রাজি নন।
এই চুক্তি রাশিয়ার ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে দখল করা চারটি অঞ্চল—লুহানস্ক, জাপোরিঝঝিয়া, খেরসন ও ডোনেৎস্ক—স্থায়ীভাবে রাশিয়ার অধীনে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের বিষয়টিও স্থায়ী বলে বিবেচিত হবে।
জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক কেন্দ্রের বিষয়ে ইউক্রেনকে আপস করতে হবে। কেন্দ্রটি পুনরায় চালু করা হবে এবং উৎপাদিত বিদ্যুৎ রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে অর্ধেক করে ভাগ হবে।
তবে এসব অঞ্চলকে রাশিয়ার বলে ‘ডি-ফ্যাক্টো’ স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে—যা রাশিয়া হয়তো গ্রহণ করতে চাইবে না। এতে খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়ার পুরো নিয়ন্ত্রণ রাশিয়া পাবে না; বর্তমান যুদ্ধরেখা ধরে নতুন সীমানা স্থির হবে।

ডোনেৎস্কের যে অংশ ইউক্রেন রাশিয়াকে দেবে, সেখানে রাশিয়ার সেনা মোতায়েন নিষিদ্ধ থাকবে। এলাকা হবে একটি নিরস্ত্রীকৃত বাফার জোন—রাশিয়ার অধীন হলেও সামরিকভাবে নিষ্ক্রিয়।
এ ছাড়া রাশিয়াকে খারকিভ ও দনিপ্রোপেত্রোভস্ক অঞ্চলের দখলকৃত এলাকা থেকেও সরে যেতে হবে।
অর্থনৈতিক শর্ত
পশ্চিমা দেশগুলো যুদ্ধের সময় রাশিয়ার প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার সম্পদ জব্দ করেছে। রাশিয়া এগুলো মুক্ত করার দাবি করছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও হুমকি দিয়েছে—কারণ ইইউ এই সম্পদের সুদ থেকে ইউক্রেনকে ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
মার্কিন পরিকল্পনা অনুযায়ী রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রকে ১০০ বিলিয়ন ডলার দিতে হবে, যা ইউক্রেন পুনর্গঠনে ব্যবহৃত হবে। এ কাজ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ৫০ শতাংশ লাভ পাবে।
জব্দ করা রুশ সম্পদের আরেকটি অংশ যুক্তরাষ্ট্র–রাশিয়া যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্পে ব্যবহৃত হবে, যেখান থেকে রাশিয়াও কিছু সুবিধা পাবে।
তবে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তৎক্ষণাৎ উঠবে না; ধাপে ধাপে আলাপ–আলোচনার ভিত্তিতে তা শিথিল করা হবে।
ইউক্রেনকে কঠিন শর্ত হিসেবে মেনে নিতে হবে—রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষতির ক্ষতিপূরণ দাবির কোনো মামলা করা যাবে না।
নিরাপত্তা সম্পর্কিত শর্ত
এই পরিকল্পনা অনুযায়ী জেলেনস্কিকে ন্যাটোতে যোগদানের স্বপ্ন চিরতরে ত্যাগ করতে হবে। ন্যাটোও প্রতিশ্রুতি দেবে যে ইউক্রেনকে কখনো সদস্য করা হবে না এবং ইউক্রেনের সংবিধান তা অনুযায়ী সংশোধন করতে হবে। ন্যাটো আরও প্রতিশ্রুতি দেবে যে তারা আর বিস্তৃতি ঘটাবে না।
বদলে রাশিয়ার কাছ থেকে প্রত্যাশা করা হবে যে তারা প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর আক্রমণ করবে না। ইউক্রেন, রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে একটি অনাক্রমণ চুক্তি করার কথাও বলা হয়েছে।
ওয়াশিংটনের কাছ থেকে ইউক্রেন যে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা পাবে, সেটির ভাষা বেশ অস্পষ্ট। শুধু বলা হয়েছে যে নিশ্চয়তা ‘দৃঢ়’ হবে এবং ইউক্রেনকে এর জন্য অর্থ দিতে হবে। এর বাইরেও বিশেষ কিছু উল্লেখ নেই।
ন্যাটো সেনারা ইউক্রেনে মোতায়েন হতে পারবে না। ইউক্রেনকেও প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে তারা কখনো পারমাণবিক রাষ্ট্র হবে না এবং তাদের সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ সদস্যসংখ্যা হবে ৬ লাখ। ইউক্রেন বহুবার জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর আকার সীমিত করার বিষয়টি তারা পছন্দ করে না।

বিচার ও আন্তর্জাতিক অবস্থান
ইউক্রেন বহুদিন ধরে রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধ প্রমাণ করতে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু এই চুক্তি অনুযায়ী সে পথ বন্ধ হয়ে যাবে—কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ প্রমাণের চেষ্টা করা যাবে না।
রাশিয়াকে আবার জি–৮–এ ফিরিয়ে আনা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবও রয়েছে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সহযোগিতা—বিশেষ করে জ্বালানি, বিরল ধাতু এবং আর্কটিক অঞ্চলে বিনিয়োগ—বাড়ানোর কথাও বলা হয়েছে।
শান্তি পরিকল্পনাটি যুদ্ধ শেষ করার একটি কাঠামো দিলেও এতে একাধিক কঠোর ছাড়, জটিল নিরাপত্তা শর্ত এবং বিতর্কিত ভূখণ্ডগত প্রস্তাব রয়েছে। ফলে এটি গ্রহণযোগ্য হবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত।
#যুক্তরাষ্ট্র #ইউক্রেন #রাশিয়া #শান্তি_পরিকল্পনা #আন্তর্জাতিক_রাজনীতি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















