তাইওয়ানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইতিহাসের লড়াই
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে তাইওয়ানের “চীনে প্রত্যাবর্তন” বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে বেইজিংয়ের দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রীয় অংশ। এই বক্তব্য আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে, তাইওয়ান ইস্যুতে বর্তমান উত্তেজনা বোঝার জন্য এক শতাব্দী আগের যুদ্ধে ও চুক্তিতে ফিরে যেতে হয়। ১৮৯৫ সালে প্রথম চীন–জাপান যুদ্ধে পরাজয়ের পর কুইং সাম্রাজ্য শিমোনোসেকি চুক্তির মাধ্যমে তাইওয়ান জাপানের হাতে তুলে দেয়। জাপানি শাসনের ৫০ বছর দ্বীপটির অর্থনীতি ও অবকাঠামো পাল্টে দেয়, আবার অত্যাচার ও বৈষম্যের অভিজ্ঞতা এক নতুন জাতিগত–রাজনৈতিক পরিচয়ও গড়ে তোলে।
১৯৩০-এর দশকে জাপান মাঞ্চুরিয়া ও মূল ভূখণ্ড চীনে আক্রমণ করলে জাতীয়তাবাদী ও কমিউনিস্টদের মধ্যে সাময়িক জোট গড়ে ওঠে। কিন্তু ১৯৪৫ সালে জাপানের আত্মসমর্পণের পর সেই জোট ভেঙে পড়ে, পুরোদমে ফিরে আসে গৃহযুদ্ধ। যুদ্ধোত্তর ব্যবস্থার অংশ হিসেবে তাইওয়ান জাতীয়তাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে এলেও গণতন্ত্র বা মানবাধিকার নিশ্চিত হয়নি; বরং নতুন প্রশাসন ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে নতুন উত্তেজনা জমে ওঠে। একই সময় মূল ভূখণ্ডে গৃহযুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে—যার পরিণতি আজকের বিভক্ত বাস্তবতা।
১৯৪৯ সালে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা মূল ভূখণ্ড দখল করে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন গঠন করে; আর চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী সরকার পিছু হটে তাইওয়ানে গিয়ে প্রজাতন্ত্রী চীনের সরকার হিসেবে টিকে থাকে। দুই পক্ষই তখন পুরো চীনের বৈধ প্রতিনিধি হওয়ার দাবি তোলে, আর তাইওয়ান প্রণালী পরিণত হয় শীতল যুদ্ধের অন্যতম স্পর্শকাতর সংঘাতরেখায়। পরবর্তী দশকে তাইওয়ান সামরিক শাসন ও একদলীয় কাঠামো থেকে ধীরে ধীরে বহুদলীয় গণতন্ত্রে পরিণত হয়। এই পরিবর্তন দ্বীপের মানুষের চোখে নিজেদের পরিচয় ও ভবিষ্যৎ পথচলা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।
আজ তাইওয়ানের অধিকাংশ নাগরিক নিজেকে “তাইওয়ানিজ” হিসেবে পরিচয় দেন; গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের অধীনে একীকরণ সমর্থন করেন খুব কম সংখ্যক মানুষ। অন্যদিকে বেইজিং এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ঘোষণাপত্র ও চুক্তিকে ভিত্তি করে দ্বীপটির ওপর সার্বভৌমত্ব দাবি করে, যেন ইতিহাসের অসম্পূর্ণ “একত্রীকরণ” এখনো বাকি। দুই দৃষ্টিভঙ্গির এই ফাঁক কেবল অতীত ব্যাখ্যার পার্থক্য নয়; এটি আন্তর্জাতিক আইন, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও বৈধতার প্রশ্নেও একে অপরকে চ্যালেঞ্জ জানায়।

আজকের নিরাপত্তা সংকট ও আঞ্চলিক রাজনীতি
শি জিনপিং ট্রাম্পের সঙ্গে আলাপের সময় ইতিহাস সামনে আনার মাধ্যমে মূলত দুই স্তরে বার্তা দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক মহলে তিনি বোঝাতে চান, তাইওয়ান ইস্যু শুধুই সমসাময়িক সীমানা বিরোধ নয়; এটি নাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের “অপূর্ণতা” দূর করার প্রশ্ন। ঘরের ভেতরে, চীনা নাগরিকের কাছে তিনি আবারও সেই গল্প শুনাচ্ছেন যেখানে কমিউনিস্ট পার্টিই নাকি জাতীয় পুনরুত্থানের একমাত্র বাহক। এতে করে তাইওয়ান বিষয়ে সমঝোতার রাজনৈতিক জায়গা সংকুচিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এতে নতুন জটিলতা তৈরি হচ্ছে। একদিকে ওয়াশিংটন গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে একমাত্র বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে; অন্যদিকে আইন করে তাইওয়ানের আত্মরক্ষার সক্ষমতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বেইজিং যখন ১৯৪০-এর দশকের নথি সামনে আনে, তখন মার্কিন নীতি–নির্ধারকেরা জোর দেন ২০২৫ সালের বাস্তবতায়: স্বাধীন প্রেস সহ একটি গণতান্ত্রিক সমাজ, বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ শৃঙ্খলায় তাইওয়ানের ভূমিকা এবং সমগ্র ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তা।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো মিত্রদের জন্যও এই অতীতনির্ভর ভাষ্য নতুন শঙ্কা তৈরি করছে। দুই দেশই তাইওয়ান প্রণালী দিয়ে চলাচলকারী জাহাজের ওপর নির্ভরশীল এবং তাদের নিজস্ব যুদ্ধ–ইতিহাসও এই অঞ্চলের সঙ্গে জড়িত। কোনো ভুল হিসাব বা দুর্ঘটনার ফলে যদি সামুদ্রিক সংঘাত শুরু হয়, তা মুহূর্তেই জড়িয়ে ফেলতে পারে মার্কিন ঘাঁটি, নিরাপত্তা চুক্তি এবং বহু আধুনিক অস্ত্রব্যবস্থা।
একই সঙ্গে শি জিনপিংয়ের “ইতিহাসের মিশন”–ভিত্তিক রাজনীতি ২০৪৯ সালের মধ্যে জাতীয় পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যের সঙ্গে তাইওয়ান ইস্যুকে শক্তভাবে বেঁধে দেয়। এতে সামরিক মহড়া, অর্থনৈতিক চাপ ও কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা আরও নিয়মিত কৌশলে পরিণত হচ্ছে, যা থেকে পিছু হটার অবকাশ কম। তাইওয়ানের নেতৃত্বের জন্য এর মানে হলো—মিত্র গণতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করা, বাণিজ্যে বৈচিত্র্য আনা এবং প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানো, পাশাপাশি এমন কোনো পদক্ষেপ এড়িয়ে চলা যা সরাসরি সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
অবশেষে, ১৮৯৫–১৯৪৯ সালের ঘটনাপ্রবাহকে ঘিরে যে ভিন্ন ভিন্ন বয়ান তৈরি হয়েছে, তা এখন ২০২৫ সালের সিদ্ধান্তকেও প্রভাবিত করছে। তাইওয়ান প্রণালী শান্ত কিন্তু অস্থির থাকবে, নাকি খোলামেলা সংঘাতে গড়াবে—তা অনেকটাই নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট নেতারা কতটা নিজেদের লেখা ইতিহাসের গল্প দিয়ে নিজেদের হাত বেঁধে ফেলেন, আর কতটা সেই গল্পের বাইরেও নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন তার ওপর।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















