১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৩৭টি আসনে প্রাথমিক প্রার্থীর তালিকা ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন জেলায় বিএনপির ভেতর তীব্র অসন্তোষ, দ্বন্দ্ব ও প্রতিবাদ দেখা দিয়েছে। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে দল এখন বিতর্কিত ও ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ কয়েকজন প্রার্থীকে বাদ দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে। একই সঙ্গে নির্বাচনী প্রস্তুতিও চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে বিএনপি।
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসনে সিনিয়র নেতাদের দায়িত্ব
দলীয় সূত্র বলছে, কয়েকটি আসনে বিরোধ মেটাতে এবং মনোনীত প্রার্থীদের কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন করতে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা মাঠে কাজ করছেন। তারা দলের ভেতরকার বিরোধ, দুর্বলতা ও বিতর্কিত মনোনয়নের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছেন।
সোমবার রাতে গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
৩৫টি মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার তালিকা
স্থায়ী কমিটির এক সদস্য (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, ৩৫টি আসনের মনোনয়ন প্রাথমিকভাবে পুনর্মূল্যায়নের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। তিনি বলেন, এই তালিকায় থাকা সব প্রার্থী পরিবর্তন করা হবে—এমন নয়; বরং মনোনয়ন ঠিক হয়েছে কি না তা আবার যাচাই করা হবে।
এ জন্য ওই আসনগুলোতে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ জরিপ পরিচালনার পরিকল্পনাও রয়েছে, যাতে প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের শক্তিমত্তা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কমিয়ে একক প্রার্থী নিশ্চিতের প্রচেষ্টা
দলীয় নেতার ভাষ্য, সব আসনে অভ্যন্তরীণ বিরোধ দূর করে দলের পক্ষ থেকে একক প্রার্থীকে নির্বাচনে পাঠানোই বিএনপির লক্ষ্য।

প্রতিবাদ-সংঘর্ষে বিব্রত নেতৃত্ব
৩ নভেম্বর বিএনপি ২৩৭টি আসনে প্রাথমিক মনোনয়ন ঘোষণা করে। এরপর প্রায় ৬০টি আসনে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হন, যা দলীয় নেতৃত্বের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
বিতর্কিত ও বয়স্ক প্রার্থী নিয়ে আপত্তি
বৈঠকে কয়েকজন স্থায়ী কমিটি সদস্য অভিযোগ করেন যে, বিতর্কিত, আলোচনায় নেতিবাচকভাবে পরিচিত এবং কিছু ক্ষেত্রে বয়স্ক ও স্থানীয় দ্বন্দ্বে জড়িত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দলীয় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
তারা মনে করেন, এসব আসনে নিবেদিত ও যোগ্য নেতাদের মনোনয়ন দিলে দলের ভেতরের উত্তেজনা ও বিভক্তি অনেকটাই কমে যাবে।
চট্টগ্রাম-১২ ও নোয়াখালি-৫ আসনের উদাহরণ
এক সিনিয়র নেতা উল্লেখ করেন, চট্টগ্রাম-১২ ও নোয়াখালি-৫ আসনে মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও প্রচলিত গণমাধ্যমে ব্যাপক নেতিবাচক আলোচনা চলছে।
কিছু এলাকায় প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষও হয়েছে।
মোশাররফ ও সালাহউদ্দিনের মতামত
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, অনেক উৎসাহী নেতাকর্মী মনোনয়ন না পেয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, যা স্বাভাবিক। তার মতে, এসব উত্তাপ সময়ের সঙ্গে কমে আসবে।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটি দলের চূড়ান্ত তালিকা নয়। কিছু জায়গায় সিদ্ধান্ত সঠিক না হলে সেটি পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে, তবে ব্যাপক পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম।
চূড়ান্ত তালিকা পরেও আন্দোলন হলে কঠোর পদক্ষেপ
আরেক সদস্য জানান, কয়েকটি মনোনয়ন যাচাই-বাছাইয়ের পর পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে। তিনি আরও বলেন, চূড়ান্ত তালিকা ঘোষণার পরও একই ধরনের প্রতিবাদ হলে দলের অবস্থান আরও কঠোর হবে।
নির্বাচন সামনে রেখে বড় আকারের প্রচার কৌশল
বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটি সদস্য জানান, নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘সেক্টরভিত্তিক প্রতিশ্রুতি’ ও উন্নয়নমুখী বার্তা নিয়ে একটি বড় আকারের প্রচার কৌশল হাতে নেওয়া হয়েছে।
এর অংশ হিসেবে কেন্দ্র, সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনের নেতাদের নিয়ে আসনভিত্তিক টিম গঠন কাজ চলছে।
এই টিম ভোটারদের কাছে লিফলেটের মাধ্যমে জানাবে—বিএনপি ক্ষমতায় এলে কী বাস্তবায়ন করবে, কোন সংস্কার আনবে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নের নকশা কী হবে।

প্রচার বার্তার মূল থিম ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’
কৌশল অনুযায়ী, নেতিবাচক বক্তব্য পরিহার করে বাস্তবসম্মত উন্নয়ন পরিকল্পনাকে সামনে আনা হবে ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ ধারণার ভিত্তিতে।
ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার পরিকল্পনা ও জুলাই ঘোষণার আলোকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, পরিবেশ, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন পরিকল্পনা সংযুক্ত করা হচ্ছে।
পরিকল্পনায় রয়েছে—স্বল্পমূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষা, কৃষকদের সহায়তা, বড় জলব্যবস্থাপনা প্রকল্প এবং কুটির শিল্প পুনরুজ্জীবন।
নারী ও যুব ভোটার টার্গেট
প্রচারণায় নারী ভোটারদের আকর্ষণে ‘ফ্যামিলি কার্ড’ উদ্যোগ এবং যুবসমাজকে আকৃষ্ট করতে ১৮ মাসে এক কোটি কর্মসংস্থান তৈরির প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
ঘোষণা বিলম্ব হলেও প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার জানান, বাস্তব চাহিদা অনুযায়ী স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, পরিবেশ ও কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি আধুনিক বাংলাদেশের রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরই আনুষ্ঠানিকভাবে ইশতেহার প্রকাশ করা হবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















