একজন মুখোশ পরা ব্যক্তি করাচির একটি অস্থায়ী বাজারে মানুষের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটছেন।
যখন একটি শাসনব্যবস্থার মূল্যায়ন কাঠামোগত রোগ নির্ণয়ের মতো দেখায়, তখন তা প্রমাণ করে যে পাকিস্তানের সংকট কেবল অর্থনৈতিক নয়—এর গভীরতা আরও বিস্তৃত। আইএমএফের ‘গভর্নেন্স অ্যান্ড করাপশন ডায়াগনস্টিক অ্যাসেসমেন্ট (GCDA)’ ঠিক এ কথাই বলে।
এটি পাকিস্তানের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সুসংগঠিত মূল্যায়ন—এবং কেন এসব প্রতিষ্ঠান ঘুরেফিরে অর্থনৈতিক, রাজস্ব ও শাসন সংক্রান্ত ব্যর্থতা তৈরি করে তার সরাসরি ব্যাখ্যা।
রিপোর্টের অধিকাংশ বিষয় পাকিস্তানিদের কাছে নতুন নয়। নতুন হলো—প্রথমবারের মতো আইএমএফ এসব শাসনগত দুর্বলতাকে “গভীরভাবে প্রোথিত, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সামষ্টিকভাবে গুরুতর” বলে ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা আর আড়ালের কোনো সমস্যা নয়; এটি এখন পাকিস্তান বারবার সংকটে পড়ার প্রধান কারণ।
এটি কোনো দেশের ওপর প্রকাশিত আইএমএফের সবচেয়ে কঠোর GCDA—যা পাকিস্তানের প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়ের ব্যাপ্তি ও গভীরতা প্রতিফলিত করে। যদিও রিপোর্টে বহু ক্ষেত্রে নরম শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে—যেমন “দুর্বলতা”, “ফাঁকফোকর”, “ঝুঁকি”, “চ্যালেঞ্জ” ইত্যাদি।
এই নরম শব্দগুলো বাস্তবতার কঠোরতা ঢেকে দিতে পারে। কারণ ভাষা কূটনৈতিক হলেও বিশ্লেষণ অত্যন্ত সংকেতবহ—রিপোর্ট পড়লে স্পষ্ট হয়, রাষ্ট্রের সক্ষমতা, স্থিতিশীলতা ও সততা দীর্ঘদিন ধরে ভেতর থেকে ক্ষয়প্রাপ্ত।

সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনা। আইএমএফ বলছে, পাকিস্তানের বাজেট প্রণয়ন ব্যবস্থায় “বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব”, “বিচ্ছিন্নতা” ও “খাপছাড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা” রয়েছে।
এই নরম শব্দগুলোর পেছনে লুকিয়ে আছে কঠিন সত্য—বাজেট বাস্তব ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, ব্যয় অনুমোদিত পরিকল্পনা থেকে নিয়মিত বিচ্যুত হয়, এবং রাজস্ব ঝুঁকি লুকানো থাকে বা দুর্বলভাবে তদারকি হয়।
মূলত দেশটি একটি নির্ভরযোগ্য আর্থিক দিকনির্দেশনা ছাড়াই চলছে। স্থিতিশীলতা সাময়িক হয়ে পড়ছে এবং প্রতিটি অর্থনৈতিক চক্রেই সংকট ফিরে আসছে, কারণ রাজস্ব ও অর্থ ব্যবস্থাপনার প্রতিষ্ঠানগুলো কাঠামোগতভাবে দুর্বল।
সরকারি ক্রয় বা প্রোকিউরমেন্ট ব্যবস্থাও উচ্চ দুর্নীতির ঝুঁকিতে রয়েছে। দুর্বল স্বচ্ছতা, নির্বাহী কর্তাদের অতিরিক্ত ক্ষমতা, সীমিত ই-প্রোকিউরমেন্ট এবং অনিয়মিত বিধি প্রয়োগের কারণে প্রকল্প ব্যয় বাড়ে, অবকাঠামোর মান কমে যায় এবং রেন্ট-সিকিংয়ের সুযোগ তৈরি হয়। সম্পদ-স্বল্প অর্থনীতিতে এমন অপচয় কেবল অকার্যকারিতা নয়—এটি উন্নয়নের বড় প্রতিবন্ধক।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান (SOE) সম্পর্কে GCDA-এর মূল্যায়নও উদ্বেগজনক। বহু SOE “ক্ষতিগ্রস্ত”, এবং তাদের শাসনব্যবস্থা “রাজনৈতিক প্রভাব”, স্বচ্ছতার অভাব ও দুর্বল তদারকির মধ্যে রয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক কয়েকটি উন্নতি—যেমন SOE অ্যাক্ট, রিপোর্টিং উন্নয়ন এবং কেন্দ্রীয় মনিটরিং ইউনিট—আইএমএফ স্বীকার করেছে।
এসব উন্নতি ইতিবাচক হলেও পর্যাপ্ত নয়। বিশেষ করে জ্বালানি খাতে SOE-গুলোর দুর্বল শাসনই সার্কুলার ডেট ও বিদ্যুৎখাতের ক্ষতির সবচেয়ে বড় কারণ।
রাজস্ব প্রশাসন সম্পর্কে আইএমএফ বলেছে—“দুর্বল আইন প্রয়োগ”, “বৃহৎ কর-ছাড়” এবং ছাড় প্রদানে “বিচার-বিবেচনার প্রভাব” রাজস্ব ব্যবস্থাকে কাঠামোগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

রিপোর্ট সরাসরি “এলিট ক্যাপচার” শব্দটি না বললেও বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয় যে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর সুবিধার্থেই বিশেষ ছাড় ও সুবিধা সৃষ্টি হয়। ফলে করের বোঝা পড়ে কেবল আনুগত্যশীল করদাতা ও আনুষ্ঠানিক খাতের ওপর।
এভাবে ন্যায্যতা ক্ষুণ্ন হয়, অনানুষ্ঠানিকতা বাড়ে এবং পাকিস্তান বরাবরই ঋণের ওপর নির্ভরশীল থাকে। দুর্নীতি দমনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।
আইএমএফ বলছে—এসব প্রতিষ্ঠানের “দায়িত্বের ওভারল্যাপ”, সমন্বয়ের অভাব, নীতির অসংগততা এবং তদন্ত ও বিচারকার্যে দুর্বলতা রয়েছে। দুর্নীতির ঝুঁকি শুধু রেন্ট-সিকিং থেকে নয়—অস্পষ্টতা, দুর্বল ব্যবস্থা এবং নির্বিচার ক্ষমতা থেকেও জন্মায়।
ফলাফল দাঁড়িয়েছে—অসংগত ও অকার্যকর জবাবদিহিতার কাঠামো, যা দুর্নীতি প্রতিরোধ বা সুনির্দিষ্ট ফল নিশ্চিত করতে ব্যর্থ।
সবচেয়ে গুরুতর অংশ হলো আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থা। রিপোর্টে বলা হয়েছে—বিচারব্যবস্থায় “দুর্নীতির ঝুঁকি”, “স্বাধীনতা ও সততার দুর্বলতা” এবং “প্রাতিষ্ঠানিক দখলদারিত্ব” বিদ্যমান। আদালতগুলো কার্যকর চুক্তি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়, মামলার জট জমে থাকে, বিলম্ব হয় এবং সিদ্ধান্তে অসামঞ্জস্য দেখা যায়।
ভাষা নরম হলেও ইঙ্গিত কঠোর—যে বিচারব্যবস্থা সম্পত্তির অধিকার বা চুক্তি সুরক্ষিত করতে পারে না, তা বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক রূপান্তরের পথে বড় বাধা। আইনশাসনে পাকিস্তানের নিচু অবস্থান তারই প্রতিফলন।
রিপোর্টে স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কাউন্সিল (SIFC) সম্পর্কেও মূল্যায়ন করা হয়েছে। সমন্বয় ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে উন্নতি স্বীকার করা হলেও আইএমএফ গভীর শাসনগত উদ্বেগ দেখিয়েছে। বিস্তৃত ক্ষমতা প্রাতিষ্ঠানিক বিভাজন তৈরি করছে, সংসদীয় নজরদারি কমছে, এবং আইনি সংশোধনের মাধ্যমে প্রদত্ত দায়মুক্তি জবাবদিহিতা দুর্বল করছে। রিপোর্ট বলছে—SIFC-কে মূল ব্যবস্থার সমান্তরালে না রেখে বিদ্যমান পিএফএম ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোর সঙ্গে একীভূত করা উচিত।
বার্তাটি স্পষ্ট: বিনিয়োগ দ্রুততর করার নামে শাসনব্যবস্থার মৌলিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না।

GCDA কয়েকটি অগ্রগতিও স্বীকার করেছে—বেনিফিশিয়াল ওনারশিপ স্বচ্ছতা, AML/CFT উন্নতি, রাজস্ব প্রক্রিয়ার ডিজিটাইজেশন, SOE রিপোর্টিং, মুদ্রানীতি শাসনের উন্নতি এবং বহু-বছর মেয়াদি বাজেট পরিকল্পনা। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ হলেও সামগ্রিক দুর্বলতা কাটাতে যথেষ্ট নয়।
GCDA-এর সবচেয়ে বড় অবদান হলো—হারিয়ে যাওয়া প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার হিসাব। আইএমএফ বলছে—দীর্ঘমেয়াদি শাসন দুর্বলতা পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ঠেকিয়ে রেখেছে এবং দুর্নীতির ঝুঁকি বেসরকারি খাতের বিকাশকে সীমিত করেছে।
গভর্নেন্স সংস্কার করলে পাঁচ বছরে পাকিস্তান জিডিপি ৫.০–৬.৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারে—এমন তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ দিয়েছে রিপোর্ট।
কেন এখনই পদক্ষেপ জরুরি? কারণ প্রতিটি দেরি প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষয়কে আরও গভীর করে।
বিশ্বাসযোগ্য শাসন ছাড়া স্থিতিশীলতা আসে না। আইনের শাসন ছাড়া বিনিয়োগ বাড়ে না। রাষ্ট্র যদি কেবল কিছু মানুষের জন্য কাজ করে—এমন ধারণা তৈরি হলে জনআস্থা ভেঙে পড়ে। গভর্নেন্স সংস্কার কোনো রাজনৈতিক স্লোগান নয়—এটাই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ভিত্তি।
আইএমএফের রিপোর্ট পাকিস্তানকে তিরস্কার নয়—সতর্ক করছে। নরম ভাষার আড়ালে বার্তাটি স্পষ্ট—পাকিস্তানের সংকট কোনো রহস্য নয়। ভাঙা শাসনব্যবস্থারই পূর্বানুমেয় ফল। আর পুনরুদ্ধারের পথও পূর্বানুমেয়—শাসনব্যবস্থা ঠিক করুন, ফলাফলও ঠিক হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে উল্টো পথও সম্ভব।
লেখকঃ পাকিস্তানের একটি শীর্ষস্থানীয় পেশাদার সেবাপ্রতিষ্ঠানের সাবেক ম্যানেজিং পার্টনার এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতে শাসনব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 






















