হংকং, ২৭ নভেম্বর—হংকং পুলিশ শহরের গত আট দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একটি নির্মাণ কোম্পানির তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে অবহেলার মাধ্যমে মানুষ হত্যা। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৮৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে, আর বহু মানুষ এখনও নিখোঁজ।
আগুনটি ওয়াং ফুক কোর্ট নামে উত্তরাঞ্চলীয় তাই পো জেলায় অবস্থিত একটি আট টাওয়ারের আবাসিক কমপ্লেক্সে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে জ্বলেছে। ভবনগুলো সংস্কারাধীন ছিল এবং চারদিকে বাঁশের স্ক্যাফোল্ডিং ও সবুজ জালের আবরণে ঢাকা ছিল। শুক্রবার ভোর নাগাদ দমকলকর্মীরা আগুন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
প্রধান ক্ষয়ক্ষতি ও উদ্ধার অভিযান
দমকল বিভাগের উপপরিচালক ডেরেক আর্মস্ট্রং চ্যান জানান, বেশিরভাগ মৃতদেহ দুটি উচ্চ-আবাসিক ব্লক থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। কিছু বাসিন্দা জীবিতও পাওয়া গেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। স্থানীয় গণমাধ্যমে জানানো হয়েছে, একটি ভবনের সিঁড়ি থেকে একজন জীবিতকে উদ্ধার করা হয়।
তীব্র উত্তাপ, ঘন ধোঁয়া, ধসে পড়া বাঁশের কাঠামো—সব মিলিয়ে উদ্ধারকাজ ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। চ্যান বলেন, “আমরা আশা করছি আগুন আজ রাতেই পুরোপুরি নেভানো যাবে। ভবনের ভেতরের তাপমাত্রা কমাতে পানি ছিটানো অব্যাহত থাকবে।”
এদিকে এক হতভাগিনী মা তার মেয়ের স্নাতক অনুষ্ঠানের ছবি হাতে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, “আমার মেয়ে আর তার বাবাকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমাদের ভবনে আগুন নেভানোর পানি পর্যন্ত ছিল না।”

গ্রেপ্তার ও তদন্ত: অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগ
পুলিশ জানিয়েছে, প্রেস্টিজ কনস্ট্রাকশন নামে একটি কোম্পানি ভবনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল। তারা দু’জন পরিচালক এবং একজন ইঞ্জিনিয়ারিং পরামর্শককে গ্রেপ্তার করেছে। অভিযোগ—তারা অনিরাপদ নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে বড় ধরনের অবহেলা করেছে, যা আগুন ছড়ানোর জন্য দায়ী।
পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট আইলিন চুং বলেন, “আমাদের বিশ্বাস, প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা মারাত্মক অবহেলা করেছেন, যার ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে।”
তদন্তের অংশ হিসেবে পুলিশ কোম্পানির অফিস থেকে দরপত্রের নথি, কর্মচারীদের তালিকা, ১৪টি কম্পিউটার এবং তিনটি মোবাইল ফোন জব্দ করেছে।
হংকংয়ের সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড (১৯৪৮-এর পর)
মধ্যরাতে নিশ্চিত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৩। এটি ১৯৪৮ সালের পরে শহরের সবচেয়ে প্রাণঘাতী অগ্নিকাণ্ড—যে বছর একটি ওয়্যারহাউসে আগুন লেগে ১৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
সরকার জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে ২৭৯ জনকে নিখোঁজ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, তবে সেই সংখ্যা ২৪ ঘণ্টা ধরে হালনাগাদ করা হয়নি।
পোপ লিও হংকংয়ের বিশপ কার্ডিনাল স্টিফেন চাওকে পাঠানো বার্তায় বলেন, তিনি নিহতদের পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি তাঁর আধ্যাত্মিক সহানুভূতি জানাচ্ছেন।
এদিকে হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী জন লি ঘোষণা করেছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৩০ কোটি হংকং ডলারের একটি জরুরি সহায়তা তহবিল গঠন করা হবে। শাওমি, এক্সপেং, জিলি, জ্যাক মায়ের দাতব্য ফাউন্ডেশন এবং টেনসেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহায়তা ঘোষণা করেছে।
বাসিন্দাদের আশ্রয় ও মানবিক পরিস্থিতি
দ্বিতীয় রাতেও অনেক বাসিন্দা নিকটবর্তী একটি শপিং মলে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নেন। অনেকে জানান, সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রগুলো যেন বেশি বিপর্যস্ত পরিবারদের জন্য খালি রাখা হয়।
বয়স্ক মানুষ থেকে শুরু করে শিশু—সবাই কম্বল জড়িয়ে, তাঁবু খাটিয়ে ম্যাকডোনাল্ডস ও নিকটবর্তী দোকানের সামনে রাত কাটিয়েছেন। স্বেচ্ছাসেবকেরা খাবার, পানি ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করেন।
এ কমপ্লেক্সে প্রায় ২,০০০ ইউনিটে ৪,৬০০-এর বেশি লোক বসবাস করতেন। হংকংয়ের দীর্ঘদিনের আবাসন সংকটের কারণে এ ধরনের আবাসিক প্রকল্প ছিল বহু মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য প্রধান ভরসা।
একটি ভবনে রক্ষণাবেক্ষণকারীরা জানালা সিল করতে ফোম সামগ্রী ব্যবহার করেছে বলেও পুলিশ তথ্য পেয়েছে, যা আগুনের ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে।
সরকার ধীরে ধীরে বাঁশের স্ক্যাফোল্ডিংয়ের পরিবর্তে নিরাপদ ধাতব স্ক্যাফোল্ডিং ব্যবহারের বিষয়টি বিবেচনা করছে।

চীনের প্রতিক্রিয়া ও রাজনৈতিক গুরুত্ব
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নির্দেশ দিয়েছেন, আগুন নেভাতে এবং ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। হংকং ও চীনা সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এই ঘটনার প্রতি গুরুত্ব প্রদর্শন করেছেন।
হংকংয়ে চড়া আবাসনমূল্য বহুদিন ধরে অসন্তোষের বড় কারণ। তাই এই বিপর্যয় রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বলে মনে করা হচ্ছে এবং সরকারের প্রতি ক্ষোভ বাড়াতে পারে।
নিখোঁজদের তালিকা ও গ্রেনফেল টাওয়ারের তুলনা
একটি অনলাইন অ্যাপে বিভিন্ন বাসিন্দার নিখোঁজের তথ্য যুক্ত করা হয়েছে—যেখানে লেখা আছে “৭০-এর দশকের এক বৃদ্ধা নিখোঁজ”, “এক ছেলে ও এক মেয়ে”, “রুফটপ: ৩৩ বছরের পুরুষ” ইত্যাদি।
একটি তথ্যের জায়গায় শুধু লেখা ছিল: “২৭ তলা, রুম ১: তিনি মারা গেছেন।”
এ তথ্যগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
এই আগুনের সঙ্গে লন্ডনের ২০১৭ সালের গ্রেনফেল টাওয়ার মর্মান্তিক ঘটনার তুলনা করা হচ্ছে, যেখানে জ্বলনযোগ্য ক্ল্যাডিং বসানোর কারণে ৭২ জন মারা যান।
তাই পো অঞ্চলটি ১৯৮৩ সাল থেকে আবাসিক এলাকা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এটি সরকারি সাবসিডি-যুক্ত গৃহ-মালিকানা প্রকল্পের আওতায় নির্মিত—যা মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য সহায়তা হিসেবে বিবেচিত।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















