হোয়াইট হাউজের কাছে আফগান বংশোদ্ভূত এক বন্দুকধারীর হামলায় নিহত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল গার্ড সদস্য সারাহ বেকস্ট্রম (২০)। গুরুতর আহত অবস্থায় জীবন-মৃত্যুর লড়াই করছেন তার সহকর্মী অ্যান্ড্রু উলফ (২৪)। ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে গভীর রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে আখ্যা দিয়ে সরাসরি বাইডেন আমলের অভিবাসন যাচাই প্রক্রিয়ার ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন এবং এর জেরে আশ্রয় ও অভিবাসন নীতিতে ব্যাপক পুনর্মূল্যায়নের নির্দেশ দিয়েছেন।
ঘটনার বিবরণ
বুধবার বিকেলে হোয়াইট হাউজের কাছে টহলরত দুই ন্যাশনাল গার্ড সদস্যকে লক্ষ্য করে হামলাকারী গুলি চালায়। তার হাতে ছিল শক্তিশালী .357 ম্যাগনাম রিভলভার। প্রথম গুলিতে একজন পড়ে গেলে তাকে দ্বিতীয়বার গুলি করা হয় এবং এরপর দ্বিতীয় সদস্যের ওপর একাধিক গুলি চালানো হয়। পরে গার্ড সদস্যদের পাল্টা গুলিতে হামলাকারী আহত হয়ে আটক হয়। বৃহস্পতিবার সারাহ বেকস্ট্রম তার আঘাতের কারণে মারা যান, আর অ্যান্ড্রু উলফ সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসাধীন।
হামলাকারীর পরিচয় ও পটভূমি
সন্দেহভাজন হামলাকারীর নাম রহমানুল্লাহ লাখানওয়াল (২৯)। তিনি আফগানিস্তানে সিআইএ সমর্থিত একটি ইউনিটে কাজ করতেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে আসেন ২০২১ সালে “অপারেশন অ্যালাইস ওয়েলকাম” কর্মসূচির আওতায়। তার স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে থাকেন। তদন্তে বেরিয়েছে যে তিনি গাড়ি চালিয়ে পুরো দেশ পাড়ি দিয়ে ওয়াশিংটনে আসেন এবং হামলার স্থান পর্যন্ত পৌঁছান। তার বাড়ি ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জায়গায় এফবিআই তল্লাশি চালিয়ে মোবাইল, ল্যাপটপ, আইপ্যাডসহ বহু ইলেকট্রনিক ডিভাইস জব্দ করেছে এবং পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তদন্তটি একটি সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদী হামলা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এফবিআই তদন্ত ও সরকারের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া
এফবিআই দেশজুড়ে বেশ কয়েকটি সম্পত্তিতে তল্লাশি চালিয়েছে এবং হামলাকারীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে ধারণা করা বিভিন্ন জায়গা তদন্তের আওতায় এনেছে। এফবিআই পরিচালক জানান, হামলা ছিল বর্বর ও পরিকল্পিত, তবে কোনো উদ্দেশ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি। ওয়াশিংটন মেট্রোপলিটন পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, লাখানওয়াল একাই হামলা চালিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। তাকে হাসপাতালে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে রাখা হয়েছে।
ট্রাম্পের অবস্থান ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হামলাকে “ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা” বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, বাইডেন আমলের অব্যবস্থাপনা এবং তড়িঘড়ি করা আফগান প্রত্যাহারের কারণে হাজারো আফগান নাগরিক “যাচাই-বাছাই ছাড়া” যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে এবং এই শিথিলতা জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নথি অনুযায়ী লাখানওয়াল আশ্রয় আবেদন করেছিলেন ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এবং তার আশ্রয় অনুমোদিত হয় ২০২৫ সালের ২৩ এপ্রিল—যখন ট্রাম্পই ক্ষমতায় ছিলেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ট্রাম্প বলেন, “যখন তাদের বিমানে আনা হয়, তখন তাদের বের করে দেওয়া খুব কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু এবার আমরা সবাইকে বের করে দেব।”
অভিবাসন নীতিতে জরুরি পরিবর্তনের ঘোষণা
হামলার পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রাম্প প্রশাসন আফগান নাগরিকদের সব ধরনের অভিবাসন আবেদন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছে। একই সঙ্গে বাইডেন আমলে অনুমোদিত সব আশ্রয় মামলা পুনর্মূল্যায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১৯টি দেশের নাগরিকদের দেওয়া সব গ্রিন কার্ডও পুনরায় যাচাই করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, লাখানওয়ালের কোনো অপরাধের ইতিহাস ছিল না।
অতীত সিআইএ সংযোগ
সিআইএ পরিচালক জন র্যাটক্লিফ নিশ্চিত করেছেন যে লাখানওয়াল আফগানিস্তানে সিআইএ-সমর্থিত স্থানীয় একটি ইউনিটে কাজ করতেন। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে এটি ছিল “জিরো ইউনিট”—একটি বিশেষ বাহিনী, যারা রাতের গোপন অভিযান এবং সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের জন্য প্রশিক্ষিত। তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর এই ইউনিটের সদস্যরা ব্যাপক ঝুঁকির মুখে পড়ায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের বড় সংখ্যায় পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছিল।
আইনগত পদক্ষেপের দিক
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি জানিয়েছেন যে হামলাকারীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী অভিযোগ আনা হবে এবং ন্যূনতম সাজা হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড চাওয়া হবে। তবে গার্ড সদস্য সারাহ বেকস্ট্রমের মৃত্যুর পর তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি মৃত্যুদণ্ড চাইবেন। হামলার পেছনের উদ্দেশ্য এখনো পরিষ্কার নয় এবং তদন্ত চলমান রয়েছে।

গার্ড সদস্যদের মিশন ও অতিরিক্ত মোতায়েন
হামলার শিকার দুই গার্ড সদস্যই ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ন্যাশনাল গার্ডের সদস্য ছিলেন। তারা ট্রাম্পের নির্দেশে ওয়াশিংটন ডিসিতে পরিচালিত একটি কঠোর আইন-শৃঙ্খলা মিশনে কর্মরত ছিলেন, যা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আদালতে চ্যালেঞ্জ করে। হামলার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাজধানীতে অতিরিক্ত ৫০০ সৈন্য মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন, যেখানে আগে থেকেই প্রায় ২,২০০ সৈন্য অবস্থান করছিল।
পরিবারের শোক ও মানবিক দিক
সারাহ বেকস্ট্রমের বাবা সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, “আমার মেয়ে স্বর্গে পাড়ি জমিয়েছে।” তিনি বলেন, পরিবারটি এক “অসহনীয় ট্র্যাজেডি”-র মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সন্দেহভাজন হামলাকারীর স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের বিষয়ে ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, পরিস্থিতি “খুবই মর্মান্তিক” এবং “সমগ্র প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা হচ্ছে।”
হোয়াইট হাউজের কাছে এই হামলা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা, আফগান পুনর্বাসন নীতি, আশ্রয় প্রক্রিয়া এবং দেশজুড়ে রাজনৈতিক অবস্থানের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তদন্ত এখনো চলছে এবং এর ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অভিবাসন ও জাতীয় নিরাপত্তা নীতিকে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাবিত করতে পারে। ঘটনাটি শুধু নীতিগত প্রশ্নই নয়, বরং মানবিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বহু স্তরের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
#যুক্তরাষ্ট্র #হোয়াইটহাউজ #ন্যাশনালগার্ড #সন্ত্রাসতদন্ত #ট্রাম্প #আফগানঅভিবাসন #অভিবাসননীতি #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















