০১:১৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৫
টেক্সাসে মুসলিম অধিকার সংস্থা ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণার জেরে তীব্র প্রতিক্রিয়া খরা কি উন্নত সিন্ধু সভ্যতার অবসান ঘটিয়েছিল? ৫.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস: শীতের কাঁপুনিতে শুরু হলো ডিসেম্বর প্রযুক্তি ও কৌশলগত অংশীদারত্বেই ভারতের রূপান্তরের চাবিকাঠি মিথেন খাদক অণুজীব: দূষণ কমানোর নতুন সম্ভাবনা কেন জিডিপি ‘গরম’ হলেও বাজার ‘ঠান্ডা’? রোহিত- বিরাটের পুরনো ছন্দে ফেরায় যোগাযোগের ঘাটতি দূর করাই এখন মূল চাবিকাঠি ইমরান খানের খোঁজ পাচ্ছে না পরিবার পাকিস্তান সরকারের নীরবতায় উদ্বেগ ও প্রশ্ন বিএনআরইউসিএসইউ নির্বাচনে ভোটার তালিকার গুরুতর ভুলে নির্বাচন স্থগিত চুয়াডাঙ্গায় যুবকের গলাকাটা লাশ উদ্ধার

অন্ধকার অতীতের আলোয় সত্যের অনুসন্ধান

লিয়া ইয়াপি তাঁর নতুন বই ‘ইন্ডিগনিটি: আ লাইফ রিইম্যাজিনড’-এ পারিবারিক ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায় অনুসন্ধান করেছেন, বিশেষ করে তাঁর দাদী লেমানকে ঘিরে ছড়িয়ে থাকা অভিযোগ, গুজব ও রাজনৈতিক সন্দেহের সত্যতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবির পর যখন তাঁর দাদীকে ফ্যাসিস্ট ও কমিউনিস্ট সহযোগী বলা হতে থাকে, তখনই ইয়াপি নথিভুক্ত ইতিহাসের কাছে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই বই সেই অনুসন্ধানের ফল।


এনভার হোজার শাসন ও আলবেনিয়ার বিচ্ছিন্নতা

১৯৪৫ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা কমিউনিস্ট শাসক এনভার হোজা আলবেনিয়াকে চরম বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন যখন ক্রুশ্চেভ স্ট্যালিন-নীতি থেকে সরে এসে মস্কোকে উন্মুক্ত করতে শুরু করেন। পরে চীন অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে হাঁটলে সেই সম্পর্কও তিনি ভেঙে দেন। অনেকেই বলেন, হোজা আলবেনিয়াকে একটি বলকানীয় উত্তর কোরিয়ায় পরিণত করেছিলেন, অথচ বাস্তবে তিনি কোরিয়ার কিম রাজবংশের চেয়েও বেশি বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিলেন।


পুঁজিবাদ নিয়ে ইয়াপির অবস্থান এবং সমালোচনা

২০২১ সালে প্রকাশিত তাঁর আগের বই ‘ফ্রি’ আলবেনিয়ার কমিউনিস্ট আমলের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ব্যাপক প্রশংসা পায়। কিন্তু বর্তমান আলবেনিয়ায় পুঁজিবাদকে মুক্তি ও আলোর প্রতীক হিসেবে দেখা হয়, আর ইয়াপির পুঁজিবাদ সমালোচনাকে অনেকেই ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে নেন। তাঁর বক্তব্যে কমিউনিজমকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান না করায় তিনি নিজ দেশের বহু পাঠকের কাছ থেকে ঘৃণা ও আক্রমণের বার্তা পেয়েছেন। তবুও তিনি নিজের রাজনৈতিক ও দার্শনিক অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন।


সত্যের খোঁজে সিগুরিমির আর্কাইভে যাত্রা

‘ইন্ডিগনিটি’ লেখার উদ্দেশ্যে ইয়াপি আলবেনিয়ার কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা সিগুরিমির আর্কাইভে যান, যা সোভিয়েত কেজিবি বা পূর্ব জার্মানির স্টাসির মতোই ক্ষমতাবান ছিল। এসব নথিপত্র সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ নাম তাঁর বিস্ময় জাগায়। ট্যাক্সিচালক তাঁকে বলেন, এই আর্কাইভ জনগণের জন্য খুলে দিতে সরকারের ২৫ বছর লেগেছে, যেন তারা অপেক্ষা করছিল সব গুপ্তচর মারা যাক, যাতে কাউকে আর বিচার করতে না হয়। ট্যাক্সিচালকের প্রশ্ন—তিনি সেখানে কাজের জন্য যাচ্ছেন নাকি আনন্দের জন্য?—এর উত্তরে ইয়াপি কৌতুক করে বলেন, “আনন্দের জন্য।”


লেমান: অনুসন্ধানের কেন্দ্রবিন্দু

এই বইতে ইয়াপির অনুসন্ধান তাঁর দাদী লেমানকে ঘিরে। লেমান ১৯১৮ সালে অটোমান সালোনিকায় জন্ম নেওয়া একটি ধনী আলবেনীয় পরিবারের মেয়ে। তাঁর জন্মস্থান গ্রিস হওয়ায় হোজা শাসন তাঁকে বিদেশি গুপ্তচর সন্দেহে বছরের পর বছর নজরদারিতে রাখে। তাঁর স্বামী আসলান — ইয়াপির দাদা — আলবেনিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাফের বেই ইয়াপির ছেলে, যাকে মুসোলিনির সহযোগী বলা হতো। আসলান ও এনভার হোজার মধ্যে ছাত্রজীবনের পরিচয় ছিল, তবুও তাঁকে পরে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে এক প্রহসনমূলক আদালতের রায়ে প্রায় ১৫ বছর কারাগারে কাটাতে হয়। এমনকি হোজা যখন প্যারিসে দরিদ্র অবস্থায় ছিলেন, তখন আসলান তাঁর বাড়িওয়ালার দেনা শোধ করতে চেয়েছিলেন। হোজা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেন এবং ভাড়া বাকি রেখেই গোপনে বাসা ছেড়ে পালিয়ে যান।


সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি ভাইরাল হওয়া এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া

‘ফ্রি’ প্রকাশের পর এক অচেনা ব্যক্তি সামাজিকমাধ্যমে লেমান ও আসলানের ১৯৪১ সালের হানিমুনের একটি ছবি পোস্ট করেন, যা ইতালির এক স্কি রিসর্টে তোলা হয়েছিল, তখন ইউরোপজুড়ে যুদ্ধ চলছিল। ছবিটি ভাইরাল হতে সময় লাগে না। মন্তব্যে কেউ কেউ তাঁকে ফ্যাসিস্ট সহযোগী, আবার কেউ কমিউনিস্ট গুপ্তচর বলে অভিযুক্ত করেন। এই অনলাইন আক্রমণে বিস্মিত ইয়াপি উপলব্ধি করেন যে তাঁর দাদীর সম্পর্কে একটি বিকৃত, ক্ষতিকর চরিত্রচিত্রণ তৈরি হচ্ছে। সত্য জানার তাগিদ থেকেই তিনি সিগুরিমির নথিতে ডুব দেন।


নথির ঘাটতি, স্মৃতির পুনর্গঠন এবং জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া

সিগুরিমির নথি খুব সুসংগঠিত ছিল না। ফলে ইয়াপিকে বহু জায়গায় কল্পনা, পারিবারিক স্মৃতি এবং অঞ্চলটির সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মিলিয়ে লেমানের জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় পুনর্গঠন করতে হয়। তিনি পাঠককে নিয়ে যান সালোনিকার বহু ভাষাভাষী ও বহু সংস্কৃতির পরিবেশে, যেখানে গ্রিক, তুর্কি, ইহুদি, আলবেনীয় এবং ইউরোপের ব্যবসায়ীরা মিলেমিশে থাকত। তিনি লিখেছেন লেমানের এক প্রপিতামহ অতিরিক্ত বাকলাভা খেয়ে মারা যাওয়ার গল্প, এক আত্মীয়ের জার্মান ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ের চাপে পড়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করার ঘটনা, ১৯৩০-এর তিরানার সংকীর্ণ আমলাতন্ত্র, এমনকি হোজার সঙ্গে লেমানের এক সাক্ষাৎ, যেখানে নাকি হোজার শ্বাসে কাঁচা পেঁয়াজের তীব্র গন্ধ ছিল। এসব বর্ণনা বলকান অঞ্চলের জাদুবাস্তবতার ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়।


অসম্পূর্ণ সত্যের প্রতিচ্ছবি

সব অনুসন্ধানের পরও লেমানের চরিত্র সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয় না। আর্কাইভে পাওয়া তথ্য নাটকীয় বা চমকপ্রদ কিছু নয়। তবুও এই অনুসন্ধান একধরনের ব্যক্তিগত ও দার্শনিক যাত্রা। ইয়াপির পরিবারের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, অনুসন্ধানের নেশা এবং পরিচয়জিজ্ঞাসা পাঠকের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। লেমান শেষ পর্যন্ত এক অপূর্ণ প্রতিচ্ছবি—মায়াবী, রহস্যময়, তবুও মানবিক—হিসেবে সামনে আসে।


‘ইন্ডিগনিটি’ কেবল একটি পারিবারিক ইতিহাস নয়; এটি রাজনৈতিক স্মৃতি, পরিচয়ের সংকট, এবং অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সংঘাত বোঝার এক গভীর প্রচেষ্টা। ইয়াপির অনুসন্ধান তাঁর দাদীর মর্যাদা রক্ষার পাশাপাশি পাঠককে ভাবায়—অতীতের সত্য কতটা অধরা, আর ইতিহাস কতবার আমাদের পরিচয়কে নতুনভাবে গড়ে তোলে।


# বই-সমালোচনা # আলবেনিয়া # ইতিহাস  #পারিবারিক-অনুসন্ধান  #সারাক্ষণ রিপোর্ট


জনপ্রিয় সংবাদ

টেক্সাসে মুসলিম অধিকার সংস্থা ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণার জেরে তীব্র প্রতিক্রিয়া

অন্ধকার অতীতের আলোয় সত্যের অনুসন্ধান

১২:০৮:০৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৫

লিয়া ইয়াপি তাঁর নতুন বই ‘ইন্ডিগনিটি: আ লাইফ রিইম্যাজিনড’-এ পারিবারিক ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায় অনুসন্ধান করেছেন, বিশেষ করে তাঁর দাদী লেমানকে ঘিরে ছড়িয়ে থাকা অভিযোগ, গুজব ও রাজনৈতিক সন্দেহের সত্যতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবির পর যখন তাঁর দাদীকে ফ্যাসিস্ট ও কমিউনিস্ট সহযোগী বলা হতে থাকে, তখনই ইয়াপি নথিভুক্ত ইতিহাসের কাছে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই বই সেই অনুসন্ধানের ফল।


এনভার হোজার শাসন ও আলবেনিয়ার বিচ্ছিন্নতা

১৯৪৫ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা কমিউনিস্ট শাসক এনভার হোজা আলবেনিয়াকে চরম বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন যখন ক্রুশ্চেভ স্ট্যালিন-নীতি থেকে সরে এসে মস্কোকে উন্মুক্ত করতে শুরু করেন। পরে চীন অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে হাঁটলে সেই সম্পর্কও তিনি ভেঙে দেন। অনেকেই বলেন, হোজা আলবেনিয়াকে একটি বলকানীয় উত্তর কোরিয়ায় পরিণত করেছিলেন, অথচ বাস্তবে তিনি কোরিয়ার কিম রাজবংশের চেয়েও বেশি বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিলেন।


পুঁজিবাদ নিয়ে ইয়াপির অবস্থান এবং সমালোচনা

২০২১ সালে প্রকাশিত তাঁর আগের বই ‘ফ্রি’ আলবেনিয়ার কমিউনিস্ট আমলের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ব্যাপক প্রশংসা পায়। কিন্তু বর্তমান আলবেনিয়ায় পুঁজিবাদকে মুক্তি ও আলোর প্রতীক হিসেবে দেখা হয়, আর ইয়াপির পুঁজিবাদ সমালোচনাকে অনেকেই ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে নেন। তাঁর বক্তব্যে কমিউনিজমকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান না করায় তিনি নিজ দেশের বহু পাঠকের কাছ থেকে ঘৃণা ও আক্রমণের বার্তা পেয়েছেন। তবুও তিনি নিজের রাজনৈতিক ও দার্শনিক অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন।


সত্যের খোঁজে সিগুরিমির আর্কাইভে যাত্রা

‘ইন্ডিগনিটি’ লেখার উদ্দেশ্যে ইয়াপি আলবেনিয়ার কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা সিগুরিমির আর্কাইভে যান, যা সোভিয়েত কেজিবি বা পূর্ব জার্মানির স্টাসির মতোই ক্ষমতাবান ছিল। এসব নথিপত্র সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ নাম তাঁর বিস্ময় জাগায়। ট্যাক্সিচালক তাঁকে বলেন, এই আর্কাইভ জনগণের জন্য খুলে দিতে সরকারের ২৫ বছর লেগেছে, যেন তারা অপেক্ষা করছিল সব গুপ্তচর মারা যাক, যাতে কাউকে আর বিচার করতে না হয়। ট্যাক্সিচালকের প্রশ্ন—তিনি সেখানে কাজের জন্য যাচ্ছেন নাকি আনন্দের জন্য?—এর উত্তরে ইয়াপি কৌতুক করে বলেন, “আনন্দের জন্য।”


লেমান: অনুসন্ধানের কেন্দ্রবিন্দু

এই বইতে ইয়াপির অনুসন্ধান তাঁর দাদী লেমানকে ঘিরে। লেমান ১৯১৮ সালে অটোমান সালোনিকায় জন্ম নেওয়া একটি ধনী আলবেনীয় পরিবারের মেয়ে। তাঁর জন্মস্থান গ্রিস হওয়ায় হোজা শাসন তাঁকে বিদেশি গুপ্তচর সন্দেহে বছরের পর বছর নজরদারিতে রাখে। তাঁর স্বামী আসলান — ইয়াপির দাদা — আলবেনিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাফের বেই ইয়াপির ছেলে, যাকে মুসোলিনির সহযোগী বলা হতো। আসলান ও এনভার হোজার মধ্যে ছাত্রজীবনের পরিচয় ছিল, তবুও তাঁকে পরে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে এক প্রহসনমূলক আদালতের রায়ে প্রায় ১৫ বছর কারাগারে কাটাতে হয়। এমনকি হোজা যখন প্যারিসে দরিদ্র অবস্থায় ছিলেন, তখন আসলান তাঁর বাড়িওয়ালার দেনা শোধ করতে চেয়েছিলেন। হোজা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেন এবং ভাড়া বাকি রেখেই গোপনে বাসা ছেড়ে পালিয়ে যান।


সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি ভাইরাল হওয়া এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া

‘ফ্রি’ প্রকাশের পর এক অচেনা ব্যক্তি সামাজিকমাধ্যমে লেমান ও আসলানের ১৯৪১ সালের হানিমুনের একটি ছবি পোস্ট করেন, যা ইতালির এক স্কি রিসর্টে তোলা হয়েছিল, তখন ইউরোপজুড়ে যুদ্ধ চলছিল। ছবিটি ভাইরাল হতে সময় লাগে না। মন্তব্যে কেউ কেউ তাঁকে ফ্যাসিস্ট সহযোগী, আবার কেউ কমিউনিস্ট গুপ্তচর বলে অভিযুক্ত করেন। এই অনলাইন আক্রমণে বিস্মিত ইয়াপি উপলব্ধি করেন যে তাঁর দাদীর সম্পর্কে একটি বিকৃত, ক্ষতিকর চরিত্রচিত্রণ তৈরি হচ্ছে। সত্য জানার তাগিদ থেকেই তিনি সিগুরিমির নথিতে ডুব দেন।


নথির ঘাটতি, স্মৃতির পুনর্গঠন এবং জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া

সিগুরিমির নথি খুব সুসংগঠিত ছিল না। ফলে ইয়াপিকে বহু জায়গায় কল্পনা, পারিবারিক স্মৃতি এবং অঞ্চলটির সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মিলিয়ে লেমানের জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় পুনর্গঠন করতে হয়। তিনি পাঠককে নিয়ে যান সালোনিকার বহু ভাষাভাষী ও বহু সংস্কৃতির পরিবেশে, যেখানে গ্রিক, তুর্কি, ইহুদি, আলবেনীয় এবং ইউরোপের ব্যবসায়ীরা মিলেমিশে থাকত। তিনি লিখেছেন লেমানের এক প্রপিতামহ অতিরিক্ত বাকলাভা খেয়ে মারা যাওয়ার গল্প, এক আত্মীয়ের জার্মান ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ের চাপে পড়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করার ঘটনা, ১৯৩০-এর তিরানার সংকীর্ণ আমলাতন্ত্র, এমনকি হোজার সঙ্গে লেমানের এক সাক্ষাৎ, যেখানে নাকি হোজার শ্বাসে কাঁচা পেঁয়াজের তীব্র গন্ধ ছিল। এসব বর্ণনা বলকান অঞ্চলের জাদুবাস্তবতার ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়।


অসম্পূর্ণ সত্যের প্রতিচ্ছবি

সব অনুসন্ধানের পরও লেমানের চরিত্র সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয় না। আর্কাইভে পাওয়া তথ্য নাটকীয় বা চমকপ্রদ কিছু নয়। তবুও এই অনুসন্ধান একধরনের ব্যক্তিগত ও দার্শনিক যাত্রা। ইয়াপির পরিবারের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, অনুসন্ধানের নেশা এবং পরিচয়জিজ্ঞাসা পাঠকের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। লেমান শেষ পর্যন্ত এক অপূর্ণ প্রতিচ্ছবি—মায়াবী, রহস্যময়, তবুও মানবিক—হিসেবে সামনে আসে।


‘ইন্ডিগনিটি’ কেবল একটি পারিবারিক ইতিহাস নয়; এটি রাজনৈতিক স্মৃতি, পরিচয়ের সংকট, এবং অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সংঘাত বোঝার এক গভীর প্রচেষ্টা। ইয়াপির অনুসন্ধান তাঁর দাদীর মর্যাদা রক্ষার পাশাপাশি পাঠককে ভাবায়—অতীতের সত্য কতটা অধরা, আর ইতিহাস কতবার আমাদের পরিচয়কে নতুনভাবে গড়ে তোলে।


# বই-সমালোচনা # আলবেনিয়া # ইতিহাস  #পারিবারিক-অনুসন্ধান  #সারাক্ষণ রিপোর্ট