পারমাণবিক পরীক্ষা নিষেধের নর্ম এখন চাপের মুখে
দীর্ঘ তিন দশক ধরে এক ধরনের অঘোষিত নিষেধাজ্ঞার ফলে বড় শক্তিগুলোর পারমাণবিক বিস্ফোরণমূলক পরীক্ষা বন্ধ ছিল। এখন সেই নীরব সমঝোতাই যেন কেঁপে উঠছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাম্প্রতিক বক্তব্যে। ওয়াশিংটন সম্ভাব্য ভূগর্ভস্থ পরীক্ষার ইঙ্গিত দিচ্ছে, আর মস্কো জানিয়ে দিচ্ছে—কেউ আগে গেলে তারা “সমপর্যায়ে” সাড়া দিতে প্রস্তুত। ঠান্ডা যুদ্ধের পর বহুদিন ধরে যে আলোচনায় পারমাণবিক পরীক্ষা প্রায় নিষিদ্ধ শব্দ ছিল, সেটিই আবার সামরিক ভাষ্য ও কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে।
এই উত্তেজনার কেন্দ্রে রয়েছে সর্বাত্মক পারমাণবিক পরীক্ষা-নিষেধ চুক্তি—সিটিবিটি। নব্বইয়ের দশকে হওয়া এই চুক্তি পৃথিবীর সব ধরনের পারমাণবিক বিস্ফোরণ বন্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে তৈরি হলেও এখনো তা আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়নি। কারণ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ, যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন, এখনো তা অনুমোদন করেনি। তবু এত বছর ধরে চুক্তিটি এক শক্ত রাজনৈতিক মানদণ্ড হিসেবে কাজ করেছে; বড় শক্তিগুলো পরীক্ষায় না যাওয়াকে এক প্রকার নৈতিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে মেনে নিয়েছে। সেই মানদণ্ড এখন আলোচনার টেবিলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।
বিশ্বজুড়ে নজরদারির ভরসা এবং সীমাবদ্ধতা
পরীক্ষা নিষেধ ব্যবস্থাটি শুধু কাগুজে প্রতিশ্রুতির ওপর দাঁড়িয়ে নেই। ভিয়েনাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা শত শত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে পৃথিবীর নানাপ্রান্তের ভূমিকম্পের কম্পন, সাগরের গভীরের তরঙ্গ, বাতাসের চাপের সূক্ষ্ম পরিবর্তন এবং আকাশে ভেসে থাকা তেজস্ক্রিয় কণার সিগন্যাল ধরে। এই নেটওয়ার্ক এক অর্থে পৃথিবীর জন্য বিশাল স্টেথোস্কোপ—গভীর ভূগর্ভেও বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটলে তার অভিঘাত সহজেই ধরা পড়ে। উত্তর কোরিয়ার প্রত্যেকটি স্বীকৃত পরীক্ষাই এই নজরদারিতে শনাক্ত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রচলিত আকারের পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক পরীক্ষা গোপন রাখা এখন প্রায় অসম্ভব। তবু পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই। খুবই কম ক্ষমতার হাইড্রোনিউক্লিয়ার পরীক্ষাগুলো, যেখানে বিস্ফোরণ সীমিত পরিসরে আটকে রাখা হয়, অনেক সময় প্রযুক্তিগতভাবে শনাক্ত করা কঠিন। বেশ কিছু পারমাণবিক শক্তি দেশে আগে থেকেই সাব-ক্রিটিক্যাল পরীক্ষার চল আছে; সেখানে বিস্ফোরণ আত্মনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে না, তাই চুক্তির ভাষায় তা সরাসরি নিষেধের আওতায় পড়ে না। প্রযুক্তিগত এই সূক্ষ্ম পার্থক্য সাধারণ নাগরিকের কাছে স্পষ্ট না হলেও রাজনৈতিক বার্তা却 আলাদা ও স্পর্শকাতর।

কৌশলগত হিসাব আর ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি
সমর্থকদের যুক্তি, যুক্তরাষ্ট্র নতুন কোনো পূর্ণাঙ্গ বিস্ফোরণ নয়, বরং সীমিত সিমুলেশনধর্মী পরীক্ষা চালানোর কথা ভাবছে—এতে পুরোনো ওয়ারহেডের নিরাপত্তা যাচাই সম্ভব হবে, নতুন নকশা বানানোর প্রয়োজন পড়বে না। সমালোচকদের দৃষ্টিতে, বাস্তব ফলাফলের চেয়ে গুরুত্ব বেশি সেই ইঙ্গিতের, যা বিশ্বকে পাঠানো হয়। একবার যদি অন্যতম বড় পারমাণবিক শক্তি প্রকাশ্যে পরীক্ষার পথে এগোতে শুরু করে, তবে চীন, ভারত বা পাকিস্তান—অনেকে নিজেদের প্রযুক্তি ঝালিয়ে নেওয়ার চাপ অনুভব করতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে সিটিবিটি বহির্ভূত রাষ্ট্রগুলোও সুযোগ দেখতে পারে উন্নত ও হালকা ওয়ারহেড তৈরির—যা আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রে সহজে বসানো যায়। এতে শুধু আঞ্চলিক নিরাপত্তা নয়, পুরো নন-প্রলিফারেশন কাঠামোই দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এত দিন ধরে যেসব দেশকে বোঝানো হয়েছে—বোমা না বানানোই তাদের স্বার্থে, তারা প্রশ্ন তুলতে পারে, যখন বড় শক্তিরাই নিয়ম বাঁকাচ্ছে, তখন শুধু ছোটদের ওপর এত চাপ কেন।
কূটনৈতিক পথ এবং স্মৃতির দায়
এ অবস্থায় অনেক দেশ নতুন করে রাজনৈতিক অঙ্গীকার গঠনের দাবি তুলছে, যেখানে সব পারমাণবিক শক্তি আবারও স্পষ্ট ভাষায় জানাবে—বিস্ফোরণমূলক পরীক্ষা থেকে তারা বিরত থাকবে। কেউ কেউ প্রস্তাব দিচ্ছেন, ভিয়েনার সংস্থাটি শুধু তথ্য সরবরাহ নয়, আলোচনা ও আস্থা তৈরির ক্ষেত্রেও সক্রিয় ভূমিকা নিক—কোন ধরনের পরীক্ষা কতটা গ্রহণযোগ্য, সেই সীমারেখা যেন প্রকাশ্যে আলোচনায় আসে। এতে অন্তত ভাষ্যকে ঠাণ্ডা করার সুযোগ তৈরি হতে পারে, যদিও দুই পরাশক্তির কৌশলগত দ্বন্দ্ব একদিনেই মিটবে না।
এদিকে প্রাক্তন পরীক্ষাস্থলগুলোর পাশে থাকা মানুষজন এই খবর আবারও ভারী মনে নিয়ে পড়ছেন। কাজাখস্তানের সেমিপালাটিনস্ক অঞ্চল, প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ কিংবা নেভাডার মরুভূমি—এসব জায়গায় এখনো ক্যানসার, বিকলাঙ্গতা আর ভূমি দূষণের ইতিহাস জেগে আছে। তাদের অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে দেয়, পারমাণবিক পরীক্ষা শুধু বিমূর্ত ভূ-রাজনীতি নয়; তা মাংস, হাঁড়ি, ফসল আর নদীর খুব কাছের বাস্তবতা। জনমতের এই স্মৃতি যদি যথেষ্ট শক্ত থাকে, তবে হয়তো নেতাদের জন্য পরীক্ষার পথে পা বাড়ানো রাজনৈতিকভাবে আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















