দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একযোগে মানবিক বিপর্যয়
টানা মুষলধারে বৃষ্টি আর পাহাড়ধসে ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন কাদামাটি আর ধ্বংসস্তূপে ঢেকে আছে। তিন দেশের মিলিত মৃত্যুর সংখ্যা ১,২০০–র ওপরে, নিখোঁজ আর আহতের সঠিক হিসাবও এখনও মেলেনি। নদী উপচে মুহূর্তে গ্রাস করেছে গ্রাম, বাজার আর গলি; বহু মানুষকে রাতভর ঘরের ছাদ আর গাছের ডালে ঝুলে থেকে বেঁচে থাকার লড়াই করতে হয়েছে। উদ্ধারকর্মীরা বলছেন, বিচ্ছিন্ন জনপদগুলোতে পৌঁছাতে পারলেই হয়তো মৃত্যুর নতুন পরিসংখ্যান সামনে আসবে।
ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি; পাহাড়ঘেরা উপত্যকায় তৈরি বসতি আর বাজারের ওপর দিয়ে হু-হু করে নেমে এসেছে বন্যার স্রোত। ভাঙা সেতু আর ধসে পড়া রাস্তার কারণে ত্রাণবাহী গাড়ি অনেক জায়গায় থেমে গেছে নদীর এপারে, সেখান থেকে নৌকা বা ছোট ট্রলারে করে এগোতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ আর মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় অসংখ্য পরিবার প্রিয়জনের খবর জানতেই পারছে না; উদ্ধার হওয়া লোকজনের তালিকাই এখন তথ্যের একমাত্র উৎস। উদ্ধার টিম জানাচ্ছে, অনেক মৃতদেহ মূল ঘটনার স্থান থেকে বহু দূরে ভাটির দিকে ভেসে গিয়ে আটকে আছে।

শ্রীলঙ্কায় সাইক্লোনগত ঝড় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতকে আরও ভয়াবহ করেছে। পাহাড়ি এলাকায় অনেকেই গভীর রাতে ঘুম ভেঙে দেখেছেন, ঘরের ভেতরেই কোমর সমান পানি আর কাদা ঢুকে পড়েছে। হাতে গোনা কয়েক মিনিটের মধ্যে বাচ্চা, বয়স্ক আর নথিপত্র নিয়ে নিরাপদ জায়গায় সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে হয়েছে সবাইকে। স্কুল, মন্দির ও মসজিদে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, কিন্তু প্রতিটি কক্ষে(placeholder) ঘুমাচ্ছেন ডজনখানেক মানুষ। একই স্থানে খাবার রান্না, চিকিৎসা আর শিশুদের সামলানো—সবই চালাতে হচ্ছে সীমিত সম্পদে।
থাইল্যান্ডে এখন মূল ধাক্কা সামলে ধীরে ধীরে পুনর্গঠনের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের বহু জেলায় ঘরবাড়ি, দোকান আর ধানক্ষেত একসঙ্গে ডুবে গেছে; প্রভাব পড়েছে কয়েক মিলিয়ন মানুষের জীবনে। রেল ও সড়কপথে যাতায়াত বন্ধ বা সীমিত; ছোট ছোট বিমানবন্দরে রানওয়ে থেকে এখনও পানি আর ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ চলছে। সরকার জরুরি নগদ সহায়তা আর খাদ্যপণ্য দিচ্ছে, তবে স্থানীয় প্রশাসনের হিসাব বলছে—অনেক পরিবার একই সঙ্গে ঘর, সঞ্চয় আর জীবিকা হারিয়েছে।
জলবায়ু ঝুঁকি আর বননিধনের দায়
এই তিন দেশের মানুষের কাছে আপাতত সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো—এত বড় বিপর্যয়ের জন্য কেবল প্রকৃতিকে দায়ী করা যায় কি না। বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই সতর্ক করে আসছেন, তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমণ্ডলে বেশি জলীয়বাষ্প জমে, যা একসময় অস্বাভাবিক ভারি বৃষ্টিতে নেমে আসে। সেই সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া ও অন্যান্য দেশে বছরের পর বছর ধরে পাহাড় কেটে বন ধ্বংস, নদীর তীর ভরাট আর নাজুক ঢালে ঘরবাড়ি গড়ে তোলার মতো কাজ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। স্থানীয় অনেকে বলছেন, যে পাহাড়ে একসময়ে ঘন বন ছিল, আজ সেখানে নগ্ন মাটি, আর সেখান থেকেই মৃত্তিকা ধসে নেমে এসেছে বসতির ওপর।
শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলছেন আগাম সতর্কতা আর সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে। অনেকের অভিযোগ, সতর্কবার্তা এসএসএমএসে পৌঁছেছে তখনই, যখন ঘরের বারান্দা পর্যন্ত পানি উঠেছে। কোথাও কোথাও আশ্রয়কেন্দ্র খোলার সিদ্ধান্তও এসেছে বেশ দেরিতে। সরকারগুলো এখন জরুরি পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে—গ্রাম পর্যায়ে সাইরেন ব্যবস্থা, স্পষ্ট অপসারণ রুট আর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নতুন নির্মাণ নিয়ন্ত্রণের মত উদ্যোগ আলোচনা হচ্ছে।

অর্থনৈতিক ক্ষতিও হবে দীর্ঘমেয়াদি। যে সব সেতু, মহাসড়ক আর বিদ্যুত্ সঞ্চালন লাইন ভেসে গেছে বা ধসে পড়েছে, সেগুলো আবার গড়ে তুলতে প্রচুর অর্থ লাগবে। কৃষকেরা অনেক জায়গায় নতুন করে জমি তৈরি করে বীজ রোপণ না করা পর্যন্ত কোনো আয়ের মুখ দেখবেন না। বীমা–সুবিধাহীন গ্রামীণ পরিবারের সামনে ঋণ নেওয়া ছাড়া বিকল্প কম; অর্থনীতিবিদদের মতে, যদি পুনর্গঠন পরিকল্পনায় টেকসই অবকাঠামো অগ্রাধিকার পায়, তবে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে, নইলে নিম্ন আয়ের মানুষ আরও কোণঠাসা হবে।
উদ্ধারকেন্দ্র আর স্কুলের বারান্দায় বসে থাকা মানুষের কাছে এসব নীতি–আলোচনা এখন অনেক দূরের বিষয়। কারও চিন্তা আজ কীভাবে ওষুধ মিলবে, কারও উদ্বেগ নিখোঁজ শিশুর খোঁজে কোথায়, কারও আবার মাথায় ঘুরছে ভবিষ্যতে ক্ষতিপূরণ পেতে কী কী কাগজ দরকার হবে। তবু ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকেও উঠে আসছে সহমর্মিতার ছোট ছোট দৃশ্য—পাড়া–প্রতিবেশীরা মিলে জেনারেটর কিনে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করছেন, অচেনা মানুষ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিনা পয়সায় গাড়ি দিচ্ছেন, ছাত্রছাত্রীরা আশ্রয়কেন্দ্রে বসে অন্য বাচ্চাদের পড়াশোনায় সাহায্য করছে। সবাই জানে, এই মৌসুমে এটাই হয়তো শেষ ঝড় নয়; তাই ক্ষত সেরে ওঠার আগেই নতুন প্রস্তুতির কথাও ভাবতে হচ্ছে।

সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















