রুশ আগ্রাসন থামানোর সংগ্রামে ইউক্রেন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছে। ২১ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিয়েভকে এমন একটি শান্তিচুক্তি মেনে নিতে চাপ দেন, যা বিপজ্জনকভাবে মস্কোর দাবির সঙ্গে মিলে যায়। এতে ইউক্রেনকে ভূখণ্ড ত্যাগ, সামরিক শক্তি কমানো এবং ন্যাটো সদস্যপদ প্রত্যাশা পরিত্যাগের শর্ত ছিল—যা মূলত আত্মসমর্পণের সমতুল্য।
জরুরি আলোচনার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও প্রস্তাবটিকে কিছুটা নিরপেক্ষ অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। জোর করে আত্মসমর্পণ করানোর তাৎক্ষণিক ঝুঁকি আপাতত কমলেও ইউক্রেন এখনো বিপদসীমায় রয়েছে।
ঘটনাটি আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছে যে ট্রাম্পের রাশিয়াকে তুষ্ট করার প্রবণতা তাঁর রাজনৈতিক প্রকৃতির গভীরে প্রোথিত—এবং তা পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুবই কম।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যদি রাশিয়ার প্রতি নরম অবস্থান নেয়, তবে চীন তাৎক্ষণিকভাবে সুযোগ দেখবে। এতে জাপানের মতো মার্কিন মিত্রদের প্রতি বেইজিংয়ের কঠোর আচরণের ঝুঁকি বাড়বে।
ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা ব্যক্তিদের বিশ্লেষণ তিনটি কারণকে সামনে আনে, যার ফলে তিনি রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে রাজি নন।
প্রথম কারণ হলো তাঁর বিশ্বাস—বিশ্ব ‘জঙ্গলের আইন’ দ্বারা পরিচালিত। যেখানে শক্তিই ন্যায়ের মাপকাঠি, আন্তর্জাতিক নীতি-নৈতিকতার কোনো গুরুত্ব নেই। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈশ্বিক রাজনীতি শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর আধিপত্যে পরিচালিত হয় এবং ছোট দেশগুলোকে তাদের কাছে নতিস্বীকার করতে হয়। রাশিয়ার পক্ষে সমঝোতা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা এই মানসিকতারই প্রতিফলন।
দ্বিতীয় কারণ হলো চরম বাস্তববাদ। ট্রাম্প সম্ভবত সত্যিই মনে করেন—জেতার সম্ভাবনা নেই এমন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার চেয়ে দ্রুত সমঝোতায় পৌঁছে পুনর্গঠনের দিকে এগোনো উত্তম। এটি তাঁর ব্যবসায়ী মানসিকতারই প্রতিধ্বনি—ক্ষতির বোঝা আরও বাড়ার আগে সমস্যাযুক্ত সম্পদ বেচে দেওয়া উত্তম।
এই লেনদেনমুখী যুক্তি আরও বিস্তৃত। ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মধ্যেই রয়েছে—যা রিয়েল এস্টেট ও জ্বালানি খাতে সম্ভাব্য ব্যবসায়িক সুযোগ খুলে দিতে পারে।
তৃতীয় কারণ তাঁর বিশাল আত্মমুগ্ধতা। তিনি হয়তো তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি—যুদ্ধবিরতি অর্জন—পূরণ করতে এবং শেষ পর্যন্ত নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে আগ্রহী।
যদি এই পন্থা সত্যিই বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা বাড়াত, তবে তা বিবেচনা করা যেত। কিন্তু বাস্তবে তাঁর এই ‘রাশিয়া-তোষণ সিনড্রোম’ বিশ্বকে আরও অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেন আক্রমণকে উপেক্ষা করে, তবে রাশিয়া ইউরোপসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক উসকানি আরও বাড়াবে। শেষ পর্যন্ত ‘শান্তিদূত’ হওয়ার ট্রাম্পের আকাঙ্ক্ষাই সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এর ঝুঁকি ইতোমধ্যে বাড়ছে। ২০–২১ নভেম্বর আমি অংশ নিই ভিলনিয়ুস ফোরামে—লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়ুসে অনুষ্ঠিত বার্ষিক নিরাপত্তা সম্মেলনে। রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করা এই দেশটি হুমকির মুখে থাকা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সেখানে নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞদের প্রধান উদ্বেগ ছিল মস্কোর বাড়তে থাকা সামরিক উসকানি। রাশিয়ার যুদ্ধের ঠিক নিচের স্তরে থাকা ‘গ্রে জোন’ হামলা বেড়েছে—লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, পোল্যান্ড ও নর্ডিক অঞ্চলকে লক্ষ্য করে।
লিথুয়ানিয়ার প্রেসিডেন্ট গিতানাস নাউসেদা উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, আমাদের আশপাশের স্বৈরাচারী শাসনগুলো নতুন নতুন গ্রে-জোন কৌশল উদ্ভাবন করছে। রুশ ড্রোন ও বেলারুশের বেলুন আমাদের আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ, বাল্টিক সাগরে ছায়া নৌবহরের মাধ্যমে সাগরতলের অবকাঠামো বিঘ্নিত করা, আর সাম্প্রতিক পোলিশ রেললাইন ধ্বংস—এগুলো এলোমেলো ঘটনা নয়; বরং পরিকল্পিত ও ক্রমবর্ধমান তৎপরতা।
লিথুয়ানিয়া একটি আন্তঃসংস্থাভিত্তিক ন্যাশনাল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার গঠন করেছে, যা এসব হুমকি ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করছে। সংস্থার প্রধান ভিলমান্তাস ভিটকাউস্কাস জানান, গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়ার কার্যক্রম আরও বেড়েছে। সাইবার হামলা ও তথ্যযুদ্ধ ছাড়িয়ে এখন তারা মানুষের জীবন ও অবকাঠামো লক্ষ্য করে তৎপরতা চালাচ্ছে।

তিনি বলেন, লিথুয়ানিয়ায় একাধিক হত্যাচেষ্টা, লজিস্টিক স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ এবং বিমান কার্গোতে বিস্ফোরক গোপনে রাখা হয়েছিল। রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে আসা ড্রোন ও বেলুনের মাধ্যমে বিমান চলাচলে বিঘ্নও বেড়েছে। এ বছর লিথুয়ানিয়ার বিমানবন্দর ১৮ বার বন্ধ হয়েছে—অর্ধেক ড্রোন এবং বাকিগুলো বেলুন অনুপ্রবেশের কারণে।
আমি নিজে এই হুমকি অনুভব করেছি। ২৩ নভেম্বর রাতে ভিলনিয়ুস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতির সময় বেলারুশ থেকে আসা বেলুন অনুপ্রবেশে রানওয়ে বন্ধ হয়ে যায়। আমাকে পুরো রাত বিমানবন্দরে অবস্থান করতে হয় এবং ১৬ ঘণ্টা পর উড়তে পারি। এই ক্লান্তিকর অভিজ্ঞতাই আসলে হামলাকারীর উদ্দেশ্য—মনোবল ভেঙে দেওয়া।
রাশিয়া জানে যে সে সামরিক শক্তিতে ন্যাটোর সমকক্ষ নয়। তাই তাদের কৌশল হলো গোটা ইউরোপজুড়ে নাশকতা, ভীতি ও অরাজকতা ছড়িয়ে দেওয়া—যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় ও ক্লান্তি তৈরি হয় এবং ধীরে ধীরে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ইচ্ছা দুর্বল হয়ে পড়ে।
এশিয়ায় চীন একইভাবে সামরিক মহড়া ও কঠোর তৎপরতা বাড়াচ্ছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি তাইওয়ান পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করার পর বেইজিং জাপানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়েছে।
ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও ইউরোপের সঙ্গে মিল রয়েছে। চীন নিঃসন্দেহে ট্রাম্পের প্রবণতা বুঝে গেছে—তিনি শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর লেনদেনভিত্তিক সম্পর্ককে মূল্য দেন; আইন, নীতি বা ঐতিহ্যগত জোটকে নয়। তাই বেইজিং মনে করছে, জাপানের মতো মার্কিন মিত্রদের ওপর চাপ বাড়ালেও ট্রাম্প কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না।
২৪ নভেম্বর ট্রাম্প–শি ফোনালাপের পর চীনের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়েছে। প্রমাণ নেই যে ট্রাম্প তাইওয়ান প্রসঙ্গে তাকাইচির অবস্থান দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছেন বা জাপানের ওপর চাপ বন্ধ করতে শিকে বলেছেন।
এমনকি এ বছরের গ্রীষ্মেও চীন দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসন নিয়ে অনিশ্চিত ছিল। জাপানি কর্মকর্তাদের মতে, সম্পর্কের উত্তেজনা কমাতে চীনা কর্মকর্তারা নীরবে নীতিগত আলোচনায় আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সেই হিসাব বদলে গেছে।
ট্রাম্পের যুদ্ধ বন্ধ ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকানোর প্রতিশ্রুতি প্রশংসনীয়। কিন্তু শান্তি রাশিয়া বা চীনকে তুষ্ট করে আনা যায় না। ইউরোপের বর্তমান পরিস্থিতি সেই বিপজ্জনক পথের সুস্পষ্ট সতর্কবার্তা।
হিরোইুকি আকিতা 


















