চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) ২০তম কেন্দ্রীয় কমিটির চতুর্থ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন এ বছর অক্টোবরে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সাধারণ সম্পাদক শি জিনপিং বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কোনো সাময়িক ব্যবস্থা নয়, বরং কৌশলগত পদক্ষেপ। তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিশেষ করে ভোগব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে চাহিদার ঘাটতি দূর করতে হবে এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পার্টির কিউএস থিয়োরি ম্যাগাজিন একে বর্ণনা করেছে “উচ্চমানের উন্নয়ন কাঠামো গঠনে অপরিসীম প্রেরণা সৃষ্টির” লক্ষ্য হিসেবে।
তবে উচ্চমানের উন্নয়নের এই প্রচেষ্টা নতুন চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে। বিশেষ করে বাণিজ্যিক বিরোধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে কারখানায় রোবট ব্যবহারের প্রসার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর প্রযুক্তির বিকাশ উৎপাদন ও সেবা খাতে চাকরির স্থিতি কমিয়ে দিচ্ছে। এতে ভোগব্যয় বাড়ানো এবং জীবনমান উন্নয়নের চীনের লক্ষ্য আরও জটিল হয়ে উঠছে।
চায়না অ্যাকাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের (সিএএসএস) একাডেমিক কমিটির সদস্য কাই ফাং বেইজিং ডেইলিতে লিখেছেন, প্রচলিতভাবে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রকৃত দরিদ্রদের সাহায্য করে, কিন্তু নির্ভরতার সংস্কৃতি তৈরি হয় না—এটাই ছিল নীতি। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুগে এ মডেলের ভিত্তিই বদলে যাচ্ছে। এআই–চালিত স্বয়ংক্রিয়তার প্রভাবে শ্রমিক, চাকরি ও সামাজিক সুরক্ষার সম্পর্ক দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং নতুন নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। তার মতে, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় বড় রকমের কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার।
এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্যেই চীন নতুন সুযোগও খুঁজে পাচ্ছে—যেমন প্রোগ্রামেবল ডিজিটাল মুদ্রা। ডিজিটাল কারেন্সি বা ই-সিএনওয়াই, যা চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইস্যু করে, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকা, নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবার তালিকা এবং নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ব্যবহারের জন্য প্রোগ্রাম করা যায়। যদি সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়িয়ে অনিয়মিত আয়ের মানুষদেরও এতে আনা হয়, তবে এই ডিজিটাল মুদ্রা লক্ষ্যভিত্তিক ভোগব্যয় নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সময়সীমার মধ্যে খরচ না করলে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার মতোভাবে প্রোগ্রাম করলে অপ্রয়োজনীয় সঞ্চয়ের প্রবণতা কমে যাবে।

এক শতাব্দী আগে আর্জেন্টাইন-জার্মান অর্থনীতিবিদ সিলভিও গেসেল তার বই ‘দ্য ন্যাচারাল ইকনমিক অর্ডার’–এ লিখেছিলেন, অর্থ যেন পচে যাওয়া আলু বা মরিচা ধরা লোহার মতো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়—তাহলেই মন্দা প্রতিরোধ করা সম্ভব। তার মতে, অর্থ ধরে রাখার খরচ থাকলে মানুষ সেটি আটকে রাখবে না। আজ চীনে ই-সিএনওয়াই মোট প্রচলিত মুদ্রার মাত্র ১% এরও কম। কিন্তু এটি সামাজিক সুরক্ষা ও ভোগ প্রবৃদ্ধির কৌশলগত উপকরণ হয়ে উঠলে এর ব্যবহার দ্রুত বাড়তে পারে।
কাই ফাংয়ের লেখা বলে দেয় যে চীন সর্বজনীন মৌলিক আয়ের (ইউবিআই) পথ ধরছে না, যেখানে প্রত্যেকে মাসে প্রায় ৩,০০০ ইউয়ান পেতে পারে বলে কিছু বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছিলেন। বরং অনিশ্চিত আয়ের নতুন শ্রেণি, শিশু জন্ম দেওয়া নতুন অভিভাবক, অথবা সংকটে থাকা পেনশনভোগীদের মতো বিশেষ গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে সহায়তা দেওয়া হতে পারে। ই-সিএনওয়াই–ভিত্তিক এই সহায়তা খরচ কম, সরাসরি বিতরণযোগ্য এবং অব্যবহৃত থাকলে অদৃশ্য হয়ে যায়—অর্থাৎ রাজস্ব ঝুঁকিও কম।
ই-সিএনওয়াই–নির্ভর সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা চীনকে নজিরবিহীন আর্থিক কার্যকারিতা দিতে পারে। প্রচলিত কুপনের মতো অজনপ্রিয় বা বিতরণে জটিল নয়; বরং রিয়েল-টাইম ট্রেসিং ও এআই বিশ্লেষণের মাধ্যমে এটি আরও লক্ষ্যভিত্তিক হতে পারে।
চতুর্থ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন ও কাই ফাংয়ের বিশ্লেষণ দেখায় যে চীনের প্রবৃদ্ধির সীমাবদ্ধতা এখন সরবরাহ নয়, চাহিদা। ফলে নীতিনির্ধারকেরা সরবরাহ–পক্ষের উদ্ভাবন—ই-সিএনওয়াই—ব্যবহার করে চাহিদা বাড়ানোর নতুন যুগ তৈরি করতে পারেন। এখন পর্যন্ত সাধারণ ভোক্তারা ই-সিএনওয়াই গ্রহণে ধীর। কিন্তু সিস্টেমেটিক আর্থিক সহায়তা, যা গেসেল–এর ভাষায় ‘ফ্রাইগেল্ড’ বা ‘ফ্রি মানি’র একটি রূপ—অব্যবহৃত হলে পুরোপুরি শূন্য হয়ে যায়—এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে পারে এবং একই সঙ্গে ভোগব্যয় বাড়িয়ে আয়ের অনিশ্চয়তা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
#অর্থনীতি চীন ডিজিটাল_মুদ্রা ইসিএনওয়াই সামাজিক_সুরক্ষা
লরেন জনস্টন 


















