০৩:১৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫
কর্মক্ষেত্রে নতুন আচরণবিধি: হাইব্রিড কাজ, অনলাইন মিটিং আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বদলাচ্ছে অফিস শিষ্টাচার সমালোচনায় ট্রাম্প প্রশাসন: দাসপ্রথা বিলুপ্তি ও নাগরিক অধিকার স্মরণে কয়েন পরিকল্পনা বাতিল ঢাকায় ডিএনসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যু ৩ প্রশ্নের মুখে লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল প্রকল্প – কী আছে লালদিয়ার নন-ডিসক্লোজর থলেতে? ট্রাম্পের অর্থনীতি নিয়ে বিভক্ত পেনসিলভানিয়া: বেড়েই চলেছে ‘সহনশীলতার পরীক্ষা’ রাশিয়ার আকাশঘাঁটিতে গোপন ড্রোন হামলা: কিয়েভের দুঃসাহসী ‘মাকড়সার জাল’ অভিযান উন্মোচিত জাপানের ‘গ্রিন মাস্টার প্ল্যান’ মধ্য এশিয়ার শক্তি ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে অস্ট্রেলিয়ায় কড়াকড়ি শুরু: সোশ্যাল মিডিয়ায় ষোলো বছরের নিচে নিষেধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৭২) আমেরিকায় এইচ–১বি ভিসায় বাড়ছে নজরদারি, ভারতীয়দের সময় পরিবর্তন শুরু

৩ প্রশ্নের মুখে লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল প্রকল্প – কী আছে লালদিয়ার নন-ডিসক্লোজর থলেতে?

আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আশা করা যাচ্ছে, ওই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে নতুন রাজনৈতিক সরকার দেশের শাসনভার গ্রহণ করবে। সেক্ষেত্রে অন্তবর্তী সরকারের হাতে আর বেশি সময় নেই। অথচ শেষ সময়ে এসে সরকার চট্টগ্রামের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্প এবং ঢাকার কাছে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দুটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তি করেছে। চুক্তির বিষয়টি সামনে আসার পর এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। এমন প্রশ্নও সামনে এসেছে দীর্ঘ মেয়াদী এই চুক্তি করার ক্ষেত্রে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার তাড়াহুড়ো করলো কিনা ?

চুক্তি অনুসারে, লালদিয়া টার্মিনালে ত্রিশ বছর এবং পানগাঁওয়ে বাইশ বছর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। দীর্ঘমেয়াদী এবং স্পর্শকাতর এই সিদ্ধান্ত নিতে স্বল্প মেয়াদে দায়িত্বে থাকা অন্তর্র্বতী সরকার কেন তাড়াহুড়ো করলো, এমন প্রশ্ন তুলেছেন বন্দর ব্যবহারকারী এবং বিশেষজ্ঞদের অনেকে। চুক্তিগুলো যদি দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই করা হয় তাহলে সেগুলো প্রকাশ করারও দাবি জানিয়েছেন তারা। যদিও জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের।

বিশেষ করে, চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে পিছু ছাড়ছে না লালদিয়া টার্মিনাল। রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজ কেউই বাদ নেই। দেশে সমুদ্র বন্দরের দক্ষতা বাড়াতে বিদেশী বিনিয়োগ কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে অস্বচ্ছতা, অন্যায় অবিচার, বৈষম্য নির্মূলের ঝান্ডা নিয়ে দায়িত্ব আসা অন্তবর্তী সরকারের চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া নিয়ে। এখন দেখা যাচ্ছে নন-ডিসক্লোজার দোহাই দিয়ে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় স্বাক্ষর করা চুক্তির থলের বিড়াল একের পর এক বেরিয়ে আসছে। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় স্বাক্ষরিত এই চুক্তিটি যে একেবারেই বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকুলে নয় তা জাতির সামনে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।

দেশের বন্দর ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম ও ধীরগতির অভিযোগ নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই এই সমস্যা সমাধানে ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বন্দর বিষয়ে বিদেশি কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।

২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব সৌদি আরবের একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। বিদেশিদের হাতে বন্দরের দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে পড়েছিল সরকার।

বিগত আওয়ামী লীগ আমলে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল বা এনসিটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দুবাইভিত্তিক একটি বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো, সেটিই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আবার গতি পায়।

দেশের অন্তত পাঁচটি টার্মিনালে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে দেওয়ার আলোচনা সামনে এলে এ নিয়ে প্রতিবাদও জানায় বেশ কয়েকটি সংগঠন। এমন প্রেক্ষাপটে লালদিয়া এবং পানগাঁও টার্মিনালের দায়িত্ব পালনে দুই বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। এর পর থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। প্রতিবাদ জানিয়েছেন বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠনও।

চুক্তির ডিসক্লোজার তথ্য অনুযায়ী, কর্ণফুলী মোহনার অদূরে গুপ্তবাঁকের ঠিক আগেই নির্মাণ করা হবে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল। এই অবস্থানটি পণ্যবাহী জাহাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। বন্দর বিশেষজ্ঞদের বলছেন, এ অবস্থানগত সুবিধা লালদিয়াকে চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে ব্যস্ত টার্মিনালে পরিণত করবে। সরকার লালদিয়ার ক্ষেত্রে বছরে ১০ লাখ টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট (টিইইউ) কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের কথা বললেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। এই বন্দরে অপারেশন শুরু হলে এর পরিমাণ আরো বেশি হবে বলে ধারণা করছেন বন্দর বিশেষজ্ঞরা।

দ্বিতীয়ত: সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) ৩৩ বছরের কাঠামো ঘোষণা করা হলেও কার্যত ৪৮ বছরের নির্মাণ-পরিচালনার সুবিধা পাবে ডেনমার্কের এপি-মোলার মায়ের্সক গ্রæপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস। সমুদ্রে পণ্য পরিবহনে বর্তমানে মায়ের্সকের আধিপত্য থাকায় টার্মিনালটি চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের মোট কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের বড় অংশই লালদিয়ায় সম্পন্ন হবে। কারণ, এপিএম টার্মিনালসের অনুক‚লে নিশ্চিত হয়েছে অত্যন্ত সুবিধাজনক আর্থিক কাঠামো।

তৃতীয়ত: বছরে নয় লাখ টিইইউ ছাড়ালেই বাড়তি কনটেইনারে চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব কমে টিইইউ-প্রতি মাত্র ১০ ডলারে নেমে আসবে। ফলে মাত্র এক দশকের মধ্যেই বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে এপিএম টার্মিনালসের পক্ষে। অপারেটরের পক্ষে এতসব নিশ্চয়তার পরও নেগোসিয়েশনে সমপর্যায়ের কিংবা কাছাকাছি আর্থিক-কৌশলগত সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেনি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)।

এ চুক্তির মুল থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে নন-ডিসক্লোজার তথ্য বিশ্লেষণে। সেখানে দেখা যায়, এপিএম টার্মিনালস সবচেয়ে সুবিধা পাবে তাদের শিপিং লাইননির্ভর ব্যবসার কারণে। তাদের নিজস্ব শিপিং লাইন ও কনটেইনার রয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে তাদের ব্যবসাও সবার চেয়ে এগিয়ে। তাই এ চুক্তি এপিএম টার্মিনালসকে একটি ‘গ্যারান্টেড কাস্টমার বেজ’ নিরাপদ ব্যবসার নিশ্চয়তা দিয়েছে। এটি এমন এক সুবিধা যা সাধারণত অন্য কোনো অপারেটর বাংলাদেশে টার্মিনাল পরিচালনায় পাবে না। লালদিয়া টার্মিনাল চালু হবে ২০৩০ সাল নাগাদ। কিন্তু তার আগেই এ নিশ্চয়তা লালদিয়াকে তাদের ‘লো-রিস্ক, হাই-রিটার্ন’ মডেলে পরিণত করেছে। এখানে সময় যত গড়াবে লালদিয়ার আয় তত বাড়বে, অথচ চট্টগ্রাম বন্দর পাবে ‘সেট ফর্মুলা’ অনুযায়ী সীমিত রাজস্ব।

বাংলাদেশের বন্দর পরিচালনায় অন্তবর্তী সরকার এ পর্যন্ত বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে তিনটি চুক্তি করেছে। প্রথম চুক্তি করে গত বছরের (২০২৪) জুনে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালস ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই) এর সঙ্গে। এই কোম্পানি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনায় যুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো ঢাকার অদূরে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালে কাজ করবে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেডলগ। এটি অবশ্য একটি নৌ টার্মিনাল। আর সর্বশেষ বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরে টার্মিনাল পরিচালনায় যুক্ত হতে যাওয়া দ্বিতীয় বিদেশী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ডেনমার্কভিত্তিক এপিএম টার্মিনালস।

এখানে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল এবং লালদিয়া টার্মিনাল এ দুটি সমুদ্রবন্দর। ফলে এই দুই চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে লালদিয়ার নন-ডিসক্লোজার অংশের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। এ নিয়ে একটি জাতীয় গণমাধ্যমেও একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মুলত সেখান থেকেই দুই চুক্তির বৈপরিত্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে গতি আনতে এবং সময় ও দুর্নীতি বন্ধ করে খরচ কমাতে বন্দর পরিচালনায় দক্ষতা বৃদ্ধি জরুরি। এতে বিদেশী প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়ে দেশ লাভবান হলে কারও কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু আপত্তি সেখানেই উঠে চুক্তির ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ যদি ক্ষুণœ হয়।

কিন্তু দুই চুক্তির বিশ্লেষণে দেখা যায়, পতেঙ্গার পিসিটি ও লালদিয়া টার্মিনালের চুক্তিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নেগোসিয়েশন কৌশলে সুস্পষ্ট বৈপরীত্য রয়েছে। পিসিটিতে চবক শক্ত অবস্থান নিয়ে আরএসজিটিআইয়ের সঙ্গে একটি ‘উইন-উইন’ কাঠামো নিশ্চিত করতে পেরেছে। কিন্তু লালদিয়ার ক্ষেত্রে ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে করা চুক্তিতে সেই দৃঢ়তা দেখা যায়নি। রাজস্ব আহরণ ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থে চবকের চেয়ে বেশি সুবিধা গেছে এপিএম টার্মিনালসের পক্ষে। লালদিয়া চুক্তির আর্থিক কাঠামো, পে-ব্যাক সময়, বাজার-প্রভাব ও টার্মিনালের অবস্থানগত সুবিধা মিলিয়ে এপিএম টার্মিনালস শক্তিশালী ভবিষ্যৎ বাজার নিশ্চিত করেছে, যেখানে তুলনামূলকভাবে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে চবক।

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে (পিসিটি) প্রতি টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের বিপরীতে চবক বর্তমানে পায় ১৮ ডলার। অন্যদিকে লালদিয়া টার্মিনাল নিয়ে সরকারি প্রচারণায় বলা হয়েছে, প্রথম ¯ø্যাবে বছরে আট লাখ টিইইউ পর্যন্ত হ্যান্ডলিং হলে বন্দর পাবে ২১ ডলার (টিইইউ-প্রতি), দ্বিতীয় ¯ø্যাবে আট-নয় লাখ টিইইউ পর্যন্ত হ্যান্ডলিং হলে চবক পাবে ২২ ডলার।

তবে চুক্তির নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট (এনডিএ) পর্যালোচনায় আরও একটি ¯ø্যাবের তথ্য পাওয়া যায়, যা সরকারি প্রচারণায় একবারের জন্যও উল্লেখ করা হয়নি। তৃতীয় এ ¯ø্যাবে স্পষ্টভাবে বলা আছে, এপিএম টার্মিনালস বছরে নয় লাখ টিইইউর বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করলেই চবক বাড়তি প্রতি টিইইউর বিপরীতে পাবে মাত্র ১০ ডলার। অর্থাৎ লালদিয়ায় কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ বার্ষিক নয় লাখ টিইইউ পার হলেই ¯ø্যাব অনুযায়ী বন্দরের রাজস্ব কমতে থাকবে। টার্মিনালের অবস্থানগত সুবিধা, জাহাজ আগমনের প্রবৃদ্ধি ও এপিএম টার্মিনালসের বাজার নিয়ন্ত্রণ বিবেচনায় তৃতীয় ¯ø্যাব কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে চুক্তিতে তৃতীয় ¯ø্যাবের এ কাঠামো চবকের দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক স্বার্থের জন্য লাভজনক হবে না।

এছাড়া এপিএম টার্মিনালসের পরোক্ষ লাভ আরো বেশি। তারা যদি সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে কনটেইনার জাহাজসেবা চালু করতে সক্ষম হয়, তাহলে টার্মিনাল থেকে আয় বহুগুণ বেড়ে যাবে। অর্থাৎ তাদের পরোক্ষ মুনাফা হবে বেশি। যেমন মায়ের্সক লাইনের জাহাজ লালদিয়া টার্মিনালে ভিড়তে অগ্রাধিকার পাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এতে টার্মিনালে জট হলেও তাদের জাহাজ অলস বসে থাকার জন্য দিনে ১০-১৫ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ গুনতে হবে না। এ অর্থ সাশ্রয় হবে তাদের। নিজস্ব টার্মিনাল থাকায় তাদের ব্যবসা আরো বাড়বে।

সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই দাবি করা হয়েছে, লালদিয়ায় টার্মিনাল নির্মাণ করে ৩০ বছর মেয়াদে পরিচালনা করবে এপিএম টার্মিনালস। শর্ত পূরণ হলে আরো ১৫ বছর মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এরপর সম্পূর্ণ সম্পত্তি তারা সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে।

অথচ চুক্তির নথিতে মিলেছে ভিন্ন তথ্য। নথি অনুযায়ী লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল ৪৮ বছর মেয়াদে পরিচালনা করবে এ অপারেটর। এর মধ্যে নির্মাণ তিন বছর, পরিচালনা ৩০ বছর, বাড়তি মেয়াদের সুযোগ রাখা হয়েছে ১৫ বছর। আর এ বর্ধিত সময়ের ব্যাপারে নথিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ফিফটিন ইয়ার্স মাস্ট বি এক্সটেন্ডেবল’। অথচ বৈশ্বিক মানদÐ অনুযায়ী বিদেশী অপারেটরের সঙ্গে করা এ ধরনের চুক্তির মেয়াদ সাধারণত ২০-২৫ বছরের মধ্যে রাখা হয়। এর আগে পিসিটির ক্ষেত্রে আরএসজিটিআইয়ের সঙ্গে মোট ২২ বছর মেয়াদে চুক্তি করেছিল চবক। এর মধ্যে দুই বছর নির্মাণ ও ২০ বছর অপারেশনাল।

এপিএম টার্মিনালস ও চবক উভয়ের কনসালট্যান্টের তথ্য অনুযায়ী, ৪৮ বছর মেয়াদের লালদিয়ায় ২০৩০ সালে বাণিজ্যিক অপারেশন শুরুর পর মাত্র ১১ বছরেই বিনিয়োগ উঠে আসার প্রক্ষেপণ রয়েছে। অন্যদিকে পিসিটিতে ২২ বছর মেয়াদের চুক্তিতে এ পে-ব্যাক পিরিয়ড ১৩ বছর ধরা হয়েছে। পে-ব্যাক পিরিয়ড বলতে বোঝায় অপারেটর কত সময়ে তার বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাবে। সহজ কথায় কত বছরে তারা নিজেরা খরচ তুলে নেবে এবং নিট প্রফিট কাটা শুরু করবে।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নথিতে দেখা যায়, ৩২ একর জমিতে পিসিটি নির্মাণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে আরএসজিটিআইয়ের সঙ্গে চবক চুক্তির দিনই আপফ্রন্ট ফি হিসেবে পেয়েছিল ২০ মিলিয়ন বা ২ কোটি ডলার। এমনকি সেই অর্থ গ্রহণ নিশ্চিত করতে চুক্তির তারিখও চারদিন পিছিয়েছিল বন্দর প্রশাসন। অন্যদিকে ৪৯ একর গ্রিনফিল্ডে এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে চবকর ১৭ নভেম্বর হওয়া পিপিপির আওতায় কনসেশন চুক্তিতে আপফ্রন্ট ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ মিলিয়ন বা ২ কোটি ডলার। যদিও এ আপফ্রন্ট ফি এখনো জমা হয়নি বন্দরের তহবিলে। চবক বলছে, ১৭ নভেম্বর লালদিয়ার চুক্তি হলেও এটি কার্যকর হবে ৯০ দিন পর। চুক্তি কার্যকরের সময় আপফ্রন্ট ফির ৫০ শতাংশ পাবে বন্দর। বাকি ৫০ শতাংশ পাবে পরিচালনকাজ শুরুর পর। অবশ্য একই দিনে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, মেডলগ এসএ পানগাঁও নৌ-টার্মিনালের ২২ বছর মেয়াদে চুক্তির দিনই ১৮ কোটি টাকা দিয়েছে।

আপফ্রন্ট ফি মূলত একটি কনসেশন অধিকার মূল্য, যেটি টার্মিনাল পরিচালনার অধিকার পাওয়ার জন্য চুক্তির শুরুতেই বিনিয়োগকারীর দেয়া এককালীন অগ্রিম অর্থ।

কনসেশন চুক্তির ফলে আরএসজিটির ক্ষেত্রে বার্ষিক নির্ধারিত ফি থাকলেও এপিএম টার্মিনালসের ক্ষেত্রে তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদের এ চুক্তিতে বার্ষিক ফি না রাখাকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন বন্দরসংশ্লিষ্টরা।

আরএসজিটিআই ও মেডলগ আন্তর্জাতিক দুটি প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনায় লোকাল এজেন্টের পূর্ণ দায়দায়িত্ব দিয়েছে যথাক্রমে আরএসজিটি বাংলাদেশ ও মেডলগ এসএ বাংলাদেশ লিমিটেডকে। এক্ষেত্রে দুই সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তারা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশে যেকোনো দায়দেনা, ক্ষতিপূরণের বিষয় তাদের মূল প্রতিষ্ঠানই বহন করবে। কিন্তু এপিএম টার্মিনালস স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে নির্বাচন করেছে কিউএনএস লিমিটেডকে। এখন লোকাল পার্টনার বাংলাদেশের কিউএনএসের সঙ্গে কোম্পানি গঠন করবে এপিএম টার্মিনালস। দায়দেনা, ক্ষতিপূরণের বিষয়ে এপিএম টার্মিনালস ও কিউএনএসের যৌথ কাঠামোতে কী আছে তা এখনো স্পষ্ট নয়।

এই লেখার ক্ষেত্রে এব্যাপারের বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। শুরু থেকেই অনেক বেশি তাড়াহুড়ো করে কাজটা এগিয়ে নেয়া হয়েছে। দেশের আয় কত হওয়াটা যৌক্তিক, আমাদের স্বার্থ যতটুকু সংরক্ষিত হওয়ার দরকার ছিল সেটা হয়েছে কিনা এ বিষয়গুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শুরু থেকে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করলে, একদিকে দেশের স্বার্থ যেমন ঠিক রাখা যায়, তেমনি যে প্রশ্নগুলো উঠছে সেগুলোও নিরসন করা সম্ভব হয়।

তাড়াহুড়োর প্রশ্ন আসছে কেন?

লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্প এবং পানগাঁও বন্দর ব্যবস্থাপনা চুক্তি নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করার অভিযোগ তুলেছেন অনেকে। স্থানীয় একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, গত চৌঠা নভেম্বর এপিএম টার্মিনালস কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব দাখিলের পর দুই সপ্তাহ না যেতেই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। যেখানে এই ধরনের চুক্তি করার ক্ষেত্রে প্রস্তাব মূল্যায়ন, দরকষাকষি, সরকারের অনুমোদনসহ নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন হয়।

পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালের ক্ষেত্রেও এমন অভিযোগ উঠেছে। দাবি করা হচ্ছে গত ছয়ই নভেম্বর পানগাঁও টার্মিনালের কারিগরি প্রস্তাব মূল্যায়ন করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার দেড় সপ্তাহের মধ্যে চুক্তিটি সম্পন্ন হয়। এমন প্রেক্ষাপটে কেন তাড়াহুড়ো করে চুক্তিগুলো করা হচ্ছে এমন প্রশ্ন তুলেছেন বন্দর ব্যবহারকারি ও বন্দর বিষয়ে অভিজ্ঞরা।

গণঅধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলছেন, জনস্বার্থের একটি চুক্তি নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট বা গোপনীয়তার শর্তে সরকার কেন রাজি হলো। চুক্তির প্রক্রিয়াটিই তো অগ্রহণযোগ্য। যেভাবে এই সরকার তাড়াহুড়ো করছে, জোরজবরদস্তি করছে, এর জন্য পুলিশের ব্যবস্থা করা হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে, সরকার থেকে নানা হুমকি দেয়া হচ্ছে, এগুলো থেকে বোঝা যায় তাদের উদ্দেশ্য জাতীয় স্বার্থ নয়।

জিবুতি এবং শ্রীলঙ্কায় বিদেশি কোম্পানির বন্দর ব্যবস্থাপনার খারাপ অভিজ্ঞতার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ওই দেশগুলোও এমন চুক্তি করে পরবর্তীতে নানা জটিলতায় পড়েছে, যার খেসারত দিতে হয়েছে দেশের নাগরিকদের।

গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির এই সদস্য ভবিষ্যত জটিলতা নিয়েও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার কদিন পর দায়িত্বে থাকবে না, তখন এই চুক্তি নিয়ে যদি কোনও সমস্যা তৈরি হয় তাহলে এর জবাবদিহি করবে কে, ওই সময় তো এনারা কেউ থাকবেন না।

অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, লালদিয়ার চুক্তিতে কী কী ক্লজ আছে সেগুলো পরিষ্কার করার জন্য আমরা দাবি তুলেছি। চুক্তি করার আগেই যারা এ ধরনের বিষয়ে কাজ করেন বা বিশেষজ্ঞ তাদের অন্তর্ভুক্ত করাটা জরুরি ছিল। প্রথমত, এমন চুক্তির আর্থিক দিক আছে, দ্বিতীয়ত, কত সময় পরে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসবে সে সময়সীমার ব্যাপার আছে। বিভিন্ন ধরনের সন্দেহ, আশঙ্কা তৈরি হয় যখন শর্তগুলো অনেক বেশি গোপন রাখতে চাওয়া হয়। নেগোসিয়েশনটা হতে পারত টার্মিনালটি নির্মাণের পর আবার কতদিনে আমাদের হাতে আসবে সে বিষয়ে। যদিও বাস্তবে ঘটছে উল্টো। নির্মাণের পর লালদিয়া দীর্ঘ সময়ের জন্য অপারেটরের হাতে থেকে যাবে। আমরা জেনেছি এপিএম টার্মিনালস ৩০ বছর তাদের অপারেশনে থাকবে। এখন এর সঙ্গে আরো ১৫ বছরের সুযোগ রাখার মানে হলো এটা আসলে দীর্ঘমেয়াদের একটি চুক্তি। শুরু থেকেই অনেক বেশি তাড়াহুড়ো করে কাজটা এগিয়ে নেয়া হয়েছে। দেশের আয় কত হওয়াটা যৌক্তিক, আমাদের স্বার্থ যতটুকু সংরক্ষিত হওয়ার দরকার ছিল সেটা হয়েছে কিনা এ বিষয়গুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শুরু থেকে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করলে একদিকে দেশের স্বার্থ যেমন ঠিক রাখা যায় তেমনি যে প্রশ্নগুলো উঠছে সেগুলোও নিরসন করা সম্ভব হয়।

সরকার ব্যাখ্যায় কি বলছে

এসব চুক্তি নিয়ে নানা সমালোচনার মধ্যেই নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দিয়েছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। বন্দর ব্যবস্থাপনার দীর্ঘদিন ধরে নানা অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্প বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপি আওতায় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পে প্রায় ছয় হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে প্রতিষ্ঠানটি। নির্মাণের পর ৩০ বছর টার্মিনালটির দায়িত্বে থাকবে এপিএম। তবে এর রেগুলেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

চুক্তির শর্ত প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, ‘যতগুলো কনটেইনার তারা হ্যান্ডেল করবে, প্রত্যেকটার জন্য আমাদের একটি নির্দিষ্ট ফি দিবে। যত বেশি ভলিউম করবে আমাদের আয় তত বেশি হবে। এর পাশাপাশি দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে অনেক ধরনের শর্ত আছে এই চুক্তিতে।’

এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে চুক্তিতে বন্দর ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক। তিনি বলেন, ‘লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল একটা গ্রিনফিল্ড প্রকল্প। এ প্রকল্পের শুরু থেকে সবকিছুই করবে এপিএম টার্মিনালস। তাই বলব নেগোসিয়েশন, চুক্তি সবকিছুতেই আমরা ভালো অবস্থানে আছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে ইউরোপ থেকে আসা সবচেয়ে বড় প্রত্যক্ষ বৈদেশিক ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের এ বিনিয়োগে (এফডিআই) বাংলাদেশ সরকারের কোনো বিনিয়োগ করতে হবে না। সবকিছুই এপিএম টার্মিনালস করে দেবে। এ অর্থ ধাপে ধাপে বাংলাদেশে আসবে। লালদিয়া চালু হলে বড় বড় জাহাজ যেমন ভিড়বে, অন্যদিকে টার্ন অ্যারাউন্ড সময়ও কমে যাবে। এমনকি সরাসরি ইউরোপে যাতায়াতের সুযোগ তৈরি করতে পারে আন্তর্জাতিক এ অপারেটর।’

অবশ্য বন্দর ব্যবহারকারীদের কেউ কেউ অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্তের পক্ষে মত দিয়েছেন। নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন নির্বাচিত সরকারের পক্ষে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক সময় কঠিন হয়।

স্বচ্ছতার পরীক্ষাটি বড় প্রশ্ন

বিদেশী কোম্পানির কাছে বন্দর ইজারার চুক্তি নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। চুক্তির আলোচনা-সমালোচনায় ৩টি প্রশ্নই বড় করে উঠে এসেছে, তার একটি হলো স্বচ্ছতা, দ্বিতীয়টি হলো তাড়াহুড়ো এবং তৃতীয়টি হলো দেশের স্বার্থ।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন প্রশাসনের কাছে প্রত্যাশা ছিল, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাই হবে তাদের কাজের মূল ভিত্তি। চট্টগ্রামে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, অর্থায়ন, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালের সঙ্গে সরকারের তড়িঘড়ি করে ৩০ বছরের চুক্তি সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।

চুক্তি সইয়ের জন্য যে সময় বেছে নেওয়া হয়েছে এবং চুক্তির শর্তাবলী সম্পর্কে যে নগণ্য তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তার সবই যেন ‘কাকতালীভাবে’ মিলে যাচ্ছে পতিত সরকারের সময় ভারতের আদানির সঙ্গে হওয়া অসামঞ্জস্যপূর্ণ ২৫ বছরের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির সঙ্গে।

সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়ন জরুরি এবং অত্যাধুনিক কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ এরই অংশ। কিন্তু যেভাবে এই চুক্তি করা হয়েছে, তা সন্দেহের মেঘ ঘণীভ‚ত করেছে এবং ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করেছে এক অশুভ দৃষ্টান্ত।

বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্র্র্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাচী চেয়াম্যান চুক্তিতে দেশের স্বার্থ রক্ষার দাবি করলেও, চুক্তির নন-ডিসক্লোজার শর্তে দেখা যায়, দেশের স্বার্থ অনেকাংশেই লংঘিত হয়েছে। অথচ গোপনীয়তার নামে ওই অংশ প্রকাশ করা হয়নি।

আন্তর্জাতিক চর্চা অনুযায়ী, অন্যায্য প্রস্তাবগুলোকে ‘সুইস চ্যালেঞ্জ’ প্রক্রিয়ার আওতায় আনা উচিত, যেখানে স্বচ্ছতা, প্রতিযোগিতা ও জনস্বার্থে সর্বোচ্চ মূল্য নিশ্চিত করা যায়। সুইস চ্যালেঞ্জ পদ্ধতিতে সরকার কোনো অন্যায্য প্রস্তাব পাওয়ার পর বিকল্প প্রস্তাব আহŸান করে এবং সবচেয়ে ভালো পাল্টা প্রস্তাবটি পাওয়ার পর মূল প্রস্তাবদাতাকে সেই প্রস্তাবের সমান বা আরও ভালো প্রস্তাব দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অন্তর্বর্তী সরকার এই পথ বেছে না নিয়ে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে গিয়েছে, যা আইনসিদ্ধ হলেও উত্তম চর্চা নয়। ফলে এই চুক্তির ভবিষ্যত কী তা নিয়ে সংশয়ই রয়ে গেল।

লেখক: আর্থিক বিশ্লেষক

জনপ্রিয় সংবাদ

কর্মক্ষেত্রে নতুন আচরণবিধি: হাইব্রিড কাজ, অনলাইন মিটিং আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বদলাচ্ছে অফিস শিষ্টাচার

৩ প্রশ্নের মুখে লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল প্রকল্প – কী আছে লালদিয়ার নন-ডিসক্লোজর থলেতে?

০১:০৫:১২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫

আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আশা করা যাচ্ছে, ওই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে নতুন রাজনৈতিক সরকার দেশের শাসনভার গ্রহণ করবে। সেক্ষেত্রে অন্তবর্তী সরকারের হাতে আর বেশি সময় নেই। অথচ শেষ সময়ে এসে সরকার চট্টগ্রামের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্প এবং ঢাকার কাছে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দুটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তি করেছে। চুক্তির বিষয়টি সামনে আসার পর এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। এমন প্রশ্নও সামনে এসেছে দীর্ঘ মেয়াদী এই চুক্তি করার ক্ষেত্রে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার তাড়াহুড়ো করলো কিনা ?

চুক্তি অনুসারে, লালদিয়া টার্মিনালে ত্রিশ বছর এবং পানগাঁওয়ে বাইশ বছর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। দীর্ঘমেয়াদী এবং স্পর্শকাতর এই সিদ্ধান্ত নিতে স্বল্প মেয়াদে দায়িত্বে থাকা অন্তর্র্বতী সরকার কেন তাড়াহুড়ো করলো, এমন প্রশ্ন তুলেছেন বন্দর ব্যবহারকারী এবং বিশেষজ্ঞদের অনেকে। চুক্তিগুলো যদি দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই করা হয় তাহলে সেগুলো প্রকাশ করারও দাবি জানিয়েছেন তারা। যদিও জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের।

বিশেষ করে, চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে পিছু ছাড়ছে না লালদিয়া টার্মিনাল। রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজ কেউই বাদ নেই। দেশে সমুদ্র বন্দরের দক্ষতা বাড়াতে বিদেশী বিনিয়োগ কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে অস্বচ্ছতা, অন্যায় অবিচার, বৈষম্য নির্মূলের ঝান্ডা নিয়ে দায়িত্ব আসা অন্তবর্তী সরকারের চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া নিয়ে। এখন দেখা যাচ্ছে নন-ডিসক্লোজার দোহাই দিয়ে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় স্বাক্ষর করা চুক্তির থলের বিড়াল একের পর এক বেরিয়ে আসছে। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় স্বাক্ষরিত এই চুক্তিটি যে একেবারেই বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকুলে নয় তা জাতির সামনে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।

দেশের বন্দর ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম ও ধীরগতির অভিযোগ নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই এই সমস্যা সমাধানে ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বন্দর বিষয়ে বিদেশি কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।

২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব সৌদি আরবের একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। বিদেশিদের হাতে বন্দরের দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে পড়েছিল সরকার।

বিগত আওয়ামী লীগ আমলে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল বা এনসিটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দুবাইভিত্তিক একটি বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো, সেটিই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আবার গতি পায়।

দেশের অন্তত পাঁচটি টার্মিনালে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে দেওয়ার আলোচনা সামনে এলে এ নিয়ে প্রতিবাদও জানায় বেশ কয়েকটি সংগঠন। এমন প্রেক্ষাপটে লালদিয়া এবং পানগাঁও টার্মিনালের দায়িত্ব পালনে দুই বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। এর পর থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। প্রতিবাদ জানিয়েছেন বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠনও।

চুক্তির ডিসক্লোজার তথ্য অনুযায়ী, কর্ণফুলী মোহনার অদূরে গুপ্তবাঁকের ঠিক আগেই নির্মাণ করা হবে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল। এই অবস্থানটি পণ্যবাহী জাহাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। বন্দর বিশেষজ্ঞদের বলছেন, এ অবস্থানগত সুবিধা লালদিয়াকে চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে ব্যস্ত টার্মিনালে পরিণত করবে। সরকার লালদিয়ার ক্ষেত্রে বছরে ১০ লাখ টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট (টিইইউ) কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের কথা বললেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। এই বন্দরে অপারেশন শুরু হলে এর পরিমাণ আরো বেশি হবে বলে ধারণা করছেন বন্দর বিশেষজ্ঞরা।

দ্বিতীয়ত: সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) ৩৩ বছরের কাঠামো ঘোষণা করা হলেও কার্যত ৪৮ বছরের নির্মাণ-পরিচালনার সুবিধা পাবে ডেনমার্কের এপি-মোলার মায়ের্সক গ্রæপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস। সমুদ্রে পণ্য পরিবহনে বর্তমানে মায়ের্সকের আধিপত্য থাকায় টার্মিনালটি চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের মোট কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের বড় অংশই লালদিয়ায় সম্পন্ন হবে। কারণ, এপিএম টার্মিনালসের অনুক‚লে নিশ্চিত হয়েছে অত্যন্ত সুবিধাজনক আর্থিক কাঠামো।

তৃতীয়ত: বছরে নয় লাখ টিইইউ ছাড়ালেই বাড়তি কনটেইনারে চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব কমে টিইইউ-প্রতি মাত্র ১০ ডলারে নেমে আসবে। ফলে মাত্র এক দশকের মধ্যেই বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে এপিএম টার্মিনালসের পক্ষে। অপারেটরের পক্ষে এতসব নিশ্চয়তার পরও নেগোসিয়েশনে সমপর্যায়ের কিংবা কাছাকাছি আর্থিক-কৌশলগত সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেনি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)।

এ চুক্তির মুল থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে নন-ডিসক্লোজার তথ্য বিশ্লেষণে। সেখানে দেখা যায়, এপিএম টার্মিনালস সবচেয়ে সুবিধা পাবে তাদের শিপিং লাইননির্ভর ব্যবসার কারণে। তাদের নিজস্ব শিপিং লাইন ও কনটেইনার রয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে তাদের ব্যবসাও সবার চেয়ে এগিয়ে। তাই এ চুক্তি এপিএম টার্মিনালসকে একটি ‘গ্যারান্টেড কাস্টমার বেজ’ নিরাপদ ব্যবসার নিশ্চয়তা দিয়েছে। এটি এমন এক সুবিধা যা সাধারণত অন্য কোনো অপারেটর বাংলাদেশে টার্মিনাল পরিচালনায় পাবে না। লালদিয়া টার্মিনাল চালু হবে ২০৩০ সাল নাগাদ। কিন্তু তার আগেই এ নিশ্চয়তা লালদিয়াকে তাদের ‘লো-রিস্ক, হাই-রিটার্ন’ মডেলে পরিণত করেছে। এখানে সময় যত গড়াবে লালদিয়ার আয় তত বাড়বে, অথচ চট্টগ্রাম বন্দর পাবে ‘সেট ফর্মুলা’ অনুযায়ী সীমিত রাজস্ব।

বাংলাদেশের বন্দর পরিচালনায় অন্তবর্তী সরকার এ পর্যন্ত বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে তিনটি চুক্তি করেছে। প্রথম চুক্তি করে গত বছরের (২০২৪) জুনে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালস ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই) এর সঙ্গে। এই কোম্পানি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনায় যুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো ঢাকার অদূরে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালে কাজ করবে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেডলগ। এটি অবশ্য একটি নৌ টার্মিনাল। আর সর্বশেষ বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরে টার্মিনাল পরিচালনায় যুক্ত হতে যাওয়া দ্বিতীয় বিদেশী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ডেনমার্কভিত্তিক এপিএম টার্মিনালস।

এখানে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল এবং লালদিয়া টার্মিনাল এ দুটি সমুদ্রবন্দর। ফলে এই দুই চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে লালদিয়ার নন-ডিসক্লোজার অংশের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। এ নিয়ে একটি জাতীয় গণমাধ্যমেও একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মুলত সেখান থেকেই দুই চুক্তির বৈপরিত্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে গতি আনতে এবং সময় ও দুর্নীতি বন্ধ করে খরচ কমাতে বন্দর পরিচালনায় দক্ষতা বৃদ্ধি জরুরি। এতে বিদেশী প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়ে দেশ লাভবান হলে কারও কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু আপত্তি সেখানেই উঠে চুক্তির ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ যদি ক্ষুণœ হয়।

কিন্তু দুই চুক্তির বিশ্লেষণে দেখা যায়, পতেঙ্গার পিসিটি ও লালদিয়া টার্মিনালের চুক্তিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নেগোসিয়েশন কৌশলে সুস্পষ্ট বৈপরীত্য রয়েছে। পিসিটিতে চবক শক্ত অবস্থান নিয়ে আরএসজিটিআইয়ের সঙ্গে একটি ‘উইন-উইন’ কাঠামো নিশ্চিত করতে পেরেছে। কিন্তু লালদিয়ার ক্ষেত্রে ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে করা চুক্তিতে সেই দৃঢ়তা দেখা যায়নি। রাজস্ব আহরণ ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থে চবকের চেয়ে বেশি সুবিধা গেছে এপিএম টার্মিনালসের পক্ষে। লালদিয়া চুক্তির আর্থিক কাঠামো, পে-ব্যাক সময়, বাজার-প্রভাব ও টার্মিনালের অবস্থানগত সুবিধা মিলিয়ে এপিএম টার্মিনালস শক্তিশালী ভবিষ্যৎ বাজার নিশ্চিত করেছে, যেখানে তুলনামূলকভাবে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে চবক।

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে (পিসিটি) প্রতি টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের বিপরীতে চবক বর্তমানে পায় ১৮ ডলার। অন্যদিকে লালদিয়া টার্মিনাল নিয়ে সরকারি প্রচারণায় বলা হয়েছে, প্রথম ¯ø্যাবে বছরে আট লাখ টিইইউ পর্যন্ত হ্যান্ডলিং হলে বন্দর পাবে ২১ ডলার (টিইইউ-প্রতি), দ্বিতীয় ¯ø্যাবে আট-নয় লাখ টিইইউ পর্যন্ত হ্যান্ডলিং হলে চবক পাবে ২২ ডলার।

তবে চুক্তির নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট (এনডিএ) পর্যালোচনায় আরও একটি ¯ø্যাবের তথ্য পাওয়া যায়, যা সরকারি প্রচারণায় একবারের জন্যও উল্লেখ করা হয়নি। তৃতীয় এ ¯ø্যাবে স্পষ্টভাবে বলা আছে, এপিএম টার্মিনালস বছরে নয় লাখ টিইইউর বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করলেই চবক বাড়তি প্রতি টিইইউর বিপরীতে পাবে মাত্র ১০ ডলার। অর্থাৎ লালদিয়ায় কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ বার্ষিক নয় লাখ টিইইউ পার হলেই ¯ø্যাব অনুযায়ী বন্দরের রাজস্ব কমতে থাকবে। টার্মিনালের অবস্থানগত সুবিধা, জাহাজ আগমনের প্রবৃদ্ধি ও এপিএম টার্মিনালসের বাজার নিয়ন্ত্রণ বিবেচনায় তৃতীয় ¯ø্যাব কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে চুক্তিতে তৃতীয় ¯ø্যাবের এ কাঠামো চবকের দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক স্বার্থের জন্য লাভজনক হবে না।

এছাড়া এপিএম টার্মিনালসের পরোক্ষ লাভ আরো বেশি। তারা যদি সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে কনটেইনার জাহাজসেবা চালু করতে সক্ষম হয়, তাহলে টার্মিনাল থেকে আয় বহুগুণ বেড়ে যাবে। অর্থাৎ তাদের পরোক্ষ মুনাফা হবে বেশি। যেমন মায়ের্সক লাইনের জাহাজ লালদিয়া টার্মিনালে ভিড়তে অগ্রাধিকার পাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এতে টার্মিনালে জট হলেও তাদের জাহাজ অলস বসে থাকার জন্য দিনে ১০-১৫ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ গুনতে হবে না। এ অর্থ সাশ্রয় হবে তাদের। নিজস্ব টার্মিনাল থাকায় তাদের ব্যবসা আরো বাড়বে।

সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই দাবি করা হয়েছে, লালদিয়ায় টার্মিনাল নির্মাণ করে ৩০ বছর মেয়াদে পরিচালনা করবে এপিএম টার্মিনালস। শর্ত পূরণ হলে আরো ১৫ বছর মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এরপর সম্পূর্ণ সম্পত্তি তারা সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে।

অথচ চুক্তির নথিতে মিলেছে ভিন্ন তথ্য। নথি অনুযায়ী লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল ৪৮ বছর মেয়াদে পরিচালনা করবে এ অপারেটর। এর মধ্যে নির্মাণ তিন বছর, পরিচালনা ৩০ বছর, বাড়তি মেয়াদের সুযোগ রাখা হয়েছে ১৫ বছর। আর এ বর্ধিত সময়ের ব্যাপারে নথিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ফিফটিন ইয়ার্স মাস্ট বি এক্সটেন্ডেবল’। অথচ বৈশ্বিক মানদÐ অনুযায়ী বিদেশী অপারেটরের সঙ্গে করা এ ধরনের চুক্তির মেয়াদ সাধারণত ২০-২৫ বছরের মধ্যে রাখা হয়। এর আগে পিসিটির ক্ষেত্রে আরএসজিটিআইয়ের সঙ্গে মোট ২২ বছর মেয়াদে চুক্তি করেছিল চবক। এর মধ্যে দুই বছর নির্মাণ ও ২০ বছর অপারেশনাল।

এপিএম টার্মিনালস ও চবক উভয়ের কনসালট্যান্টের তথ্য অনুযায়ী, ৪৮ বছর মেয়াদের লালদিয়ায় ২০৩০ সালে বাণিজ্যিক অপারেশন শুরুর পর মাত্র ১১ বছরেই বিনিয়োগ উঠে আসার প্রক্ষেপণ রয়েছে। অন্যদিকে পিসিটিতে ২২ বছর মেয়াদের চুক্তিতে এ পে-ব্যাক পিরিয়ড ১৩ বছর ধরা হয়েছে। পে-ব্যাক পিরিয়ড বলতে বোঝায় অপারেটর কত সময়ে তার বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাবে। সহজ কথায় কত বছরে তারা নিজেরা খরচ তুলে নেবে এবং নিট প্রফিট কাটা শুরু করবে।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নথিতে দেখা যায়, ৩২ একর জমিতে পিসিটি নির্মাণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে আরএসজিটিআইয়ের সঙ্গে চবক চুক্তির দিনই আপফ্রন্ট ফি হিসেবে পেয়েছিল ২০ মিলিয়ন বা ২ কোটি ডলার। এমনকি সেই অর্থ গ্রহণ নিশ্চিত করতে চুক্তির তারিখও চারদিন পিছিয়েছিল বন্দর প্রশাসন। অন্যদিকে ৪৯ একর গ্রিনফিল্ডে এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে চবকর ১৭ নভেম্বর হওয়া পিপিপির আওতায় কনসেশন চুক্তিতে আপফ্রন্ট ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ মিলিয়ন বা ২ কোটি ডলার। যদিও এ আপফ্রন্ট ফি এখনো জমা হয়নি বন্দরের তহবিলে। চবক বলছে, ১৭ নভেম্বর লালদিয়ার চুক্তি হলেও এটি কার্যকর হবে ৯০ দিন পর। চুক্তি কার্যকরের সময় আপফ্রন্ট ফির ৫০ শতাংশ পাবে বন্দর। বাকি ৫০ শতাংশ পাবে পরিচালনকাজ শুরুর পর। অবশ্য একই দিনে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, মেডলগ এসএ পানগাঁও নৌ-টার্মিনালের ২২ বছর মেয়াদে চুক্তির দিনই ১৮ কোটি টাকা দিয়েছে।

আপফ্রন্ট ফি মূলত একটি কনসেশন অধিকার মূল্য, যেটি টার্মিনাল পরিচালনার অধিকার পাওয়ার জন্য চুক্তির শুরুতেই বিনিয়োগকারীর দেয়া এককালীন অগ্রিম অর্থ।

কনসেশন চুক্তির ফলে আরএসজিটির ক্ষেত্রে বার্ষিক নির্ধারিত ফি থাকলেও এপিএম টার্মিনালসের ক্ষেত্রে তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদের এ চুক্তিতে বার্ষিক ফি না রাখাকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন বন্দরসংশ্লিষ্টরা।

আরএসজিটিআই ও মেডলগ আন্তর্জাতিক দুটি প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনায় লোকাল এজেন্টের পূর্ণ দায়দায়িত্ব দিয়েছে যথাক্রমে আরএসজিটি বাংলাদেশ ও মেডলগ এসএ বাংলাদেশ লিমিটেডকে। এক্ষেত্রে দুই সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তারা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশে যেকোনো দায়দেনা, ক্ষতিপূরণের বিষয় তাদের মূল প্রতিষ্ঠানই বহন করবে। কিন্তু এপিএম টার্মিনালস স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে নির্বাচন করেছে কিউএনএস লিমিটেডকে। এখন লোকাল পার্টনার বাংলাদেশের কিউএনএসের সঙ্গে কোম্পানি গঠন করবে এপিএম টার্মিনালস। দায়দেনা, ক্ষতিপূরণের বিষয়ে এপিএম টার্মিনালস ও কিউএনএসের যৌথ কাঠামোতে কী আছে তা এখনো স্পষ্ট নয়।

এই লেখার ক্ষেত্রে এব্যাপারের বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। শুরু থেকেই অনেক বেশি তাড়াহুড়ো করে কাজটা এগিয়ে নেয়া হয়েছে। দেশের আয় কত হওয়াটা যৌক্তিক, আমাদের স্বার্থ যতটুকু সংরক্ষিত হওয়ার দরকার ছিল সেটা হয়েছে কিনা এ বিষয়গুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শুরু থেকে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করলে, একদিকে দেশের স্বার্থ যেমন ঠিক রাখা যায়, তেমনি যে প্রশ্নগুলো উঠছে সেগুলোও নিরসন করা সম্ভব হয়।

তাড়াহুড়োর প্রশ্ন আসছে কেন?

লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্প এবং পানগাঁও বন্দর ব্যবস্থাপনা চুক্তি নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করার অভিযোগ তুলেছেন অনেকে। স্থানীয় একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, গত চৌঠা নভেম্বর এপিএম টার্মিনালস কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব দাখিলের পর দুই সপ্তাহ না যেতেই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। যেখানে এই ধরনের চুক্তি করার ক্ষেত্রে প্রস্তাব মূল্যায়ন, দরকষাকষি, সরকারের অনুমোদনসহ নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন হয়।

পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালের ক্ষেত্রেও এমন অভিযোগ উঠেছে। দাবি করা হচ্ছে গত ছয়ই নভেম্বর পানগাঁও টার্মিনালের কারিগরি প্রস্তাব মূল্যায়ন করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার দেড় সপ্তাহের মধ্যে চুক্তিটি সম্পন্ন হয়। এমন প্রেক্ষাপটে কেন তাড়াহুড়ো করে চুক্তিগুলো করা হচ্ছে এমন প্রশ্ন তুলেছেন বন্দর ব্যবহারকারি ও বন্দর বিষয়ে অভিজ্ঞরা।

গণঅধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলছেন, জনস্বার্থের একটি চুক্তি নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট বা গোপনীয়তার শর্তে সরকার কেন রাজি হলো। চুক্তির প্রক্রিয়াটিই তো অগ্রহণযোগ্য। যেভাবে এই সরকার তাড়াহুড়ো করছে, জোরজবরদস্তি করছে, এর জন্য পুলিশের ব্যবস্থা করা হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে, সরকার থেকে নানা হুমকি দেয়া হচ্ছে, এগুলো থেকে বোঝা যায় তাদের উদ্দেশ্য জাতীয় স্বার্থ নয়।

জিবুতি এবং শ্রীলঙ্কায় বিদেশি কোম্পানির বন্দর ব্যবস্থাপনার খারাপ অভিজ্ঞতার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ওই দেশগুলোও এমন চুক্তি করে পরবর্তীতে নানা জটিলতায় পড়েছে, যার খেসারত দিতে হয়েছে দেশের নাগরিকদের।

গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির এই সদস্য ভবিষ্যত জটিলতা নিয়েও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার কদিন পর দায়িত্বে থাকবে না, তখন এই চুক্তি নিয়ে যদি কোনও সমস্যা তৈরি হয় তাহলে এর জবাবদিহি করবে কে, ওই সময় তো এনারা কেউ থাকবেন না।

অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, লালদিয়ার চুক্তিতে কী কী ক্লজ আছে সেগুলো পরিষ্কার করার জন্য আমরা দাবি তুলেছি। চুক্তি করার আগেই যারা এ ধরনের বিষয়ে কাজ করেন বা বিশেষজ্ঞ তাদের অন্তর্ভুক্ত করাটা জরুরি ছিল। প্রথমত, এমন চুক্তির আর্থিক দিক আছে, দ্বিতীয়ত, কত সময় পরে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসবে সে সময়সীমার ব্যাপার আছে। বিভিন্ন ধরনের সন্দেহ, আশঙ্কা তৈরি হয় যখন শর্তগুলো অনেক বেশি গোপন রাখতে চাওয়া হয়। নেগোসিয়েশনটা হতে পারত টার্মিনালটি নির্মাণের পর আবার কতদিনে আমাদের হাতে আসবে সে বিষয়ে। যদিও বাস্তবে ঘটছে উল্টো। নির্মাণের পর লালদিয়া দীর্ঘ সময়ের জন্য অপারেটরের হাতে থেকে যাবে। আমরা জেনেছি এপিএম টার্মিনালস ৩০ বছর তাদের অপারেশনে থাকবে। এখন এর সঙ্গে আরো ১৫ বছরের সুযোগ রাখার মানে হলো এটা আসলে দীর্ঘমেয়াদের একটি চুক্তি। শুরু থেকেই অনেক বেশি তাড়াহুড়ো করে কাজটা এগিয়ে নেয়া হয়েছে। দেশের আয় কত হওয়াটা যৌক্তিক, আমাদের স্বার্থ যতটুকু সংরক্ষিত হওয়ার দরকার ছিল সেটা হয়েছে কিনা এ বিষয়গুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শুরু থেকে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করলে একদিকে দেশের স্বার্থ যেমন ঠিক রাখা যায় তেমনি যে প্রশ্নগুলো উঠছে সেগুলোও নিরসন করা সম্ভব হয়।

সরকার ব্যাখ্যায় কি বলছে

এসব চুক্তি নিয়ে নানা সমালোচনার মধ্যেই নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দিয়েছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। বন্দর ব্যবস্থাপনার দীর্ঘদিন ধরে নানা অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্প বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপি আওতায় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পে প্রায় ছয় হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে প্রতিষ্ঠানটি। নির্মাণের পর ৩০ বছর টার্মিনালটির দায়িত্বে থাকবে এপিএম। তবে এর রেগুলেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

চুক্তির শর্ত প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, ‘যতগুলো কনটেইনার তারা হ্যান্ডেল করবে, প্রত্যেকটার জন্য আমাদের একটি নির্দিষ্ট ফি দিবে। যত বেশি ভলিউম করবে আমাদের আয় তত বেশি হবে। এর পাশাপাশি দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে অনেক ধরনের শর্ত আছে এই চুক্তিতে।’

এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে চুক্তিতে বন্দর ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক। তিনি বলেন, ‘লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল একটা গ্রিনফিল্ড প্রকল্প। এ প্রকল্পের শুরু থেকে সবকিছুই করবে এপিএম টার্মিনালস। তাই বলব নেগোসিয়েশন, চুক্তি সবকিছুতেই আমরা ভালো অবস্থানে আছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে ইউরোপ থেকে আসা সবচেয়ে বড় প্রত্যক্ষ বৈদেশিক ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের এ বিনিয়োগে (এফডিআই) বাংলাদেশ সরকারের কোনো বিনিয়োগ করতে হবে না। সবকিছুই এপিএম টার্মিনালস করে দেবে। এ অর্থ ধাপে ধাপে বাংলাদেশে আসবে। লালদিয়া চালু হলে বড় বড় জাহাজ যেমন ভিড়বে, অন্যদিকে টার্ন অ্যারাউন্ড সময়ও কমে যাবে। এমনকি সরাসরি ইউরোপে যাতায়াতের সুযোগ তৈরি করতে পারে আন্তর্জাতিক এ অপারেটর।’

অবশ্য বন্দর ব্যবহারকারীদের কেউ কেউ অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্তের পক্ষে মত দিয়েছেন। নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন নির্বাচিত সরকারের পক্ষে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক সময় কঠিন হয়।

স্বচ্ছতার পরীক্ষাটি বড় প্রশ্ন

বিদেশী কোম্পানির কাছে বন্দর ইজারার চুক্তি নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। চুক্তির আলোচনা-সমালোচনায় ৩টি প্রশ্নই বড় করে উঠে এসেছে, তার একটি হলো স্বচ্ছতা, দ্বিতীয়টি হলো তাড়াহুড়ো এবং তৃতীয়টি হলো দেশের স্বার্থ।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন প্রশাসনের কাছে প্রত্যাশা ছিল, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাই হবে তাদের কাজের মূল ভিত্তি। চট্টগ্রামে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, অর্থায়ন, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালের সঙ্গে সরকারের তড়িঘড়ি করে ৩০ বছরের চুক্তি সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।

চুক্তি সইয়ের জন্য যে সময় বেছে নেওয়া হয়েছে এবং চুক্তির শর্তাবলী সম্পর্কে যে নগণ্য তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তার সবই যেন ‘কাকতালীভাবে’ মিলে যাচ্ছে পতিত সরকারের সময় ভারতের আদানির সঙ্গে হওয়া অসামঞ্জস্যপূর্ণ ২৫ বছরের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির সঙ্গে।

সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়ন জরুরি এবং অত্যাধুনিক কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ এরই অংশ। কিন্তু যেভাবে এই চুক্তি করা হয়েছে, তা সন্দেহের মেঘ ঘণীভ‚ত করেছে এবং ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করেছে এক অশুভ দৃষ্টান্ত।

বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্র্র্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাচী চেয়াম্যান চুক্তিতে দেশের স্বার্থ রক্ষার দাবি করলেও, চুক্তির নন-ডিসক্লোজার শর্তে দেখা যায়, দেশের স্বার্থ অনেকাংশেই লংঘিত হয়েছে। অথচ গোপনীয়তার নামে ওই অংশ প্রকাশ করা হয়নি।

আন্তর্জাতিক চর্চা অনুযায়ী, অন্যায্য প্রস্তাবগুলোকে ‘সুইস চ্যালেঞ্জ’ প্রক্রিয়ার আওতায় আনা উচিত, যেখানে স্বচ্ছতা, প্রতিযোগিতা ও জনস্বার্থে সর্বোচ্চ মূল্য নিশ্চিত করা যায়। সুইস চ্যালেঞ্জ পদ্ধতিতে সরকার কোনো অন্যায্য প্রস্তাব পাওয়ার পর বিকল্প প্রস্তাব আহŸান করে এবং সবচেয়ে ভালো পাল্টা প্রস্তাবটি পাওয়ার পর মূল প্রস্তাবদাতাকে সেই প্রস্তাবের সমান বা আরও ভালো প্রস্তাব দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অন্তর্বর্তী সরকার এই পথ বেছে না নিয়ে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে গিয়েছে, যা আইনসিদ্ধ হলেও উত্তম চর্চা নয়। ফলে এই চুক্তির ভবিষ্যত কী তা নিয়ে সংশয়ই রয়ে গেল।

লেখক: আর্থিক বিশ্লেষক