নতুন শব্দে ভরে উঠছে দ্বীপের আকাশ
পুয়ের্তো রিকোর সংগীতে বরাবরই শোনা যায় বোম্বা ঢোল আর রেগেতনের তালে তালে জীবনের গল্প। কিন্তু দ্বীপের পূর্ব প্রান্তের সিইবা শহরে এখন সেই সুরে নতুন শব্দ যোগ হয়েছে। আকাশ চিরে উড়ে যাওয়া এফ থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমানের গর্জন। একসময় বন্ধ হয়ে যাওয়া রুজভেল্ট রোডস নৌঘাঁটি আবার জেগে উঠছে, আর সেই জাগরণই বদলে দিচ্ছে পুরো অঞ্চলের সামরিক বাস্তবতা।
রুজভেল্ট রোডসের প্রত্যাবর্তন
দুই হাজার চার সালে বন্ধ হওয়া এই ঘাঁটিতে আবার প্রাণ ফিরছে। বিমান হ্যাঙ্গারের বাইরে তরুণ সেনাদের আনাগোনা, রানওয়েতে সারি সারি যুদ্ধবিমান। ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর অংশ হিসেবে এখানে পাঠানো হয়েছে এফ থার্টি ফাইভ বি যুদ্ধবিমান। দ্বীপটি এখন আকাশপথ, সমুদ্রপথ আর নজরদারির কেন্দ্রবিন্দুতে।

মাদকবিরোধী অভিযান না শক্তি প্রদর্শন
গত সেপ্টেম্বর থেকে ক্যারিবিয়ান আর পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে ছোট নৌকায় চালানো হয়েছে একের পর এক হামলা। পেন্টাগনের ভাষায় এগুলো মাদক পাচারের বিরুদ্ধে অভিযান। তবে এই হামলার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর ওপর চাপ বাড়াতে আকাশে বোমারু উড়ছে, আর ওয়াশিংটন থেকে শোনা যাচ্ছে স্থল হামলার ইঙ্গিত। পুয়ের্তো রিকো এখানে হয়ে উঠছে মূল ভরকেন্দ্র।
কৌশলগত কেন্দ্র হিসেবে দ্বীপের গুরুত্ব
এফ থার্টি ফাইভ, এ সি ওয়ান থার্টি গানশিপ, রিপার ড্রোন—সব কিছুর সহায়তা মিলছে এই দ্বীপ থেকেই। উপকূলে অবস্থান করছে ধ্বংসকারী জাহাজ আর ক্রুজার, সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক বিমানবাহী রণতরী জেরাল্ড আর ফোর্ড। ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাস এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। কোনো সংঘাত শুরু হলে পুয়ের্তো রিকোর ভূমিকা হবে নির্ধারক।

ইতিহাসে গাঁথা সামরিক ছাপ
উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে পুয়ের্তো রিকোয় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। নব্বইয়ের দশকে হাইতিতে অভিযানের সূচনাও হয়েছিল এখান থেকে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এবারের প্রত্যাবর্তন শুধু নিরাপত্তা নয়, বরং স্পষ্ট শক্তি প্রদর্শনের বার্তা।
সংখ্যায় বদলে যাওয়া চিত্র
কয়েক মাস আগেও লাতিন আমেরিকা আর ক্যারিবিয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সংখ্যা ছিল সীমিত। এখন পুয়ের্তো রিকো আর ইউএস ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জে রয়েছে হাজার হাজার সেনা, অসংখ্য যুদ্ধবিমান আর উপকূলে ভিড় করা যুদ্ধজাহাজ। সরবরাহ চুক্তি বাড়ানো হয়েছে দুই হাজার আটাশ সাল পর্যন্ত।

স্থানীয় অর্থনীতিতে স্বস্তির আশা
সিইবার মেয়র স্যামুয়েল রিভেরা বায়েজ বলছেন, সেনারা বাজারে খরচ করছে, গাড়িতে জ্বালানি নিচ্ছে। এতে ব্যবসা চাঙা হবে। দীর্ঘদিনের মন্দায় থাকা শহরে এখন খাবারের ভ্যান, পিজা আর এমপানাদার দোকান। চুল কাটার কাজ করা লিলি রোবলেসের মতে, এই উপস্থিতি তার মতো অনেকের জন্যই আশার আলো।
আপত্তি আর আশঙ্কার কণ্ঠও আছে
সবাই অবশ্য খুশি নন। কেউ কেউ এটাকে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব হিসেবে দেখছেন, কেউ আবার পরিবেশ দূষণের ভয় পাচ্ছেন। সিইবার কাছের ভিয়েকেস দ্বীপে এখনও সামরিক মহড়ার পুরোনো ক্ষত রয়ে গেছে। যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের কর্মী সোনিয়া সান্তিয়াগো চান না, পুয়ের্তো রিকো আরেকটি সংঘাতের সিঁড়ি হোক।

রাজনীতি আর আঞ্চলিক সমর্থন
দ্বীপের গভর্নর জেনিফার গনসালেস কলোন এই সামরিক জোরদারিকে সমর্থন করছেন। তার ভাষায়, এতে নিরাপত্তা যেমন বাড়বে, তেমনি বিনিয়োগও আসবে। ক্যারিবিয়ানের অনেক নেতা, মাদকচক্রের সহিংসতায় অতিষ্ঠ হয়ে, একই সুরে কথা বলছেন। ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক সুবিধা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
এই সেনা সমাবেশ শেষ পর্যন্ত শান্তি আনবে, না কি নতুন উত্তেজনা তৈরি করবে, তা নির্ভর করবে ফলাফলের ওপর। এখনো দ্বীপের আকাশে যুদ্ধবিমানের গর্জন আর মাটিতে ঢোলের তালে তালে চলে জীবনের ছন্দ। দুই সুরের এই অস্বস্তিকর সহাবস্থানই পুয়ের্তো রিকোর নতুন বাস্তবতা।

সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















