আমেরিকার জাতীয় পতাকার তারাগুলো শুধু সংখ্যার প্রতীক নয়, বরং এক গভীর ঐতিহাসিক কল্পনার বহিঃপ্রকাশ। স্বাধীনতার শুরুর সময় থেকেই আকাশ, নক্ষত্র ও গ্রহের ভাষায় নিজেদের রাষ্ট্রচিন্তা গড়ে তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইতিহাসবিদ এরান শালেভের গবেষণায় উঠে এসেছে, কীভাবে আকাশের প্রতীক আমেরিকার রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ের সঙ্গে জড়িয়ে যায়
আকাশের দিকে তাকিয়ে রাষ্ট্রভাবনা
অষ্টাদশ শতকের আমেরিকায় আকাশ ছিল মানুষের দৈনন্দিন চিন্তার অংশ। দূষণহীন আকাশ, দূরবীক্ষণের নতুন আবিষ্কার এবং জ্যোতির্বিদ্যার অগ্রগতিতে মানুষ নক্ষত্রলোকের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলে। সাধারণ মানুষ পঞ্জিকা পড়ত, কলেজে গ্রহমণ্ডলের যান্ত্রিক মডেল দেখতে ভিড় করত, এমনকি পত্রিকার নামেও সূর্য ও গ্রহের ছায়া দেখা যেত। এই আকাশমুখী দৃষ্টিভঙ্গিই ধীরে ধীরে রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তায় ঢুকে পড়ে।
রাজা থেকে নক্ষত্রে রূপান্তর
ইউরোপীয় রাজনৈতিক ধারণায় রাজাকে মনে করা হতো সূর্যের মতো কেন্দ্রীয় শক্তি। ফ্রান্সের রাজা লুইকে ডাকা হতো সূর্যরাজা নামে। কিন্তু আমেরিকার বিপ্লব সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। চিন্তাবিদ টমাস পেইন প্রকৃতির নিয়ম টেনে দেখান, উপগ্রহ কখনো গ্রহের চেয়ে বড় হয় না। সেই যুক্তিতে ব্রিটেন ও আমেরিকার সম্পর্ক ভিন্ন ব্যবস্থার বলে ব্যাখ্যা করা হয়। নতুন রাষ্ট্রে কোনো একক সূর্য নয়, বরং সমান গুরুত্বের বহু নক্ষত্রের ধারণা জন্ম নেয়।

সংবিধান ও উদীয়মান সূর্য
সংবিধান প্রণয়ন সভায় জর্জ ওয়াশিংটনের আসনের পেছনে খোদাই করা ছিল অর্ধসূর্য। সভা শেষে বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন বলেছিলেন, এতদিন তিনি বুঝতে পারেননি সূর্যটি অস্ত যাচ্ছে নাকি উঠছে, কিন্তু এখন নিশ্চিত হয়েছেন এটি উদীয়মান সূর্য। তবু সেই সূর্যও আমেরিকার কেন্দ্র হয়ে ওঠেনি। নতুন রাষ্ট্র নিজেকে কল্পনা করল নক্ষত্রসমষ্টি হিসেবে, যেখানে প্রতিটি অঙ্গরাজ্য একটি করে তারা।
তারামণ্ডল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র
স্বাধীনতার পর জাতীয় পতাকায় নীল জমিনে সাদা তারাগুলোকে ঘোষণা করা হলো নতুন এক নক্ষত্রমণ্ডল। ইউরোপীয় পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাইরে এসে আমেরিকা নিজেকে দেখাল শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সমন্বিত এক তারাগুচ্ছ হিসেবে। নতুন অঙ্গরাজ্য যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলা হতো, আমেরিকার গৌরবের আকাশে আরেকটি তারা যুক্ত হলো।
গৃহযুদ্ধ ও দিকনির্দেশক নক্ষত্র
গৃহযুদ্ধের আগে অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, রাজনৈতিক আকাশের তারাগুলো নিজেদের কক্ষপথ হারাবে। দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনের সময় উত্তর তারকা হয়ে ওঠে স্বাধীনতার বাস্তব দিশারি। দাসত্ব থেকে পালিয়ে যাওয়া মানুষদের কাছে আকাশের ওই তারা ছিল মুক্তির প্রতীক।
আজকের তারকাখচিত সংস্কৃতি
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তারার মূল রাজনৈতিক অর্থ অনেকটাই ঝাপসা হয়েছে। আজ তারারা জায়গা নিয়েছে খেলাধুলা ও বিনোদনের জগতে। তবু আমেরিকার সাংস্কৃতিক আকাশে সেই সামাজিক জ্যোতির্বিদ্যা এখনো আলো ছড়াচ্ছে, যা একসময় একটি রাষ্ট্রের জন্মকথা বলেছিল
#আমেরিকার_ইতিহাস #পতাকার_তারকা #রাষ্ট্রভাবনা #স্বাধীনতা #সংবিধান #গৃহযুদ্ধ #নক্ষত্রমণ্ডল
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















