ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রেল শহর কুপিয়ানস্কে আবারও নীল রঙ ফিরেছে যুদ্ধ মানচিত্রে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে শহরের বড় অংশ পুনর্দখল হওয়ার পর এই পরিবর্তন স্পষ্ট হয়। রুশ বাহিনীর একটি অংশ সেখানে ঘেরাও হয়ে পড়েছে বলে জানাচ্ছে যুদ্ধ পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো। এই ঘটনাকে সামনে রেখে ইউক্রেন স্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছে—মাঠে যেমন তারা লড়তে পারে, তেমনি আলোচনার টেবিলে তারা দুর্বল নয়।
কুপিয়ানস্কে দাঁড়িয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রকাশিত ভিডিও সেই বার্তারই অংশ। শত্রু অবস্থান থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে তিনি ক্রেমলিনের জয়ের দাবিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেন। তার কথায়, কুপিয়ানস্ক নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে, এখন বাস্তবতা চোখের সামনে।
কূটনৈতিক চাপ আর সামরিক বার্তা
এই সাফল্য শুধু সামরিক নয়, কূটনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপীয় মিত্রদের আস্থা ধরে রাখা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি আলোচনা—দুই ক্ষেত্রেই ইউক্রেন নিজেদের শক্ত অবস্থান দেখাতে চাইছে। বার্লিনে সাম্প্রতিক বৈঠকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিয়ে কিছু অগ্রগতি হলেও কিয়েভের আশঙ্কা, দুর্বল দেখালে কঠিন শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে সক্ষমতা দেখানো তাদের কাছে অপরিহার্য।
গোপন কৌশলে পাল্টা আক্রমণ
কুপিয়ানস্ক অভিযানের অনেক দিক এখনও গোপন। ইউক্রেনীয় কমান্ডাররা কীভাবে আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রের নজরদারি আর ড্রোনের চোখ এড়িয়ে এই অগ্রগতি সম্ভব করেছেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে নারাজ। তাদের মতে, এসব তথ্য প্রকাশ পেলে শত্রুপক্ষ সুবিধা পেতে পারে। জানা গেছে, গ্রীষ্মের শেষ দিক থেকেই রুশ চাপ বাড়তে থাকায় এই পাল্টা অভিযানের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি সংকটজনক হয়ে উঠলে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ শুরু হয় এবং ধাপে ধাপে রুশ বাহিনীকে নদীর ওপারে ঠেলে দেওয়া হয়।

অন্য ফ্রন্টে চাপ বাড়ছে
তবে কুপিয়ানস্কের এই সাফল্য ব্যতিক্রম। অন্য অনেক ফ্রন্টে ইউক্রেন ক্রমবর্ধমান চাপে রয়েছে। দক্ষিণের জাপরিযহিয়া ও পূর্বের দোনেৎস্ক অঞ্চলে রুশ বাহিনী ধীরগতিতে হলেও এগিয়ে যাচ্ছে। পোক্রোভস্ক, মিরনোহরাদ ও সিভেরস্কের মতো শহরে ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে। কিছু এলাকায় পর্যাপ্ত রিজার্ভ না পাঠানোয় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে বলে সামরিক সূত্রের বক্তব্য।
মানববল ও প্রযুক্তির সংকট
ইউক্রেনের সমস্যার বড় কারণ মানব বল ও সরঞ্জামের ঘাটতি। রাশিয়া বড় জনবল থেকে নিয়োগ চালিয়ে যেতে পারছে, অথচ ইউক্রেন হতাহত পূরণে হিমশিম খাচ্ছে। পাশাপাশি ড্রোন যুদ্ধে রুশ দক্ষতা বেড়েছে। দূরপাল্লার ড্রোন দিয়ে তারা ইউক্রেনীয় রসদ ও পেছনের ঘাঁটিতে আঘাত হানছে, ফলে সামনের লাইনের বাইরে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে।
তবু আশা দেখাচ্ছে সংগঠিত প্রতিরোধ
ইউক্রেনীয় কমান্ডারদের মতে, যেখানে সংগঠিত ও সমন্বিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়, সেখানে রুশ অগ্রগতি থেমে যায়। কুপিয়ানস্ক তার প্রমাণ। প্রতিদিন বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও রাশিয়া এগোতে পারলেও, ইউক্রেন দেখাতে চায় সঠিক পরিকল্পনা থাকলে তারা লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারে।
আলোচনার টেবিলে অনিশ্চয়তা
কূটনৈতিকভাবে পরিস্থিতি এখনও অনিশ্চিত। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। রাশিয়ার প্রতিক্রিয়াও ইতিমধ্যে নেতিবাচক। তবু কিয়েভের আশা, কুপিয়ানস্কের মতো সাফল্য দেখিয়ে তারা প্রমাণ করতে পারবে—ইউক্রেন এখনও বিনিয়োগ ও সমর্থনের যোগ্য।
এই যুদ্ধের বাস্তবতায় ইউক্রেনের বার্তা স্পষ্ট। চাপের মধ্যে সংঘটিত হলে তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, আর সেই শক্তিই তারা বিশ্বকে দেখাতে চাইছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















