উত্তর দারফুরের রাজধানী এল ফাশার দখলের মধ্য দিয়ে সুদানের প্রায় তিন বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধ আরও রক্তক্ষয়ী মোড় নেয়। গত অক্টোবরের শেষ দিকে আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস শহরটি দখল করে নিলে পুরো অঞ্চলের ওপর তাদের প্রায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। দখলের পরপরই শহরে শুরু হয় নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। সহায়তা সংস্থাগুলো ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার অসংখ্য ঘটনার কথা জানায়। এমনকি যাচাই করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক যোদ্ধা প্রাণভিক্ষা চাওয়া একজন বেঁচে যাওয়া মানুষকে গুলি করে হত্যা করছে। জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, এল ফাশার পতনের পর অন্তত এক লাখ মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়েছে। এখনও দেড় লাখের বেশি মানুষের কোনো খোঁজ নেই
অবরুদ্ধ শহর, অজানা মৃতের সংখ্যা
এল ফাশার এখনও বাইরের বিশ্বের জন্য প্রায় পুরোপুরি বন্ধ। ফলে এই গণহত্যায় প্রকৃত প্রাণহানির সংখ্যা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। দারফুরের অন্য কিছু এলাকায় সীমিত সহায়তা পৌঁছালেও এল ফাশারের ভেতরের পরিস্থিতি অজানাই রয়ে গেছে। এই সংকটের খবর পাওয়ার অন্যতম উপায় হয়ে উঠেছে প্রতিবেশী চাদের পূর্বাঞ্চলের শরণার্থী শিবিরগুলো, যেখানে দারফুর ও সুদানের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা প্রায় নয় লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

মায়ের চোখে ছেলের বিদায়
এল ফাশার পতনের কয়েক দিন আগে মানাহিল ইসহাক তার চৌদ্দ বছর বয়সী ছেলে রামিকে খাবারের খোঁজে বাইরে পাঠান। অল্প সময়ের মধ্যেই বিস্ফোরণে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। কথা বলার শক্তি ছিল না, পেট ফেটে গিয়েছিল, হাড় ভেঙে গিয়েছিল। তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা মানাহিল বুঝেছিলেন, ছেলেটি আর বাঁচবে না। শহরে লড়াই বাড়তে থাকায় তিনি পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। চোখের জল নিয়ে তিনি ছেলেকে বিদায় জানান, এই জীবন ও পরকালে শান্তি কামনা করেন, তারপর তাকে রেখে বেরিয়ে পড়েন।
শরণার্থী শিবিরের কঠিন বাস্তবতা
এক মাসের দীর্ঘ ও ভয়ংকর যাত্রা শেষে মানাহিল চাদের ওরে ক্যাসোনি শরণার্থী শিবিরে পৌঁছান। পালানোর সময় তার ভাই নিহত হন এবং তিনি নিজেও স্নাইপারের গুলিতে পিঠে আহত হন। আশ্চর্যজনকভাবে তার গর্ভের সন্তান বেঁচে যায়। তবে এই শিবিরে পৌঁছেও স্বস্তি মেলেনি। অত্যন্ত দুর্গম এই শিবিরটি ২০০৪ সালে দারফুরে গণহত্যা থেকে পালিয়ে আসা মানুষের জন্য তৈরি হয়েছিল। গত এক বছরে শিবিরটির জনসংখ্যা দ্বিগুণ হলেও স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সহায়তা সেই অনুপাতে বাড়েনি।
রাতে পালানো তরুণদের গল্প
মুস্তাফা নামের এক তরুণ জানান, তিনি ও তার বন্ধুরা বুঝেছিলেন এল ফাশার ছাড়তে না পারলে মৃত্যু অনিবার্য। নিজের চোখের সামনে প্রতিবেশীর পরিবারের চারজনকে হত্যা হতে দেখেন তিনি। রাতে পালানোর পরিকল্পনা করলেও পথে ধরা পড়েন। খাবার ও পানি চাইলে তার দুই বন্ধুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মুস্তাফা ও অন্যরা দুদিন গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় ছিলেন, পরে গ্রামবাসীরা মুক্ত করলে তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

বোমা হামলায় ধ্বংস পরিবার
হুসাম আলতাহের জানান, এক ড্রোন হামলায় তার বাড়িতে বোমা পড়ে বাবা ও চাচাতো ভাইদের সবাই নিহত হন। নিজে গুরুতর আহত অবস্থায় দুই মাস হাসপাতালে ছিলেন, ওষুধের অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসা পাননি। শহর দখলের দিন তার মা একটি গাধার গাড়িতে করে তাকে নিয়ে পালান। কয়েক দিন পরই সেই হাসপাতালে চার শতাধিক রোগীকে হত্যা করা হয়। পালানোর পথে তাদের আটক করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়, যা আত্মীয়রা বিদেশ থেকে পাঠিয়ে দেন।
সীমান্ত পেরিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
স্থায়ী শিবিরে যাওয়ার আগে বহু শরণার্থী চাদের সীমান্ত শহর টিনে অস্থায়ীভাবে জড়ো হন। সেখানেই দেখা যায় হুইলচেয়ারে বসা আলি ইসহাককে। এক বিমান হামলায় তিনি একটি পা হারান এবং পুরো পরিবারকে হারান। বন্ধু ইয়াহিয়া রিজিগ রাতের অন্ধকারে তাকে কাঁধে তুলে শহর ছাড়তে সাহায্য করেন। চাদে পৌঁছে তারা আরও পশ্চিমের শিবিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে আবারও যাত্রা শুরু করেন
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















