দক্ষিণ মাদাগাস্কারের লালচে মাটির মাঠ ঘিরে কাঁটাযুক্ত ক্যাকটাসের বেড়া। কোথাও ফসল নেই, কোথাও শুধু সবুজের আভাস। ধুলোমাখা পথে গরু হাঁকায় শিশুরা, স্কুলে যাওয়ার বয়স হলেও তাদের গন্তব্য অন্য। রাস্তার ধারে কাঠকয়লার বস্তা বিক্রি করেন নারীরা। বৃষ্টি আসেনি বহুদিন। টাকার টান, খাবারের অভাব—এই বাস্তবতার মধ্যেই আরেকটি নীরব সংকট লুকিয়ে আছে, তা হলো একাকিত্ব।
একাকিত্ব কি শুধু ধনী সমাজের সমস্যা—এই ধারণা বহুদিনের। কিন্তু সাম্প্রতিক জরিপ বলছে ভিন্ন কথা। যেসব সমাজকে আমরা বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক বলি, সেখানেই বরং মানুষ কম একা। বিপরীতে দরিদ্র দেশগুলোতে একাকিত্বের হার বেশি। আফ্রিকায় এই চিত্র সবচেয়ে তীব্র, যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধনের দর্শন হিসেবে পরিচিত উবুন্টু থাকলেও বাস্তবে একাকিত্ব বাড়ছে।
একাকিত্ব কীভাবে ক্ষতি করে
একাকিত্ব মানে শুধু একা থাকা নয়, প্রত্যাশিত সামাজিক সম্পর্ক আর বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে যন্ত্রণাদায়ক ফারাক। গবেষকদের মতে, সুস্থ সম্পর্কের জন্য কাছাকাছি থাকা, সহায়তা, ঘনিষ্ঠতা, আনন্দ, সম্মান আর প্রয়োজনীয়তার অনুভূতি দরকার। এগুলো ভেঙে পড়লে শারীরিক ও মানসিক ঝুঁকি বাড়ে। হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়, উদ্বেগ ও বিষণ্নতা তীব্র হয়। মানসিক অসুস্থতা আবার একাকিত্ব বাড়িয়ে দেয়, তৈরি হয় এক দুষ্টচক্র।
দারিদ্র্য ও নিঃসঙ্গতার যোগ
বিশ্বজুড়ে তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশ যত গরিব, একাকিত্ব তত বেশি। শুধু দেশ নয়, একই দেশের ভেতরেও ধনীরা কম একা, দরিদ্ররা বেশি একা। এই প্রবণতার সবচেয়ে চরম উদাহরণ মাদাগাস্কার। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে জরিপে অংশ নেওয়া মানুষের বড় অংশ জানিয়েছেন, আগের দিন তারা একাকিত্ব অনুভব করেছেন।
অ্যাম্বোভোম্বে শহরে বাজার, আড্ডা, ভিড়—সবই আছে। তবু অনেকের জন্য এসব সম্পর্ক যথেষ্ট নয়। এক নারী ব্যবসায়ী জানান, মানুষের সঙ্গে কথা হয় ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগই ক্রেতা। বন্ধুর অভাব রয়ে যায়। বহুবিবাহ ও আর্থিক টানাপোড়েনে অনেক নারী একাই সন্তান বড় করেন। সাহায্যের মানুষ কমে গেলে একাকিত্ব বাড়ে।

টাকা বন্ধন সহজ করে
টাকা ভালোবাসা কিনতে পারে না, তবে সামাজিক যোগাযোগ সহজ করে। সময় বাঁচানোর সুযোগ, একসঙ্গে খাওয়া, খেলাধুলা বা আড্ডায় অংশ নেওয়ার সামর্থ্য—এসবই আয়ের সঙ্গে জড়িত। দারিদ্র্যের চাপে মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রমে কাটাতে হয়। পানি আনতে দূরে যেতে হয়, কাজ খুঁজতে হয়। ফলে সম্পর্কের জন্য সময় থাকে না। শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় ভোগা মানুষরা আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কারও কারও মনে আত্মহত্যার চিন্তাও আসে।
অভিবাসন ও ভাঙা বন্ধন
কাজের খোঁজে মানুষ গ্রাম ছাড়ে। দূরত্ব বাড়ে, সম্পর্ক শিথিল হয়। মা দূরে চলে গেলে সন্তান প্রতিদিনের শূন্যতা অনুভব করে। ইতিহাসেও দেখা যায়, বড় আকারের অভিবাসনের সময় একাকিত্ব বেড়েছে। কিছু সমাজে পারিবারিক দায়িত্বের কড়াকড়ি মানুষকে অসন্তোষজনক সম্পর্কেও আটকে রাখে, আর সেই অপূর্ণতা লজ্জা ও নিঃসঙ্গতা ডেকে আনে।
সমাধানের পথে আশার গল্প
দারিদ্র্য কমলে একাকিত্বও কমতে পারে। পাশাপাশি সরাসরি সামাজিক সংযোগ বাড়ানোর উদ্যোগও কাজ করে। ইংল্যান্ডের একটি শহরে চিকিৎসকেরা সামাজিক যোগাযোগকে চিকিৎসার অংশ বানিয়েছেন। ফল হিসেবে হাসপাতালে অপ্রত্যাশিত ভর্তি কমেছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থার খরচ বেঁচেছে। আফ্রিকায়ও কমিউনিটির ভেতরে বসে শোনার বেঞ্চ, প্রতিবন্ধীদের সাপ্তাহিক জমায়েত—এসব উদ্যোগ মানুষকে আবার যুক্ত করছে। ঝড়ে ছাউনি উড়ে গেলেও যারা আসে, তারা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















