পাকিস্তানে ঘরে ঘরে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। বিদ্যুৎ বিল কমছে, লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা কিছুটা হলেও কমেছে। ছাদের ওপর ঝকঝকে প্যানেল দেখে একে অনেকেই নীরব বিপ্লব বলছেন। কিন্তু এই পরিবর্তনের ভেতরে লুকিয়ে আছে আরেকটি কঠিন বাস্তবতা। এই সৌর বিপ্লব আসলে কাদের ক্ষমতায়ন করছে, আর কাদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে, সেই প্রশ্নই এখন সামনে আসছে।
নারীর ত্যাগ, সিদ্ধান্তে পুরুষের দখল
রাওয়ালপিন্ডির মারির হাসান এলাকার গৃহিণী রুবাবের পরিবার বহু বছর ধরে অনিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহে ভুগেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল। দেড় বছর আগে শেষ পর্যন্ত তারা সৌর প্যানেল বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে রুবাবকে নিজের গয়না বিক্রি করতে হয়েছে। সংসারের স্বার্থে এই ত্যাগ নারীদের কাছ থেকে যেন স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশিত।
তবে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সব প্রযুক্তিগত আলোচনা, ইনস্টলেশন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পুরোপুরি পুরুষদের হাতেই রয়ে গেছে। রুবাব প্রতিদিন বিদ্যুৎ ব্যবহারের সবচেয়ে বড় ব্যবস্থাপক হলেও তিনি জানেন না প্যানেল কীভাবে পরিষ্কার করতে হয় বা যন্ত্রে সমস্যা হলে কী করতে হয়। এসব বিষয় তার স্বামীর ওপরই নির্ভরশীল।

পুরুষে-পুরুষে তথ্যের দেয়াল
রাওয়ালপিন্ডির আরেক বাসিন্দা, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা জাহিদার অভিজ্ঞতাও ভিন্ন নয়। শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থার কোনো সিদ্ধান্তে তাকে যুক্ত করা হয়নি। প্রযুক্তি সংক্রান্ত তথ্য প্রথমে পুরুষদের বোঝানো হয়, নারীরা পরে শুধু সারসংক্ষেপ পান। এমনকি একবার বন্যার সময় সৌর প্যানেলে সমস্যা দেখা দিলে প্রযুক্তিবিদ তার সঙ্গে কথা বলতেই অস্বীকৃতি জানান, কারণ তিনি একজন নারী।
এই বাস্তবতা দেখায়, সমস্যা বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, বরং সামাজিক। সঠিকভাবে শেখানো হলে নারীরাও সমান দক্ষতার সঙ্গে এসব প্রযুক্তি সামলাতে পারেন।
সংখ্যায় বড় সাফল্য, ভেতরে বৈষম্য
পাকিস্তানে গত পাঁচ বছরে বিপুল পরিমাণ সৌর প্যানেল আমদানি হয়েছে এবং এর বড় অংশ বসানো হয়েছে আবাসিক খাতে। ঘরোয়া বিদ্যুৎ ব্যবহারে সৌর শক্তির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। কিন্তু এই অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যও স্পষ্ট হচ্ছে। নারীরা দৈনন্দিন বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার মূল কাজটি করলেও সিদ্ধান্ত, নিয়ন্ত্রণ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান তাদের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
শিল্পখাতেও একই চিত্র
সৌর শিল্পে অফিস পর্যায়ে নারীদের উপস্থিতি থাকলেও মাঠপর্যায়ের কাজে তারা প্রায় অনুপস্থিত। শারীরিক শক্তির অজুহাতে এই বিভাজনকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখানো হয়। অথচ কৃষি, ইটভাটা কিংবা পশুপালনের মতো কঠিন শ্রমে নারীদের অবদান নিয়মিতই উপেক্ষিত থাকে। বাস্তবে বাধা শারীরিক নয়, সামাজিক মানসিকতা।

স্বাধীনতা এলে বদলে যায় চিত্র
রাওয়ালপিন্ডির বাহরিয়া টাউনের বাসিন্দা সাহিরার অভিজ্ঞতা দেখায় ভিন্ন বাস্তবতা। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ও স্বাধীন হওয়ায় তিনি নিজেই সৌর বিদ্যুৎ নিয়ে গবেষণা করেছেন, চুক্তি করেছেন এবং অন্য পরিবারকেও পরামর্শ দিয়েছেন। অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও তথ্যের সুযোগ পেলে নারীরাও প্রযুক্তিগত নেতৃত্ব দিতে পারেন, সেটিই তার গল্পে স্পষ্ট।
নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির সংকট
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের জ্বালানি নীতিতে লিঙ্গ বিষয়টি প্রায় উপেক্ষিত। নারীদের নামে সম্পদ নিবন্ধন, সহজ ঋণ, প্রশিক্ষণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করলে সৌর শক্তিও বৈষম্য বাড়াতে পারে। সৌর বিদ্যুৎ তখন সবার জন্য থাকলেও সমানভাবে কাজে লাগবে না।
সৌর শক্তি কি সত্যিই মুক্তির পথ
সৌর বিদ্যুৎ শুধু প্রযুক্তির পরিবর্তন নয়, এটি ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নও। যন্ত্র যদি ঘরে থাকে কিন্তু তা বোঝার অধিকার অর্ধেক মানুষের না থাকে, তাহলে সেই পরিবর্তন অসম্পূর্ণই থেকে যায়। প্রকৃত ন্যায্য রূপান্তরের জন্য দরকার জ্ঞান, সিদ্ধান্ত ও মালিকানায় নারীর সমান অংশগ্রহণ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















