ঢাকার উপকণ্ঠে একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত এক হিন্দু শ্রমিককে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে উত্তেজিত জনতা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। এই ঘটনার পর বাংলাদেশজুড়ে নতুন করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
নিহত দীপু চন্দ্র দাস, বয়স ২৭ বছর, একটি বড় পোশাক কারখানায় দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতেন। দিনে প্রায় ১২ ঘণ্টা কাজ করে মাসে আনুমানিক ১৫০ ডলার বেতনে তিনি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পোশাক পরীক্ষা করতেন। গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার কাজের সময় সহকর্মীদের সঙ্গে একটি আলোচনার মধ্যে তিনি কিছু মন্তব্য করলে তা ধর্ম অবমাননাকর বলে অভিযোগ তোলা হয়।
এরপর সহকর্মীরা তাঁকে জোর করে কারখানা থেকে বের করে রাস্তায় নিয়ে যায়। অল্প সময়ের মধ্যেই গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা জনতা তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে তাঁর মরদেহ একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে আগুন দেওয়া হয়।
সোমবার পর্যন্ত এ ঘটনায় অন্তত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যাদের মধ্যে নিহতের দুই সহকর্মীও রয়েছেন। তবে পুলিশ এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি, ঠিক কোন মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।

এই হত্যাকাণ্ড এমন এক সময়ে ঘটল, যখন বাংলাদেশ দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত বছর ক্ষমতাচ্যুত হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর পতনের পর দেশজুড়ে নেতৃত্বের শূন্যতা এবং আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠেছে। নিরাপত্তা বাহিনী বিচ্ছিন্ন সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো সতর্ক করে বলছে, এই অস্থির পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে সহিংসতা বাড়াচ্ছে। আসন্ন ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতেই এসব শক্তি সক্রিয় হচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিবেশী ভারতেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার একাধিকবার বিষয়টি নিয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এটি দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিস্তৃত ধারাবাহিকতার অংশ।
পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে নিয়মিত গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের আগে ধারাবাহিক হামলার মুখে সেখানকার অল্পসংখ্যক শিখ ও হিন্দু সম্প্রদায় দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। ভারতে গরু রাখা বা গরুর মাংস বহনের অভিযোগে মুসলিমসহ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাও বেড়েছে। সম্প্রতি ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে বাংলাদেশি সন্দেহে এক শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়; নিহত রাম নারায়ণ বাঘেল ছিলেন সমাজের প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর সদস্য।

শেখ হাসিনার পতনের পরপরই বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগের একাধিক অভিযোগ ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস এসব সহিংসতাকে সামগ্রিক নিরাপত্তা সংকটের অংশ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এটি কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত নয়।
তবে নিহত দীপু চন্দ্র দাসের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তাঁর হত্যাকাণ্ডকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানানো ও উদ্যাপন করার ঘটনাও সামনে এসেছে। একটি ফেসবুক ভিডিওতে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পরিকল্পনাকারী জুবায়ের আহমদ তাসরিফ বলেন, এই হত্যাকাণ্ড মানুষের হৃদয়ে আনন্দ এনেছে।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাইমুল হাসান জানান, গ্রেপ্তারদের মধ্যে কারখানার ব্যবস্থাপক ও এক ফ্লোর সুপারভাইজারও রয়েছেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, কেন তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি বা কেন তাঁকে বাঁচানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

নিহতের সহকর্মী সেলিম মিয়া জানান, বৃহস্পতিবার শিফটের শেষ দিকে একটি ধর্মীয় আলোচনা থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। শুক্রবার জুমার নামাজের আগে সপ্তাহের ভুলের জন্য তওবা করার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা চলছিল। এ সময় দীপু মন্তব্য করেন, নির্দিষ্ট একটি দিনের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব কুসংস্কারের মতো শোনায়। এরপর ধর্ম নিয়ে পাল্টাপাল্টি প্রশ্ন থেকে উত্তেজনা বাড়ে এবং শেষ পর্যন্ত সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
নিহতের ভাই অপু চন্দ্র দাস জানান, সন্ধ্যার দিকে এক সহকর্মীর ফোনে তাঁরা জানতে পারেন দীপু বিপদে আছেন। দ্রুত পৌঁছাতে বলা হলেও রাত আটটা বা সাড়ে আটটার দিকে আবার ফোন করে জানানো হয়, তিনি আর বেঁচে নেই। দীপু ছিলেন কলেজপড়ুয়া, তিন বছর আগে বিয়ে করেছিলেন এবং তাঁর একটি ছোট কন্যাসন্তান রয়েছে। তিনি মাসে একবার গ্রামের বাড়িতে যেতেন, যা ঢাকার কাছাকাছি প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে।
রাতে ঘটনাস্থলে পৌঁছে অপু দেখেন, রাস্তায় পড়ে আছে তাঁর ভাইয়ের রক্তাক্ত ও দগ্ধ দেহ। পরদিন ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ সরানোর সময় নিরাপত্তা বাহিনী জনতাকে দূরে রাখার চেষ্টা করে, যাতে মরদেহের আরও অবমাননা না হয়।
সারাক্ষণ ডেস্ক 


















