দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া টানা তিন সপ্তাহের রক্তক্ষয়ী সীমান্ত সংঘর্ষের পর ৭২ ঘণ্টার একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। শনিবার এই চুক্তি কার্যকর হয়, যার মাধ্যমে সাময়িকভাবে থেমে গেল সাম্প্রতিক সহিংসতা। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হওয়া একটি সমঝোতা ভেঙে যাওয়ার পর নতুন করে সংঘাত শুরু হয়েছিল।
যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত ও শর্ত
থাইল্যান্ডের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল নাথাফন নার্কফানিত জানান, দুই দেশের জেনারেল বর্ডার কমিটির তিন দিনের আলোচনার পর যৌথ যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় স্বাক্ষর করা হয়। শনিবার স্থানীয় সময় দুপুর থেকে উভয় পক্ষ গোলাগুলি বন্ধে সম্মত হয়েছে। থাইল্যান্ডের চান্থাবুরি প্রদেশে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত হয়, সীমান্তে বর্তমানে থাকা সেনা মোতায়েন অপরিবর্তিত থাকবে এবং ভারী অস্ত্র প্রত্যাহার করা হবে।
আসিয়ান পর্যবেক্ষণ ও বাস্তুচ্যুতদের প্রত্যাবর্তন

যুদ্ধবিরতির পর আসিয়ান পর্যবেক্ষক দল ৭২ ঘণ্টা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। এই সময় শেষ হলে, ৭ ডিসেম্বর সংঘর্ষ শুরুর পর যারা থাইল্যান্ডের সীমান্ত এলাকা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, তারা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরতে পারবেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষায় আসিয়ান সহযোগিতাই প্রধান ব্যবস্থা হওয়া উচিত।
বিশ্বাস নয়, পরীক্ষার সময়
নাথাফন নার্কফানিত স্পষ্ট করে বলেন, এই যুদ্ধবিরতি কোনো আস্থার প্রকাশ নয় কিংবা নিঃশর্ত স্বীকৃতি নয়। বরং এটি একটি পরীক্ষামূলক সময়, যেখানে দেখা হবে কম্বোডিয়া সত্যিই অস্ত্রের উসকানি ও হুমকি বন্ধ রাখতে পারে কি না।
কম্বোডিয়ার অবস্থান
কম্বোডিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী টি সেইহা আশাবাদ প্রকাশ করে বলেন, যুদ্ধবিরতির পুরো সময় ধৈর্য ও প্রতিশ্রুতি বজায় রাখা জরুরি। এতে করে আটক ১৮ জন কম্বোডীয় সেনা নিরাপদে দেশে ফিরে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন।

আগের শান্তি কাঠামোর পথে ফেরার চেষ্টা
শনিবারের এই চুক্তি হয়েছে তিন দিনের কারিগরি আলোচনার পর। আলোচনার লক্ষ্য ছিল অক্টোবরে কুয়ালালামপুরে স্বাক্ষরিত শান্তি কাঠামোয় ফিরে যাওয়া। সেই কাঠামো অনুযায়ী সীমান্ত থেকে ভারী অস্ত্র প্রত্যাহার, স্থলমাইন অপসারণ, প্রতারণামূলক চক্র দমন এবং সীমান্তের ওভারল্যাপ করা দাবি নিষ্পত্তির কথা রয়েছে।
থাই সরকারের বক্তব্য
চুক্তিতে স্বাক্ষরের আগে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী আনুতিন চার্নভিরাকুল জানান, সীমান্তে চালানো সামরিক অভিযানের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে বলে সশস্ত্র বাহিনী নিশ্চিত করেছে।
সাম্প্রতিক হামলা ও প্রাণহানি
এদিকে কম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অভিযোগ করেছে, শনিবার সকালে থাইল্যান্ডের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বান্তেয় মিয়ানচেই প্রদেশে আধা ঘণ্টায় ১৬টি বোমা ফেলেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রঘনিষ্ঠ গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, একটি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে দৌড়ে পালাচ্ছে, যা একটি বোমা হামলার কাছাকাছি এলাকায় ছিল।

২০ দিনের সক্রিয় সংঘর্ষে কম্বোডিয়ায় অন্তত ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। তবে নিহত সেনাদের মোট সংখ্যা সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়নি। স্থানীয় সূত্রের বরাতে জানা গেছে, প্রেয়াহ ভিহিয়ার প্রদেশেই অন্তত ১৩ জন সেনা নিহত হয়েছেন।
নতুন করে উদ্বেগ
কম্বোডিয়ার বিশ্লেষক সেং সারি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সতর্ক করে বলেছেন, আরেকটি স্থলমাইন বিস্ফোরণ যুদ্ধবিরতিকে আবার অস্থির করে তুলতে পারে। যুদ্ধবিরতির মাত্র ৩০ মিনিট আগে সীমান্তবর্তী সিসাকেত প্রদেশে এক থাই সেনা অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইনে পা দিয়ে গুরুতর আহত হন এবং তার একটি পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
পটভূমি
এর আগে নভেম্বরে এক থাই সেনা স্থলমাইনে আহত হওয়ার পর থাইল্যান্ড যুদ্ধবিরতির শর্ত থেকে সরে আসে। এর ফলেই ৮ ডিসেম্বর নতুন করে সহিংস সংঘর্ষ শুরু হয়, যা অবশেষে এই সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে এসে থামল।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















