সারাক্ষণ ডেস্ক
বার্লিন প্রাচীর দীর্ঘদিনের পুরোনো এক শহরের বাসিন্দাদের ভাগ করে রেখেছিল। অবশেষে ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর এটি ভেঙ্গে পড়ে । তৈরী হলো ইতিহাসের নতুন অধ্যায়। বিবিসির আর্কাইভ ক্লিপে এই ইতিহাসের সাক্ষীর প্রমাণ মেলে। তখনকার রিপোর্টার ব্রায়ান হ্যানরাহান সেই মিলনের একটি আবেগপূর্ণ কিন্তু নৈরাজ্যকর অবস্থার প্রতিবেদন করেছিলেন।
১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর সন্ধ্যায়, বিবিসির ব্রায়ান হ্যানরাহান ইতিহাসের একটি মুহূর্ত, বার্লিন প্রাচীরের পতনের সাক্ষী হয়ে উল্লাসের দৃশ্যের মধ্যে দাঁড়িয়েছিলেন।
পরিবেশটা ছিল বিদ্যুতের মতো গতিময়। প্রায় তিন দশক ধরে তাদের শহরকে বিভক্ত করে রাখা মানুষ এক অবিশ্বাস্য মিলনের স্বাদ নিচ্ছে এক অপরকে আলিঙ্গন করে। তারা কাঁদছে এবং উল্লাসে ফেটে পড়ছে।
প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে, লোকেরা হাতুড়ি এবং ছেনি দিয়ে একে ভেঙ্গে ফেললো। সাংবাদিক একটি জাতিকে পুনরায় একত্রিত হওয়ায় উচ্ছ্বাসের অনুভূতি পেয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, বার্লিন প্রাচীরকে যেমনি রাতারাতি তৈরি করা হয়েছিল ঠিক সেভাবেই আজ সেটি ভেঙ্গে পড়লো। ঘটনাটি খুব দ্রুত এবং কোনোরকম সতর্কতা ছাড়াই। এটি ১৩ আগস্ট ১৯৬১ তে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (পূর্ব জার্মানি) প্রায় রাতারাতি নির্মাণ করেছিল।
সেই সময়ে, সোভিয়েতরা দাবি করেছিল যে এটি পূর্বে পশ্চিমা গুপ্তচরদের আসা বন্ধ করার জন্য করা হয়েছিল, তবে এটি মূলত পূর্ব জার্মান নাগরিকদের উন্নত সুযোগের সন্ধানে পশ্চিম জার্মানিতে অভিবাসন রোধ করার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল।
প্রাথমিকভাবে একটি কাঁটাতারের বেড়া নির্মিত হয়েছিল তারপরেই এটিকে দ্রুত সশস্ত্র রক্ষীদের দ্বারা টহল দেওয়া একটি উচ্চ কংক্রিটের দেয়াল দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয় এবং পূর্ব বার্লিনবাসীকে সতর্ক করা হয়েছিল যে যারা শহরের পশ্চিমে পালানোর চেষ্টা করবে তাদের ভিন্নমতের বলে আখ্যায়িত করে গুলি করা হবে।
ইতিহাস
‘ইন হিস্ট্রি’ এমন একটি সিরিজ যা বিবিসি’র অত্যাধুনিক অডিও এবং ভিডিও সংরক্ষণাগার ব্যবহার করে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি অন্বেষণ করে যা আজও মানুষের মনে অনুরণিত হয়।
২৮ বছর ধরে, প্রাচীরটি একটি শারীরিক এবং আদর্শিক বাধা হিসাবে দাঁড়িয়েছে, যা শুধুমাত্র পরিবার এবং বন্ধুদের নয় বরং সমগ্র দেশকে আলাদা করে রেখেছিল।
বার্লিনের পশ্চিম অংশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছিল কারন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপ সেখানে বিনিয়োগ করত । অথচ তখন শহরের পূর্বে সংগ্রাম করা চলছিল, প্রবৃদ্ধি ছিল জর্জরিত এবং গোপন পুলিশ স্ট্যাসি দ্বারা দমন নিপিীড়ন মূলক চালানো হচ্ছিল।
প্রাচীরটি ঠান্ডা যুদ্ধের একটি শক্তিশালী প্রতীক হয়ে ওঠেছিল সেসময়। পাশাপাশি কমিউনিস্ট প্রাচ্য এবং পুঁজিবাদী পশ্চিমের মধ্যে বিভাজনের একটি শারীরিক প্রকাশও হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে, পুরো পূর্ব ব্লক চাপের মুখে পড়ে গিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে একটি জটিল যুদ্ধে হাবুডুবু খাচ্ছিল এবং একটি তীব্র অর্থনৈতিক সমস্যা এবং প্রধান খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হয়ে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল।
এই ক্রান্তিকালে, সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ, যিনি ১৯৮৫ সালে ক্ষমতায় আসলেন এবং ইতিমধ্যেই একাধিক রাজনৈতিক সংস্কারে হাত দিলেন যেমন গ্লাসনস্ত (উন্মুক্ততা) এবং পেরেস্ত্রোইকা (পুনর্গঠন) শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেগুলি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলছিল।
পোল্যান্ডের শিপইয়ার্ডগুলিতে ডাকা ধর্মঘট হাঙ্গেরিতেও ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দেয় এবং এস্তোনিয়া, লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে স্বাধীনতার ডাক দেয়।
পূর্ব জার্মানি তখনও দৃঢ়ভাবে সোশ্যালিস্ট ইউনিটি পার্টির কব্জায় ছিল কিন্তু স্রোত তৈরি হচ্ছিল। অবশেষে ৪ নভেম্বর ১৯৮৯ সালে অর্ধ মিলিয়ন নাগরিক পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে পূর্ব বার্লিনের পাবলিক স্কোয়ারের আলেকজান্ডারপ্লাটজে জড়ো হয়েছিল।
ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করার এক মুহুর্তের মধ্যে, একজন মুখপাত্র ভুলভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে পূর্ব জার্মানদের অবাধে সীমান্ত অতিক্রম করার অনুমতি দেওয়া হবে এবং সেটি অবিলম্বে কার্যকর হবে।
পাঁচ দিন পরে, জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, তার জনগণের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখোমুখি হয়ে নতি স্বীকার করে। তারা ভেবেছিল যে, তারা সীমান্ত নিয়ন্ত্রণগুলি শিথিল করে বিক্ষোভকে শান্ত করতে পারবে কিন্তু পূর্ব বার্লিনবাসীদের জন্য সীমান্ত পুরোপুরি না খুলেই যাতায়াত করা সহজ করে তোলে।
পূর্ব জার্মান সরকারের একজন মুখপাত্র, গুন্টার শ্যাবোস্কি, পরিবর্তনগুলি ঘোষণা করার জন্য একটি তড়িঘড়ি করে সাজানো সংবাদ সম্মেলন করেছেন। কিন্তু বুঝতেই পারেননি যে এক মুহূর্তে ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করবে, তিনি ভুল করে ঘোষণা করলেন যে পূর্ব জার্মানদের অবাধে সীমান্ত অতিক্রম করার অনুমতি দেওয়া হবে এবং সেটি অবিলম্বে কার্যকর হতে যাচ্ছে।
ঘোষণাটি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের হতবাক করে দেয়, এটি শুনে তারা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি কিন্তু পরে উচ্ছ্বাসের সাথে এটিকে স্বাগত জানায়। এই খবরটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাজার হাজার পূর্ব জার্মানবাসী প্রাচীর বরাবর চেকপয়েন্টে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করে।
হতচকিত সীমান্ত রক্ষীদের সাথে দেখা হলে জনগনের কাছে তারা এই নতুন নীতির বিষয়ে তাদের নির্দেশাবলী কী ছিল তা বোঝার জন্য চেষ্টা করছিল।এরপর , আনুমানিক রাত ২২.৪৫-এ প্রচুর সংখ্যক লোকের আগমন এবং কোনও স্পষ্ট আদেশের অভাব দেখে অভিভূত হয়ে সীমান্ত রক্ষীরা অবশেষে গেটগুলি খুলে দিল এবং আনন্দিত পূর্ব জার্মানরা পশ্চিম বার্লিনে চলে গেল।
Leave a Reply