অর্ঘ্যরা পাড়া ছেড়ে চলে গেল।
দুটো পিক-আপ ভ্যান পেটভরতি মাল-সামান নিয়ে চলে যাওয়ার পর ওরাও উবারের ট্যাক্সিতে চড়ে বসল। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সব দেখে নিয়েছে তুষ্টি। কদিন আগেও ওদের সে চিনত না। অথচ বিদায়বেলায় তুষ্টি ওদের কেউ না হয়েও কষ্ট পাচ্ছে ভেতরে।
যাবার আগের দিন অর্ঘ্য তুষ্টিদের ছাদে উঠে এসেছিল। বেশ সাহসী মনে হচ্ছিল ওকে। কোত্থেকে একটা মই এনে দিব্যি চলে এল ওদের ছাদে। অর্ঘ্যকে তখন একটা গেছো ইঁদুরের মতো দেখাচ্ছিল। বেশ বেখাপ্পা লাগছে। কিছুতেই ওর মেধাবী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এটি যাচ্ছিল না।
এসময় ছাদে সৃষ্টি ছিল না। ছুটির দিন হওয়ায় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে সে। এই ফাঁকে তুষ্টি ছাদে হাওয়া খেতে চলে এসেছে।
মার্চের গোধূলি। সারাদিন মেজাজ দেখিয়ে সূর্যটা এখন অস্তাচলে। পশ্চিমের আকাশ রঙে ভরপুর। চোখের সামনে এত রঙ দেখলেই কেন যেন বিষণœ লাগে সবকিছু তুষ্টির কাছে। যে পাখিগুলো অনন্তের দিকে পাখা মেলে উড়তে চাইছে, ওর চোখ পড়লেই আনচান করে মন। একটা মুক্ত অনাবিল আনন্দ যেন ওকে সারাক্ষণ হাতছানি দিয়ে ডাকে। ভাল লাগে না তখন কিছু। নিজেকে বন্দি মনে হয়।
ঠিক এসময় ছেলেটা লাফ দিয়ে পড়ল ওর সামনে। যেন একটা বেড়াল এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে লাফিয়ে নামল। পড়েই হাঁফাতে থাকে।
এভাবে ওকে দেখে তুষ্টির হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। কিছু না, তবু। ছেলেটা সোজা ওর কাছে এসে গভীর করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখের মণি দুটো স্থির। তুষ্টি একঝলক তাকিয়েই নামিয়ে নেয় দৃষ্টি।
অর্ঘ্য আচমকা তুষ্টির একটি হাত নিজের হাতে নিয়ে সিনেমার মতো করে আলতো একটা চুমু খেল। তারপর বলে উঠল,‘তোমার কথা খুব মনে থাকবে আমার। তুমিও ভুলতে পারবে না আমাকে।’ বলেই সে আর দাঁড়ায়নি। যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই চলে গেল।
হাতটা তখনও তুষ্টির চোখের সামনে। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না এরকম একটা ঘটনা ওর জীবনে ঘটবে। ছেলেটার সঙ্গে মাত্র কদিনের পরিচয়। পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকে। দুচারটা কথা হয় ছাদে এলে। বিকালবেলার নিবিড় প্রকৃতির অংশ হিসাবেই মেনে নিয়েছিল ওকে। সে কিভাবে এ কাÐটা করার সাহস পেল?
রাগ হল প্রথমে। তীব্র অস্বস্তি আর উষ্মাবোধ গ্রাস কওে রাখে ওকে। মাত্র কিছুক্ষণ। তারপরই একধরনের লজ্জাবোধ ওকে ¤্রয়িমান নিশ্চুপ করে তোলে। চারপাশে চোরা চোখে তাকিয়ে পরখ করে নেয়, কেউ ওকে দেখছে কিনা। খানিক বাদে নাকমুখ গুজে সেখান থেকে ছুটে পালায় ।
পরদিন অর্ঘ্যদের মালামাল যখন পিক-আপে করে মহল্লা ছাড়ছে তখন সে স্কুলে যাচ্ছে। সহসা কেন যেন অথৈ দুঃখে ছলকে উঠল ভেতরটা। ওর জীবনের প্রথম ক্রাশ কি এই অর্ঘ্য ?
ভাবতে ভাবতে সে পৌঁছে গেল স্কুলে। ওকে দেখামাত্র ওর পরিচিত টিয়া দুটো টুঁই-টুঁই করে ওঠে। প্রথমে বুঝতে পারে নি। পরক্ষণে কেন যেন অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে এক অজানা ভয়ে। ওদের ডাকের ভেতর কেমন যেন একটা ভীতিকর ভাব ছিল Ñ দুবার শুনেই তুষ্টি ঠিক টের পেয়ে যায়।
পিছন থেকে সৃষ্টি বলল,‘কিরে দিদি, থামলি কেন ? ক্লাসে যা। ’
‘ক্লাসে গেলে বিপদ হবে। আমি বরং চলে যাই।’ চোখ বড় বড় হয়ে যায় তুষ্টির।
‘তুই কি বলছিস ? তোর কি মাথা-টাতা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ? মা জানতে পারলে কিন্তু খবর আছে তোর। ’
তুষ্টি তখনও অসহায়ভাবে তাকায় টিয়া দুটোর অস্থির চোখের দিকে। ওরা পাখা ঝাপটে বড় একটা ডালে গিয়ে বসে। তারপর ডাকতে থাকে, টুই টুই।
প্রথম ক্লাসটাই আজ অঙ্ক। ক্লাসে ঢুকে সহসা মনে হল, রিতা আপা হোম-টাস্ক হিসাবে বেশ কটি সম্পাদ্য আর এলজাবরা দিয়েছিল করতে। সেগুলো করা হয়ে ওঠেনি। বেমালুম ভুলে বসে আছে। স্কুলে এসেছে খালি হাতে। অর্ঘ্যর ভাবনায় এতই মগ্ন ছিল যে সে বেমালুম সব ভুলে বসে আছে ।
রিতা আপা এমনিতেই রাগী শিক্ষক। তার উপর তুষ্টি তার অমনোযোগী ছাত্রীদের একজন। কি হবে?
আপা এলেন ; কথা বললেন দু-চারটা। তারপরই বলে উঠলেন,‘তোমাদের হোমটাস্ক দিয়েছিলাম কটা। করেছ ? সবাই নিজ নিজ টেবিলে খুলে রাখো খাতাগুলো। আমি দেখছি।’
তুষ্টির মাথা ঘুরছে। ভূমিকম্প হচ্ছে ভেতরে। রিতা আপা সম্ভবত বুঝতে পারলেন ওকে দেখেই। অভিজ্ঞ চোখ, তুষ্টির চোখে-মুখে ভেসে বেড়ানো নার্ভাসনেস দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। ওর দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞাসা করলেন ,‘ হোমটাস্ক কমপ্লিট করেছো ?’
মাথা নিচু করে ফেলল তুষ্টি। সঙ্গে সঙ্গে আপা চরম এক বিতৃষ্ণা নিয়ে মন্তব্য করলেন,‘ তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। একটা ভালো ছেলে দেখে তোমার মা-বাবাকে বল বিয়ে দিয়ে দিতে। তোমাদের হিন্দুসমাজে তো বাল্য বিবাহের প্রচলন আছে। আছে না?’
তুষ্টি মাথা নুয়ে ফেলে। চোখ বেয়ে আপনাআপনি জল গড়াচ্ছে। পুরো ক্লাস জুড়ে তখন হাসির রোল।
Leave a Reply