০২:১২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫
শিক্ষার্থী-শিক্ষকের প্রেমের গল্প নিয়ে বিতর্কে বন্ধ হলো দক্ষিণ কোরিয়ার কে-ড্রামা পাকিস্তানে সীমাহীন শ্রমিক শোষণ আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাসাদে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক: ক্লিওপেট্রা ও সিজারের কথোপকথন হিউএনচাঙ (পর্ব-১৪৯) বাংলাদেশে ইভ টিজিং- নারী মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক স্থিতিশীলতার সংকট এপি’র প্রতিবেদন: হাসিনা-বিরোধী বিদ্রোহের পরিণতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ মধুমতী নদী: দক্ষিনের যোগাযোগ পথ মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল ধ্বংস করা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর চিরসবুজ নায়িকা মৌসুমী: রূপালী পর্দার এক যুগের প্রতীক কাপ্তাই লেকের মাছের বৈচিত্র্য ও মাছ ধরার রীতি – পার্বত্য চট্টগ্রামের জলে জীবনের গল্প

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর দেখা না করা ও তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক

যতদূর জানা যায়, মুহাম্মদ ইউনূসের দিক থেকে ভরসা করা হয়েছিলো একজন পশ্চিমা কূটনীতিকের ওপর। তিনি পুরানো কূটনীতিক। এবং দীর্ঘদিন থেকে ড. ইউনূসের ঘনিষ্ট। যে কারণে ইউনূসের অফিস থেকে বলা হয়েছিলো ব্রিটেন সফরটি দ্বিপাক্ষিক হবে এবং সরকারি সফর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কোন দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সময় দিলেন না এমন কি বিমান বন্দর থেকে বাদবাকী সকল স্টেপের মাধ্যমে প্রমানিত হলো, ব্রিটিশ সরকার ইউনূসের সফরকে সরকারি সফর হিসেবে স্বীকৃতি দিলো না। আর ওই পুরানো কূটনীতিক কেন এতটা ব্যর্থ হলেন তাও একটা বড় প্রশ্ন রেখে যায় এখানে। তিনিও কি তার নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা গত কয়েক মাসে তার নিজের কাজের ভেতর দিয়ে হারিয়েছেন!

যাহোক, ওই কূটনীতিকেরও চাকুরির বয়স শেষের দিকে তাকে নিয়ে খুব কিছু ভাবার নেই। তবে ব্রিটেনের এই অবস্থান নেয়া সম্পর্কে দিল্লির সিনিয়র সাংবাদিক জয়ন্ত রায় চৌধুরি তার পডকাস্টে বলছেন, ব্রিটেন তার অর্থনীতির কথা চিন্তা করে ইউনূসের সফরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে ভারতকে কোন রূপ অখুশি করতে চায়নি। জয়ন্ত’র মত হলো, সম্প্রতি ভারত- ব্রিটেন ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট হয়েছে তাতে ২০৩০ এর মধ্যে ব্রিটেনের ব্যবসা ভারতের বাজারে বেড়ে যাবে কয়েকশ বিলিয়ন ডলার। তাছাড়া ভারতই ব্রিটেনে এ মহূর্তে সব থেকে বড় বিনিয়োগকারী।

জয়ন্ত রায় চৌধুরির বিশ্লেষণের সারাংশ হলো, ভারত এ মুহূর্তে যে দৃষ্টিতে ইউনূস ও তার সরকারকে দেখছে ব্রিটেনও অন্তত এই এলাকায় সে দৃষ্টি দিয়েই দেখতে চায়। কারণ, আর কিছু না হোক ভারত ১. ৪ বিলিয়ন মানুষের বাজার। এবং এ মূহূর্তে ইউরোপের পড়তি অর্থনীতিতে শুধু ব্রিটেন নয় গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে শেষ মুহূর্তে এসে ভারতের দৃষ্টিতেই দেখবে তাও এই সফরের ভেতর দিয়ে প্রকাশ হয়ে গেলো।

ভারত প্রকাশ্যেই মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে মৌলবাদী জঙ্গীদের সমর্থক সরকার হিসেবে মনে করে। তারা বার বার এখানে জঙ্গীদের উত্থান ও ইউনূসের সঙ্গে জঙ্গীদের সম্পর্ক ও বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ও মৌলবাদীদের হাতে খৃষ্টান সহ সব ধরনের সংখ্যালঘুরা অনিরাপদ হয়ে পড়েছে বলে- ভারতের পররাষ্ট্র সচিব মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে বলে গেছেন। এমনকি থাইল্যান্ডে ইউনূস যখন মোদির সঙ্গে লবিতে দেখা করার একটা সুযোগ পেয়েছিলেন, সেখানেও ভারতের পক্ষ থেকে তাকে একই কথা বলা হয়েছিলো। এবং ভারতের এই বক্তব্যকে পৃথিবীর কাছে আরো বেশি সত্য হিসেবে প্রমানিত করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস ও গার্ডিয়ানের মতো দুটো লিগাসি মিডিয়ার বাংলাদেশের জঙ্গী উত্থান সম্পর্কিত রিপোর্ট।

তারপরেও ড. ইউনূস যেদিন ব্রিটেন সফরে গেছেন সেদিন বাংলাদেশে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কূটিবাড়ি যা কবির স্মৃতির ও বাঙালিসহ বিশ্ব ইতিহাসের অংশ তা মৌলবাদীরা ভেঙ্গেছে। এবং এই ভাঙ্গার দৃশ্য বর্তমানের সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানে গোটা ব্রিটেনের মানুষও দেখেছে। ব্রিটেন রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে এখনও সম্মান করে তা হয়তো আমরা ঠিক বুঝতে পারি না। কারণ, আমরা মুর্তি ভাঙ্গা জাতি আর ব্রিটেন কতটা তাদের ইতিহাসের মুর্তিকে রক্ষা করে তা তো মান্টো’র গল্পেই সব থেকে বড় প্রকাশ। সেখানে শেকসপিয়রকে নিয়ে “ফাক” বলাতে বারবনিতাও কাস্টমারকে লাথি মেরে বের করে দেয়। তাই এটাতো সত্য ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষার দৌঁড়ে বাঙালি এখনও ব্রিটিশ বারবনিতাদের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় নামার যোগ্যতা অর্জন করেনি।

মুহাম্মদ ইউনূস সাহেব অনেক বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি অর্ন্তবর্তী ব্যবস্থার প্রধান উপদেষ্টা হবার পরে তার অনেক শুভ্যানূধায়ী’র লেখার মাধ্যমে জানতে পারলাম- তিনি ছোট বেলা থেকেই অনেক বুদ্ধি রাখেন। তার উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, তিনি তার উদ্ভাবনী বুদ্ধি দিয়ে কীভাবে বিনা পয়সায় পত্রিকার গ্রাহক হতেন। বাঙালি এগুলোকে বুদ্ধি হিসেবে বিবেচনা করে। অথচ বাঙালিদের মধ্যে জম্ম নেয়া বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ব্রিটেনের বুদ্ধিবৃত্তি এগুলোকে চালাকি হিসেবে মনে করেন। বুদ্ধিবৃত্তি ও চালাকির মধ্যে পার্থক্যটা অনেক বড়।

যেমন ইউনূস সাং‍বাদিকদের বঙ্গবন্ধুর বাড়িভাঙ্গা নিয়ে করা প্র্রশ্ন অনেক সূচতুরতার সঙ্গে এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু বর্তমান দুনিয়াতে কোন ঘটনাই পৃথিবীর কারো অজানা থাকে না। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়ি কীভাবে ভাঙ্গা হয়েছে, কারা ভেঙ্গেছে, সেখানে কোন জঙ্গী গ্রুপের পতাকা উড়েছে- এগুলো পৃথিবীর সকল বড় মিডিয়া নিউজ করেছে। তাই ইউনূসের কাছে প্রশ্ন কিন্তু কীভাবে বা কেন বাড়ি ভাঙ্গা হলো সেটা জানার জন্য ব্রিটেনে ওই সাংবাদিক করেননি, তিনি প্রশ্নটি করেছিলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি ঐতিহ্যকে তার সরকারের আমলে নির্বিঘ্নে ধ্বংস করার কাজের ক্ষেত্রে তার অবস্থানটি কী- সেটাই ব্রিটেনের মানুষকে জানানোর জন্যে। এবং আরো কয়েকটি প্রশ্ন তার কাছে সেখানে আসে তাও ঘটনা জানার জন্য নয়, গণতান্ত্রিক আচরণে তার অবস্থান কি সেটাই জানার জন্যে।

মুহাম্মদ ইউনূস যে উত্তর দিয়েছেন তা পশ্চিমা গনতন্ত্রের সঙ্গে কতটুকু যায় সেটা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। পশ্চিমারা হয়তো আটলান্টিকের এপারে এসে গনতান্ত্রিক আচরণ সব সময় ঠিক মতো করে না তবে তাদের মাটিতে বসে তারা গনতান্ত্রিক আচরনের হিসাবটি গনতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যেই বসেই করে। আর ইতিহাসকে তারা সব সময়ই সঠিক সম্মান দেয়। ২০২৫ এর ৫ ফেব্রুয়ারিতে একশরও কম মানুষের একটি মব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙ্গে। পুলিশ বা রাষ্ট্রের অন্য কোন বাহিনী দিয়ে ওই একশ মানুষকে প্রতিহত করার কোন চেষ্টা হয়নি। যার ফলে তারা বাড়িটি নির্বিঘ্নে ভেঙ্গে ফেলে। কিন্তু ওই বাড়ি ভাঙ্গার পরেও ব্রিটেনের বুদ্ধিবৃত্তির কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ যা ছিলো এখনও তাই আছে। তাদের বুদ্ধিবৃত্তির কাছে শেখ মুজিবুর রহমান যদি হিমালয় হয় তাহলে বাদবাকী বর্তমান জীবিত বাঙালি যারা আছেন তারা মুষিকসম। তারা ইতিহাসকে শ্রদ্ধা করা জাতি- তারা জানে শেখ মুজিব শতবর্ষে একজন জন্মান। বাদবাকীরা প্রতি মুহূর্তে জন্ম নিচ্ছে। পৃথিবীতে শেখ মুজিব গ্রোত্রীয়রা যা অর্জন করে তা শত বছরে একজন করে। বাদবাকীরা যা অর্জন করে তা নিয়মিত, বাৎসরিক বাচ্চা প্রসবের মতো।

যাহোক, ব্রিটেনের ঘটনাকে শুধু কূটনীতিক একটি ধাক্কা নয় বরং বাংলাদেশের সরকার ও সকল রাজনৈতিকদলকে হিসেব করতে হবে, আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের মধ্যে এখন আর কোন রাখঢাক নেই। চায়না তার দেশের কর্মীরা বাংলাদেশের যে এলাকায় সেখানে একটি হাসপাতাল করা ছাড়া আর কোন বিনিয়োগ নিয়ে এক পা এগুচ্ছে না। অন্যদিকে সেখান থেকে ইতোমধ্যে তারা তাদের কারখানার কিছু অংশ কম্বোডিয়ায় সরিয়ে নিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যও নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। আমেরিকা তার নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত যে এই ছোট আঞ্চলিক সমস্যা নিয়ে সে আঞ্চলিক পার্টনারের বাইরে খুব একটা গিয়ে সময় নষ্ট করবে না। সে ক্ষেত্রে আমেরিকার আরেক আঞ্চলিক পার্টনার জাপানও বর্তমান বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতির দিকে তাকিয়ে। বর্তমানকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে না।

অন্যদিকে ভবিষ্যত রাজনীতির জন্যে মুহাম্মদ ইউনূস ছুটে গেছেন ব্রিটেনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করার জন্যে। বিএনপির মহাসচিব সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়ে দিয়েছেন, মুহাম্মদ ইউনূসের দিক থেকে এই বৈঠক চাওয়া হয়েছে।

রাজনীতিতে যে কেউ ডায়ালগ বা বৈঠক চাইলে সেটা গ্রহন করাই রাজনৈতিক সফলতা। যার প্রমান এই বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সফল রাজনীতিক হিসেবে দেখিয়ে গেছেন। তিনি প্রতি মুহূর্তে খবর পাচ্ছেন, শ্রীলংকা ঘুরে শাদা পোষাক পরিয়ে প্রতিদিন প্লেন ভর্তি পাকিস্তানী আর্মি আনা হচ্ছে, যে কোন মূহূর্তে বাঙালিদের ওপর আক্রমন করবেন ইয়াহিয়া খান। আর সেজন্য তিনি ৭ মার্চ তার জাতিকে প্রস্তুত থাকতে জানিয়ে দিয়েও ২৫ মার্চ অবধি ডায়লগ চালিয়ে যান। ডায়লগ পৃথিবীর কূটনীতি ও রাজনীতির প্রাচীন ও অনিবার্য অংশ। যেমন বর্তমানে ট্যারিফ নিয়ে প্রতিমুহূর্তে ডায়লগ চলছে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে।

তাই ডায়লগকে গ্রহন করাই হচ্ছে রাজনীতিকভাবে প্রাথমিক সাফল্য অর্জন। যেমন ইউনূস সাহেব যদি এনজিও নেতা বা মোটিভেশান লেকচারার না হয়ে রাজনীতিক হতেন, তিনি টিউলিপের ডায়লগ অফারকেও গ্রহন করতেন। যেমন বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের ডায়লগকেও গ্রহন করতে দ্বিধা করেননি।

বিএনপি রাজনৈতিক দল বলেই ইউনূস সাহেব যখনই তারেক রহমানের সঙ্গে ডায়ালগ চেয়েছেন তারা সেটা গ্রহন করেছে। এই ডায়লগে ইউনূস সাহেবের অবস্থান কী হওয়া উচিত বা তারেক রহমান কী অবস্থান নেবেন তা কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাজেশান দেবে না। এবং এটা তাদের কাজ নয়। বিশেষ করে এখানে মুহাম্মদ ইউনূস মূলত তার শেষ আশ্রয়স্থল মনে করে তারেক রহমানের কাছে ছুটে গেছেন। কারণ, তিনি যে আর্ন্তজাতিক সমর্থন পাবেন বলে হাইপ তুলেছিলেন সে বেলুনের অবস্থা এখন সবাই জানে। অন্যদিকে তারেক রহমানের সঙ্গে ইউনূসের বৈঠকের আগে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের অবস্থান পরিস্কার করায় তারেক রহমানের জন্যেও অনেক সুবিধা হলো। কারণ, তিনি তার দল নিয়ে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে চায়। তার জন্য এখন বিষয়টি আরো স্পষ্ট হলো, তিনি নিজের পায়ে হাঁটবেন না মুহাম্মদ ইউনূসের পায়ে হাঁটবেন। কারণ প্রতিবেশী চায়না, ভারত থেকে শুরু করে জাপান, আমেরিকা এবং সর্বশেষ ইউরোপে ইউনূসের পায়ের অবস্থান এখন তারেক রহমানের সামনে স্পষ্ট।

লেখকঃ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.

 

শিক্ষার্থী-শিক্ষকের প্রেমের গল্প নিয়ে বিতর্কে বন্ধ হলো দক্ষিণ কোরিয়ার কে-ড্রামা

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর দেখা না করা ও তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক

১১:৪৯:২৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫

যতদূর জানা যায়, মুহাম্মদ ইউনূসের দিক থেকে ভরসা করা হয়েছিলো একজন পশ্চিমা কূটনীতিকের ওপর। তিনি পুরানো কূটনীতিক। এবং দীর্ঘদিন থেকে ড. ইউনূসের ঘনিষ্ট। যে কারণে ইউনূসের অফিস থেকে বলা হয়েছিলো ব্রিটেন সফরটি দ্বিপাক্ষিক হবে এবং সরকারি সফর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কোন দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সময় দিলেন না এমন কি বিমান বন্দর থেকে বাদবাকী সকল স্টেপের মাধ্যমে প্রমানিত হলো, ব্রিটিশ সরকার ইউনূসের সফরকে সরকারি সফর হিসেবে স্বীকৃতি দিলো না। আর ওই পুরানো কূটনীতিক কেন এতটা ব্যর্থ হলেন তাও একটা বড় প্রশ্ন রেখে যায় এখানে। তিনিও কি তার নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা গত কয়েক মাসে তার নিজের কাজের ভেতর দিয়ে হারিয়েছেন!

যাহোক, ওই কূটনীতিকেরও চাকুরির বয়স শেষের দিকে তাকে নিয়ে খুব কিছু ভাবার নেই। তবে ব্রিটেনের এই অবস্থান নেয়া সম্পর্কে দিল্লির সিনিয়র সাংবাদিক জয়ন্ত রায় চৌধুরি তার পডকাস্টে বলছেন, ব্রিটেন তার অর্থনীতির কথা চিন্তা করে ইউনূসের সফরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে ভারতকে কোন রূপ অখুশি করতে চায়নি। জয়ন্ত’র মত হলো, সম্প্রতি ভারত- ব্রিটেন ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট হয়েছে তাতে ২০৩০ এর মধ্যে ব্রিটেনের ব্যবসা ভারতের বাজারে বেড়ে যাবে কয়েকশ বিলিয়ন ডলার। তাছাড়া ভারতই ব্রিটেনে এ মহূর্তে সব থেকে বড় বিনিয়োগকারী।

জয়ন্ত রায় চৌধুরির বিশ্লেষণের সারাংশ হলো, ভারত এ মুহূর্তে যে দৃষ্টিতে ইউনূস ও তার সরকারকে দেখছে ব্রিটেনও অন্তত এই এলাকায় সে দৃষ্টি দিয়েই দেখতে চায়। কারণ, আর কিছু না হোক ভারত ১. ৪ বিলিয়ন মানুষের বাজার। এবং এ মূহূর্তে ইউরোপের পড়তি অর্থনীতিতে শুধু ব্রিটেন নয় গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে শেষ মুহূর্তে এসে ভারতের দৃষ্টিতেই দেখবে তাও এই সফরের ভেতর দিয়ে প্রকাশ হয়ে গেলো।

ভারত প্রকাশ্যেই মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে মৌলবাদী জঙ্গীদের সমর্থক সরকার হিসেবে মনে করে। তারা বার বার এখানে জঙ্গীদের উত্থান ও ইউনূসের সঙ্গে জঙ্গীদের সম্পর্ক ও বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ও মৌলবাদীদের হাতে খৃষ্টান সহ সব ধরনের সংখ্যালঘুরা অনিরাপদ হয়ে পড়েছে বলে- ভারতের পররাষ্ট্র সচিব মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে বলে গেছেন। এমনকি থাইল্যান্ডে ইউনূস যখন মোদির সঙ্গে লবিতে দেখা করার একটা সুযোগ পেয়েছিলেন, সেখানেও ভারতের পক্ষ থেকে তাকে একই কথা বলা হয়েছিলো। এবং ভারতের এই বক্তব্যকে পৃথিবীর কাছে আরো বেশি সত্য হিসেবে প্রমানিত করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস ও গার্ডিয়ানের মতো দুটো লিগাসি মিডিয়ার বাংলাদেশের জঙ্গী উত্থান সম্পর্কিত রিপোর্ট।

তারপরেও ড. ইউনূস যেদিন ব্রিটেন সফরে গেছেন সেদিন বাংলাদেশে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কূটিবাড়ি যা কবির স্মৃতির ও বাঙালিসহ বিশ্ব ইতিহাসের অংশ তা মৌলবাদীরা ভেঙ্গেছে। এবং এই ভাঙ্গার দৃশ্য বর্তমানের সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানে গোটা ব্রিটেনের মানুষও দেখেছে। ব্রিটেন রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে এখনও সম্মান করে তা হয়তো আমরা ঠিক বুঝতে পারি না। কারণ, আমরা মুর্তি ভাঙ্গা জাতি আর ব্রিটেন কতটা তাদের ইতিহাসের মুর্তিকে রক্ষা করে তা তো মান্টো’র গল্পেই সব থেকে বড় প্রকাশ। সেখানে শেকসপিয়রকে নিয়ে “ফাক” বলাতে বারবনিতাও কাস্টমারকে লাথি মেরে বের করে দেয়। তাই এটাতো সত্য ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষার দৌঁড়ে বাঙালি এখনও ব্রিটিশ বারবনিতাদের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় নামার যোগ্যতা অর্জন করেনি।

মুহাম্মদ ইউনূস সাহেব অনেক বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি অর্ন্তবর্তী ব্যবস্থার প্রধান উপদেষ্টা হবার পরে তার অনেক শুভ্যানূধায়ী’র লেখার মাধ্যমে জানতে পারলাম- তিনি ছোট বেলা থেকেই অনেক বুদ্ধি রাখেন। তার উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, তিনি তার উদ্ভাবনী বুদ্ধি দিয়ে কীভাবে বিনা পয়সায় পত্রিকার গ্রাহক হতেন। বাঙালি এগুলোকে বুদ্ধি হিসেবে বিবেচনা করে। অথচ বাঙালিদের মধ্যে জম্ম নেয়া বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ব্রিটেনের বুদ্ধিবৃত্তি এগুলোকে চালাকি হিসেবে মনে করেন। বুদ্ধিবৃত্তি ও চালাকির মধ্যে পার্থক্যটা অনেক বড়।

যেমন ইউনূস সাং‍বাদিকদের বঙ্গবন্ধুর বাড়িভাঙ্গা নিয়ে করা প্র্রশ্ন অনেক সূচতুরতার সঙ্গে এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু বর্তমান দুনিয়াতে কোন ঘটনাই পৃথিবীর কারো অজানা থাকে না। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়ি কীভাবে ভাঙ্গা হয়েছে, কারা ভেঙ্গেছে, সেখানে কোন জঙ্গী গ্রুপের পতাকা উড়েছে- এগুলো পৃথিবীর সকল বড় মিডিয়া নিউজ করেছে। তাই ইউনূসের কাছে প্রশ্ন কিন্তু কীভাবে বা কেন বাড়ি ভাঙ্গা হলো সেটা জানার জন্য ব্রিটেনে ওই সাংবাদিক করেননি, তিনি প্রশ্নটি করেছিলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি ঐতিহ্যকে তার সরকারের আমলে নির্বিঘ্নে ধ্বংস করার কাজের ক্ষেত্রে তার অবস্থানটি কী- সেটাই ব্রিটেনের মানুষকে জানানোর জন্যে। এবং আরো কয়েকটি প্রশ্ন তার কাছে সেখানে আসে তাও ঘটনা জানার জন্য নয়, গণতান্ত্রিক আচরণে তার অবস্থান কি সেটাই জানার জন্যে।

মুহাম্মদ ইউনূস যে উত্তর দিয়েছেন তা পশ্চিমা গনতন্ত্রের সঙ্গে কতটুকু যায় সেটা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। পশ্চিমারা হয়তো আটলান্টিকের এপারে এসে গনতান্ত্রিক আচরণ সব সময় ঠিক মতো করে না তবে তাদের মাটিতে বসে তারা গনতান্ত্রিক আচরনের হিসাবটি গনতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যেই বসেই করে। আর ইতিহাসকে তারা সব সময়ই সঠিক সম্মান দেয়। ২০২৫ এর ৫ ফেব্রুয়ারিতে একশরও কম মানুষের একটি মব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙ্গে। পুলিশ বা রাষ্ট্রের অন্য কোন বাহিনী দিয়ে ওই একশ মানুষকে প্রতিহত করার কোন চেষ্টা হয়নি। যার ফলে তারা বাড়িটি নির্বিঘ্নে ভেঙ্গে ফেলে। কিন্তু ওই বাড়ি ভাঙ্গার পরেও ব্রিটেনের বুদ্ধিবৃত্তির কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ যা ছিলো এখনও তাই আছে। তাদের বুদ্ধিবৃত্তির কাছে শেখ মুজিবুর রহমান যদি হিমালয় হয় তাহলে বাদবাকী বর্তমান জীবিত বাঙালি যারা আছেন তারা মুষিকসম। তারা ইতিহাসকে শ্রদ্ধা করা জাতি- তারা জানে শেখ মুজিব শতবর্ষে একজন জন্মান। বাদবাকীরা প্রতি মুহূর্তে জন্ম নিচ্ছে। পৃথিবীতে শেখ মুজিব গ্রোত্রীয়রা যা অর্জন করে তা শত বছরে একজন করে। বাদবাকীরা যা অর্জন করে তা নিয়মিত, বাৎসরিক বাচ্চা প্রসবের মতো।

যাহোক, ব্রিটেনের ঘটনাকে শুধু কূটনীতিক একটি ধাক্কা নয় বরং বাংলাদেশের সরকার ও সকল রাজনৈতিকদলকে হিসেব করতে হবে, আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের মধ্যে এখন আর কোন রাখঢাক নেই। চায়না তার দেশের কর্মীরা বাংলাদেশের যে এলাকায় সেখানে একটি হাসপাতাল করা ছাড়া আর কোন বিনিয়োগ নিয়ে এক পা এগুচ্ছে না। অন্যদিকে সেখান থেকে ইতোমধ্যে তারা তাদের কারখানার কিছু অংশ কম্বোডিয়ায় সরিয়ে নিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যও নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। আমেরিকা তার নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত যে এই ছোট আঞ্চলিক সমস্যা নিয়ে সে আঞ্চলিক পার্টনারের বাইরে খুব একটা গিয়ে সময় নষ্ট করবে না। সে ক্ষেত্রে আমেরিকার আরেক আঞ্চলিক পার্টনার জাপানও বর্তমান বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতির দিকে তাকিয়ে। বর্তমানকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে না।

অন্যদিকে ভবিষ্যত রাজনীতির জন্যে মুহাম্মদ ইউনূস ছুটে গেছেন ব্রিটেনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করার জন্যে। বিএনপির মহাসচিব সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়ে দিয়েছেন, মুহাম্মদ ইউনূসের দিক থেকে এই বৈঠক চাওয়া হয়েছে।

রাজনীতিতে যে কেউ ডায়ালগ বা বৈঠক চাইলে সেটা গ্রহন করাই রাজনৈতিক সফলতা। যার প্রমান এই বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সফল রাজনীতিক হিসেবে দেখিয়ে গেছেন। তিনি প্রতি মুহূর্তে খবর পাচ্ছেন, শ্রীলংকা ঘুরে শাদা পোষাক পরিয়ে প্রতিদিন প্লেন ভর্তি পাকিস্তানী আর্মি আনা হচ্ছে, যে কোন মূহূর্তে বাঙালিদের ওপর আক্রমন করবেন ইয়াহিয়া খান। আর সেজন্য তিনি ৭ মার্চ তার জাতিকে প্রস্তুত থাকতে জানিয়ে দিয়েও ২৫ মার্চ অবধি ডায়লগ চালিয়ে যান। ডায়লগ পৃথিবীর কূটনীতি ও রাজনীতির প্রাচীন ও অনিবার্য অংশ। যেমন বর্তমানে ট্যারিফ নিয়ে প্রতিমুহূর্তে ডায়লগ চলছে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে।

তাই ডায়লগকে গ্রহন করাই হচ্ছে রাজনীতিকভাবে প্রাথমিক সাফল্য অর্জন। যেমন ইউনূস সাহেব যদি এনজিও নেতা বা মোটিভেশান লেকচারার না হয়ে রাজনীতিক হতেন, তিনি টিউলিপের ডায়লগ অফারকেও গ্রহন করতেন। যেমন বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের ডায়লগকেও গ্রহন করতে দ্বিধা করেননি।

বিএনপি রাজনৈতিক দল বলেই ইউনূস সাহেব যখনই তারেক রহমানের সঙ্গে ডায়ালগ চেয়েছেন তারা সেটা গ্রহন করেছে। এই ডায়লগে ইউনূস সাহেবের অবস্থান কী হওয়া উচিত বা তারেক রহমান কী অবস্থান নেবেন তা কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাজেশান দেবে না। এবং এটা তাদের কাজ নয়। বিশেষ করে এখানে মুহাম্মদ ইউনূস মূলত তার শেষ আশ্রয়স্থল মনে করে তারেক রহমানের কাছে ছুটে গেছেন। কারণ, তিনি যে আর্ন্তজাতিক সমর্থন পাবেন বলে হাইপ তুলেছিলেন সে বেলুনের অবস্থা এখন সবাই জানে। অন্যদিকে তারেক রহমানের সঙ্গে ইউনূসের বৈঠকের আগে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের অবস্থান পরিস্কার করায় তারেক রহমানের জন্যেও অনেক সুবিধা হলো। কারণ, তিনি তার দল নিয়ে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে চায়। তার জন্য এখন বিষয়টি আরো স্পষ্ট হলো, তিনি নিজের পায়ে হাঁটবেন না মুহাম্মদ ইউনূসের পায়ে হাঁটবেন। কারণ প্রতিবেশী চায়না, ভারত থেকে শুরু করে জাপান, আমেরিকা এবং সর্বশেষ ইউরোপে ইউনূসের পায়ের অবস্থান এখন তারেক রহমানের সামনে স্পষ্ট।

লেখকঃ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.