বর্ষায় বিষধর সাপের সক্রিয়তা
প্রাকৃতিক পরিবেশে বৃষ্টির ঋতু এলেই বাংলাদেশে সাপের চলাচল ও দেখা যাওয়ার ঘটনা বেড়ে যায়। বিশেষত রাসেল ভাইপার (Russell’s viper)—বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচিত এক মারাত্মক বিষধর সাপ—বর্ষার সময় আশ্রয় বদল করে এবং অনেক সময় মানুষের ঘরবাড়ির কাছাকাছি চলে আসে।
রাসেল ভাইপার ছাড়াও ক্রেট (krait), গোখরা (cobra), চন্দ্রবোড়া (pit viper) ইত্যাদি সাপ এই ঋতুতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। অতিবৃষ্টির ফলে বন, ঝোপঝাড় বা খেত-খামারের আবাসস্থল প্লাবিত হলে তারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে শহর ও গ্রামীণ বসতিতে চলে আসে। এতে সাধারণ মানুষ ঝুঁকির মুখে পড়ে।
শহরের দিকে বিষধর সাপের আগমন: আশঙ্কা বাড়ছে
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাসেল ভাইপার কেবল গ্রামে নয়, শহরতলি এমনকি নগরকেন্দ্রেও ঢুকে পড়ছে বলে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্মাণাধীন ভবন, ড্রেনের পাশে জমে থাকা পানি ও ঝোপঝাড়পূর্ণ এলাকাগুলো সাপের লুকিয়ে থাকার জন্য আদর্শ জায়গা হয়ে উঠেছে। বৃষ্টির পর ফাঁকা প্লট, রাস্তার পাশে স্যাঁতসেঁতে জায়গা, এমনকি ডাস্টবিনের আশেপাশেও সাপের চলাচল লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ঢাকার মিরপুর, পূর্বাচল, টঙ্গী, নরসিংদী শহর এবং চট্টগ্রামের হালিশহর, সীতাকুণ্ড ও খুলনার কিছু এলাকায় বর্ষায় রাসেল ভাইপার ও অন্যান্য বিষধর সাপের উপস্থিতি নিয়ে স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা সতর্কবার্তা দিয়েছেন।
রাসেল ভাইপার: এক নিঃশব্দ ঘাতক
রাসেল ভাইপার সাধারণত ধানখেত, মেঠোপথ ও ঝোপঝাড়ে দেখা যায়। এদের কামড় অত্যন্ত বিষাক্ত। একবার কামড়ালে স্নায়ুতন্ত্র, রক্তজমাট প্রক্রিয়া এবং কিডনিতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা পেতে দেরি হলে মৃত্যু অনিবার্য।
জাতীয় সাপ গবেষণা কেন্দ্রের (Snake Rescue and Research Center) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৮৫০টি রাসেল ভাইপার সনাক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে ৩০টির মতো সাপ ঢাকার শহরতলির বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করা হয়।
শহরবাসীর জন্য ঝুঁকি কতটা?
সাধারণত শহরের মানুষ সাপের মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকে না। ফলে সাপ ঘরে প্রবেশ করলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় ভুল চিকিৎসা বা লোকজ পদ্ধতিতে সাপের কামড় মোকাবিলা করার চেষ্টা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। রাসেল ভাইপার কামড়ালে দ্রুততম সময়ে হাসপাতালে যাওয়া এবং উপযুক্ত অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করাই একমাত্র সমাধান।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শহরে গর্ত, জলাবদ্ধতা ও ঝোপঝাড় যত বাড়বে, ততই সাপ ঢোকার প্রবণতা বাড়বে। বর্ষার সময়ে তাই বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা, ড্রেনের মুখ বন্ধ রাখা এবং বাচ্চাদের সতর্ক করা জরুরি।
কী করণীয়?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবেশবিদদের কয়েকটি পরামর্শ নিচে দেওয়া হলো:
ঘর ও আশপাশ পরিষ্কার রাখুন: সাপের লুকানোর জায়গা যেন না থাকে।
জুতা পরে হাঁটুন: বিশেষ করে রাতে, বাগান বা খোলা জায়গায়।
লাইট ব্যবহার করুন: অন্ধকার জায়গায় চলাচলের সময় টর্চ ব্যবহার করতে হবে।
ড্রেন বা পানির নিচে হাত দেবেন না: অজান্তে সাপ কামড় দিতে পারে।
সাপ দেখলে আতঙ্ক নয়, সচেতনতা: স্থানীয় সাপ উদ্ধারকারী বা ফায়ার সার্ভিসে যোগাযোগ করুন।
প্রশাসনের প্রস্তুতি কেমন?
বিভিন্ন পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন সাপের আগমন রোধে বা উদ্ধার কার্যক্রমে এখনো তেমন সুসংগঠিত উদ্যোগ নেয়নি। সাপের কামড়ের চিকিৎসায় অনেক হাসপাতালেই পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি এবং জরুরি সহায়তার জন্য হেল্পলাইন চালুর দাবি উঠেছে।
বাংলাদেশের আবহাওয়ার বাস্তবতায় বর্ষায় সাপের উপস্থিতি নতুন নয়। কিন্তু শহরে রাসেল ভাইপারের মতো মারাত্মক বিষধর সাপের প্রবেশ আশঙ্কাজনক। গ্রাম বা শহর—যেখানেই হোক, সচেতনতা, প্রস্তুতি এবং দ্রুত চিকিৎসা-ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই এই হুমকি মোকাবেলার একমাত্র পথ। সতর্ক থাকুন, সচেতন হোন। জীবন বাঁচান।