এক ব্যক্তিগত উপন্যাসের জন্ম
সুইডিশ লেখক জোনাস হাসেন খেমিরি তাঁর নতুন উপন্যাস ‘দ্য সিস্টার্স’ লিখেছেন নিজের জীবনের গভীর সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে। তিনি মনে করেন, এই বই তাঁর সবচেয়ে ব্যক্তিগত কাজ। ইংরেজিতে রচিত এই উপন্যাস পরে তিনি নিজেই অনুবাদ করেন সুইডিশে।
জীবনের অভিশাপ থেকে পালানোর চেষ্টা
সমাজে প্রশংসিত একজন সাহিত্যিক হয়েও খেমিরি অনুভব করতেন যেন তিনি “একটি অভিশাপের দ্বারা অপহৃত”। তাঁর বাবা দীর্ঘ সময় ধরে পরিবারের বাইরে থাকতেন, যার প্রভাব তাঁকে শৈশব থেকেই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। সেই অনুপস্থিতি ছিল তাঁর জীবনের জন্য একধরনের অস্তিত্বগত ব্যঙ্গ। এই মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই তিনি লেখালেখিকে আশ্রয় করেন।
উপন্যাসের গল্প ও চরিত্র
‘দ্য সিস্টার্স’ উপন্যাসে খেমিরি তুলে ধরেছেন স্টকহোমে বেড়ে ওঠা তিন বোন—ইনা, এভলিন ও আনাস্তাসিয়া মিকোলা—এর গল্প। তাঁরা সবাই সুইডিশ-তিউনিসিয়ান, এবং তাঁদের পরিবারে রয়েছে এক রহস্যময় অভিশাপের বিশ্বাস।
ইনা সংবেদনশীল ও কঠোর আচরণে বড় বোনের ‘দায়িত্ব-জ্ঞান’কে তুলে ধরেন।
এভলিন একজন সুন্দরী মধ্যবয়সী নারী, যিনি জীবনের অধিকাংশ সময় ভেসে বেড়ালেও শেষ বয়সে অভিনয়ের প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করেন।
আনাস্তাসিয়া তীব্র রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও তিউনিসিয়ায় আরবি ভাষা শিক্ষার সময় ও সেখানকার এক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক তাঁকে বদলে দেয়।
এই তিন বোনকে কেন্দ্র করেই এগিয়েছে গল্প, যেখানে উপন্যাসের ‘জোনাস’ নামের একজন বর্ণনাকারী চরিত্র তাঁদের জীবনে আবির্ভূত হন, এবং পরে আবিষ্কার করেন, তাঁদের সঙ্গে তাঁর সংযোগ কল্পনার চেয়ে অনেক গভীর।
সময় ও কাঠামোর জটিল বিন্যাস
উপন্যাসটি প্রায় ৬০০ পৃষ্ঠার এবং কাঠামোগতভাবে জটিল। প্রতিটি অধ্যায় সময়ের একেকটি ক্ষুদ্র অংশকে তুলে ধরে—প্রথমে এক বছর, পরে ছয় মাস, তারপর এক মিনিট। লেখক নিজের জীবনের বিভিন্ন পর্ব—স্টকহোমে কৈশোর, বিষণ্ণতার চিকিৎসা নেওয়ার অভিজ্ঞতা, এবং নিউইয়র্কে আনন্দঘন সময়—উপন্যাসে একে একে জুড়ে দিয়েছেন।
ইংরেজিতে রচনা ও নিউইয়র্কে বসবাস
খেমিরি বলেন, মিকোলা বোনেরা যখন তাঁর কল্পনায় আবির্ভূত হয়, তারা ইংরেজিতে কথা বলছিল। তাই তিনিও প্রথমবারের মতো পুরো উপন্যাস ইংরেজিতে লেখেন। পরে তিনি নিজেই সুইডিশ অনুবাদ করেন (‘Systrarna’, ২০২৩)। নিউইয়র্কের কালম্যান সেন্টারের ফেলোশিপ পেয়ে তিনি পরিবারসহ ব্রুকলিনে চলে আসেন এবং সেখান থেকেই লেখেন উপন্যাসের ইংরেজি খসড়া।
পরিচয়, ভাষা ও অভিজ্ঞান
জন্মসূত্রে সুইডিশ হলেও খেমিরির বাহ্যিক রূপ, তিউনিসিয়ান পিতৃপরিচয় এবং বহুভাষিক পরিবেশ তাঁকে বারবার পরিচয়ের সংকটে ফেলেছে। তিনি নিজেকে বলেছেন “একজন ‘নন-লুকিং’ সুইডিশ মানুষ”। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ওয়ান আই রেড’ (২০০৩) ২ লাখের বেশি কপি বিক্রি হয়, কিন্তু সমালোচকরা অনেকেই তাঁর লেখাকে ঠিকমতো শ্রেণিবদ্ধ করতে পারেননি।
পরবর্তীতে তিনি লিখেছেন ‘মন্টেকোর’ এবং নাটক ‘ইনভেজন!’—যা মধ্যপ্রাচ্যীয় পুরুষদের পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসের রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে নির্মিত। এই নাটকের জন্য তিনি পেয়েছেন ‘ওবি অ্যাওয়ার্ড’।
নিজের সত্য অনুসন্ধান
খেমিরি বলেন, আগের লেখাগুলোতে ভাষার কারিগরি কৌশল নিয়ে তিনি মেতে ছিলেন, কিন্তু এখন সত্যের দিকে ঝুঁকেছেন। তাঁর মতে, “ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে এমন গল্পই হলো অভিশাপ”—আর সেই অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা তাঁর ‘দ্য সিস্টার্স’।
এই উপন্যাসে তিনি বাস্তবতাকেও ছাড়িয়ে গিয়ে এমন কিছু তৈরি করেছেন যা বাস্তব থেকেও বেশি সত্য। তাঁর ভাষায়, “আমি বানানো গল্প লিখেছি, যেগুলো আমার নিজের জীবনের চেয়েও বেশি সৎ মনে হয়েছে।”
হ্যাসেন: নিজের মধ্যেকার এক বুনো সত্তা
খেমিরির মধ্য নাম ‘হ্যাসেন’ ছিল তাঁর বাবার নামও। বন্ধু ও সহকর্মীদের কাছে তিনি জানিয়েছেন, এই ‘হ্যাসেন’ সত্তাই তাঁকে কখনও কখনও সাহিত্যে বুনো হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। কিন্তু সেই একই হ্যাসেন তাঁকে নিয়েও করতো কঠোর ভবিষ্যদ্বাণী—যা তাঁর মনে এক ভয়াবহ পরিণতির আশঙ্কা জাগাত।
অভিশাপ কি সত্যিই বাস্তব?
খেমিরি বলেন, “যারা কখনও অভিশাপের ছায়ায় জীবন কাটিয়েছেন, তারা জানেন যে তার থেকে পালিয়ে বেড়ানো মানেই সত্যিকারের মুক্তি নয়।” অভিশাপ আসলে একধরনের গল্প—যেটা সত্য নাও হতে পারে। তবে আপনি যদি বিশ্বাস করেন, তবে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় বাস্তব।
‘দ্য সিস্টার্স’ কেবল একটি উপন্যাস নয়; এটি একজন লেখকের নিজের জীবনের অতীত, পরিবার, শেকড়, ভাষা ও পরিচয়ের সঙ্গে বোঝাপড়ার দীর্ঘ সংগ্রাম। খেমিরি সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন, কখনো-কখনো গল্পই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।