শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৪ অপরাহ্ন

রূপের ডালি খেলা (পর্ব-১৩)

  • Update Time : রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪, ৪.০০ পিএম

ইউ. ইয়াকভলেভ

স্কেটস, বগলে ছেলেটা-২

ইশকুলে যারা পড়ে তাদের এখন বাসন্তী ছুটি, বড়োদের কিন্তু ছুটি নেই। রাস্তায় তাই লোক কম। আর গলিতে এমনিতেই পথচারী দেখা যায় কম।

পুরনো গলি, দোতালা সব বাড়ি। বরফের চটায় পথ ঢাকা। বরফ সাফ করার গাড়িগুলো এখানে গোটা শীতের মধ্যে উ’কি দেয় নি একবারও। দেখেই বোঝা যায় ছোট্ট এই গলিটা হল শহরের বড়ো বড়ো সদর রাস্তার খুবই দূরের আত্মীয়। স্কেটস্ বগলে ছেলেটা হাঁটছে গলি দিয়ে। টুপিটা সে সরিয়ে দেয় ঠান্ডা-হয়ে-

আসা অন্য কানটায়- এবার তোর পালা, গরম হয়ে নে! তারপর কান পেতে শোনে। শোনে বাজনা। স্টেডিয়ম থেকে তা ভেসে আসছে। বড়ো রাস্তায় তা গাড়ির শব্দে চাপা পড়ে যায়, কিন্তু গলিটা চুপচাপ, তাই বাজনা শোনা যাচ্ছে। ছেলেটার ওপর তার প্রভাব হয় ঠিক যুদ্ধের বিউগল সঙ্কেতের মতো। আপনা থেকেই গতি বাড়িয়ে দেয় পা, খুলে-আসা ফিতেটা কেবলি ঢোকা মারে জুতোর গায়ে। ভারি ভালো হয় যদি ফংয়ো-ফায়ো লাল সোয়েটার আর খাটো নীল স্কার্ট পরা মেয়েটা ফের স্কেটিং রিঙ্কে আসে! সেই মেয়েটি, মাথায় যার ফারের শাদা টুপি। ককেসীয় টুপির মতো উচু। টুপির তল থেকে বেরিয়ে থাকে দুটি বেণী। বেণী ধরে একবার টানতে পারলে বেশ হয়। কিন্তু মেয়েটা এতই গুমরে আর ধরা ছোঁয়ার বাইরে যে তা করার সাহস হয় নি। মেয়েটার চোখের সামনে সে তিনটে ছেলের মাথা থেকে টুপি উড়িয়ে দেয়। একটা ছেলে তো একেবারেই বড়ো। ওর চেয়ে এক বিঘত লম্বা। ও- রকম ছেলের কাছ থেকে চাঁটি খাওয়ার সম্ভাবনা ছিল খুবই। মেয়েটার বেণী ধরে টানার সাহসে না কুলালে আজো সে ছেলেটার টুপি খসাবে… কিন্তু মেয়েটা যদি এর মধ্যেই রিঙ্কে এসে গিয়ে থাকে? হয়ত স্কেট্ করতে শুরু করেছে তার রূপোলী ‘তুষার-কন্যায়’? আর বড়ো ছেলেটা যদি হঠাৎ টান মারে তার বেণীতে?!

স্কেটস, বগলে ছেলেটা আর হাঁটছে না, স্রেফ দৌড়চ্ছে। দেরি যেন না হয়। দেরি না হলেই বাঁচি।

এই সময় গলির শেষে দেখা গেল একটা লোক। এমনিতে ছেলেটা সেদিকে নজরই দিতনা, কিন্তু লোকটাই হল গলির একমাত্র পথচারী, আসছিলও সোজা নজরই দিত না, কিন্তু সেই চেহারা। পরনে চামড়া-বাঁধানো শাদা ফেল্ট বুট, কী একটা কালো জানোয়ারের ছাল দিয়ে তৈরি লম্বা চওড়া কোর্তা। পা ফেলছে কেমন ভারি- ভালো জানোয়ারের আর ছেলেটা ওদিকে প্রায় ছুটছিল, তাই শিগগির তাদের মুখোমুখি হওয়ার কথা।

হঠাৎ থেমে গেল লোকটা। তারপর সামনে চলে গিয়ে এলোমেলো কয়েকটা পা ফেললে, মনে হল এই বুঝি পড়ে যাবে। কিন্তু পড়ল না লোকটা, পায়ের ওপরেই খাড়া রইল। অসহায়ের মতো সে হাত নাড়তে লাগল, যেন শূন্যে কোনো একটা অদৃশ্য জিনিসে ভর দিতে চাইছে। এবাবু সে নিশ্চিতই পড়ে যেত, তবে ঠিক সময়েই বাড়ির দেয়ালটায় হাত দিতে পারল সে।

‘নিশ্চয় মাতাল,’ ভাবলে ছেলেটা। চোখে ওর ঝিকিয়ে উঠল বিদ্বেষের সবুজ ছটা: মাতাল সে সইতে পারে না।

ঘেন্নায় নাক কাঁচকে সে গতি বাড়িয়ে দিলে যাতে তাড়াতাড়ি লোকটাকে ছাড়িয়ে যায়।

ছেলেটা যখন লোকটার কাছে এসে পড়ল, তখন সে প্রাণপণে চোখ বন্ধ করে দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে। মুখের কাছে গভীর দুটো ভাঁজ ফুটে উঠেছে। নিশ্বাস ফেলছে হাঁপিয়ে। এক হাতে দেয়াল ধরে আছে আর অন্য হাত দিয়ে কলারের লোহার হক খোলার চেষ্টা করছে। হুকটা খুব আঁটো, ফাঁস থেকে তা আলগা করার মতো জোর নেই হাতে। কপালে ফুটে উঠল বিন্দু-বিন্দু ঘাম।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও থেমে গেল ছেলেটা। এই সময় চোখ মেলে লোকটা চাইল তার দিকে। ঝুলন্ত ভুরুর তলে অনেক দূর কোথেকে যেন সে দৃষ্টি আসছে। না, মাতালের ঘোলাটে ক্ষ্যাপাটে চোখ এ নয়। যন্ত্রণা আর উদ্বেগে তা ভরা। প্রকাণ্ড এই পুরুষ্টু লোকটার সমস্ত ভাবটা থেকেই ফুটে উঠছিল অসহায়তার অস্বস্তি।

শেষ পর্যন্ত হকটা খুলতে পারল সে। ক্লান্ত হাত এলিয়ে নেমে এল নিচে, নিজের ভারেই নুয়ে এল কাঁধ। চোখ বন্ধ করলে লোকটা, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আবার তা খুললে। ছেলেটাকে দেখতে পেয়েছিল সে, চাইছিল না তার দৃষ্টিপথ থেকে সে হারিয়ে যায়।

তখনো কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল ছেলেটা। সময় নেই তার। ভয় হচ্ছিল দেরি হয়ে যাবে। টেনে টেনে নিশ্বাস নেওয়া লোকটার দিকে চাইছিল নিষ্করুণ সবুজ চোখে।

চুপ করে রইল লোকটা। বুকটা তার ভারাক্রান্তের মতো ফুলে উঠছিল, তারপর নেমে আসছিল ধীরে ধীরে, যেন ভয় পাচ্ছে তীক্ষ। কিছু একটাতে খোঁচা লাগবে। সবেমাত্র লোহার হকটা খোলার পর আঙুলগুলো এখন বোতাম খুলেছে।

চুপ করেই আছে লোকটা।

ছেলেটার মনে পড়ল একবার রাস্তায় পড়ে গিয়ে পা ভেঙে যায় এক বুড়োর। ফুটপাথে পড়ে পড়ে আস্তে কাতরাচ্ছিল সে। খুবই কষ্ট হচ্ছিল তার, আর চারিপাশে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল লোকেরা। অ্যাম্বুলেন্স না আসা পর্যন্ত তারা কেবল চেয়েই রইল অভাগা লোকটার দিকে।

কাছেই একটা অচেনা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে বোধ হয় এ লোকটারও বিচ্ছিরি লাগছে?

হঠাৎ লোকটা বললে: ‘খোকা রে…’

ওই একটা কথা বলেই সে ভয়ানক হাঁপাতে লাগল। বোঝা যায়, বাকি কথাগুলো উচ্চারণ করা তার শক্তিতে কুলাল না।

‘খোকা রে’ কথাটা শুনে ছেলেটা হতভম্বের মতো তাকাল লোকটার দিকে। ‘খোকা রে’ বলে তাকে ডাকে তার মা। ওটা মায়ের কথা। পুরুষের মুখ থেকে ও ডাকটা শুনল এই প্রথম।

অচেনা লোকটা ফের তার শক্তি জড়ো করে বললে:

‘আমায় একটু বাড়ি পৌঁছে দে-না… এই কাছেই।’

নীরবে ছেলেটা তার কাঁধ বাড়িয়ে দিলে। অনিশ্চিতের মতো লোকটা দেয়াল থেকে হাত সরিয়ে ভর দিলে ওর কাঁধে। লোকটা প্রকাণ্ড, ভারি, আর ছেলেটা রোগা, নড়বড়ে। লোকটা চেষ্টা করছিল বেশি ভর না দিতে। রাস্তা দিয়ে এগুল ওরা।

ছেলেটার খেয়ালও ছিল না যে সে অনবরত গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। রিঙ্ক থেকে মধুর বাজনা এসে লাগছে কানে। হাতছানি দিচ্ছে, ডাকছে, তাড়া দিচ্ছে সে বাজনা। ছেলেটার মনে হল তার একেবারেই দেরি হয়ে যাবে, পাঁচ মিনিট পরে পৌঁছলেও শেষ হয়ে যাবে সব। বরফ, বাজনা, ছুটন্ত ছেলেগুলোর সারি থাকবে না… কিছুই ওদিকে পা ফেলতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল রুগ্‌ণ লোকটার। প্রতিটি পদক্ষেপেই বুকে লাগছে। তার অস্থির গাইডটি থেকে পেছিয়ে পড়তে চাইছিল না, কিন্তু সামর্থ্যে কুলচ্ছিল না। কয়েক বারই সে থামল দম নেবার জন্যে। সে সময় সে টের পাচ্ছিল যে ছেলেটা ছটফট করছে তার হাতের নিচে, অধীর হয়ে ফিরে তাকাচ্ছে। রোগী বা ছেলেটা, সারা রাস্তা কেউ একটি কথাও কইলে না। ওদের যোগাযোগ একটা দুর্ঘটনার ফলে। একজন অপরের কাছে বোঝা। সেটা বুঝতে পারছিল ওরা, তাই দু’জনেই চাইছিল তাড়াতাড়ি ছাড়া পেতে।

শেষ পর্যন্ত একটা নিচু দেউড়ির কাছে থামল ওরা। বোঝা গেল এইটেই শেষ হল্ট। কপাল থেকে ঠাণ্ডা ঘাম মুছে ফেললে লোকটা, তারপর বিশেষ কারো উদ্দেশে নয়, যেন নিজের মনেই বললে:

‘নড়ে উঠেছে টুকরোটা। এত বছর নিশ্চিন্দি, তারপর হঠাৎ!’

বোঝা যায় ছেলেটার কাছে সে নিজেকে দোষী মনে করছে, তাই কিছুটা দোষ চাপাতে চাইছে ‘নড়ে-ওঠা টুকরোটার’ ওপর।

সচকিত হয়ে উঠল ছেলেটা, অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চাইল লোকটার দিকে। ‘

‘কিসের টুকরো?

‘টুকরো যেমন হয় ভাই, শেলের টুকরো… কবে যুদ্ধ শেষ হয়েছে, টুকরোটা কিন্তু রয়েই গেল,’ বলে নিজের বুকটা দেখাল সে।

দেয়ালে ভর দিয়ে তখনো সে দাঁড়িয়েই থাকছিল আর মন দিয়ে ছেলেটা লক্ষ করছিল ওকে। নাক, ঠোঁট, গভীর টোল খাওয়া থুতনি সবই লোকটার বড়ো- বড়ো। গালে খড়খড়ে দাড়ি।

‘যাওয়া যাক তাহলে,’ দেউড়ির দরজা খুলে বললে লোকটা, ‘খুবই ভারি এক সৈন্য জুটেছে তোর কপালে।’ এগিয়ে গেল ওরা।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024