০৭:১০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫

জীবন আমার বোন (পর্ব-৬২)

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:০০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই ২০২৪
  • 17

মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন। 

মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে। 

তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। 

তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক

মাহমুদুল হক

মুরাদ গায়ে মাখলো না। সে বললে, ‘রমনা রেস্তরাঁয় যাবি?’

খোকা রাজি হ’লো।

গিশগিশ করছে রমনা রেস্তরাঁ। লেকের উপর ঝুলন্ত কাঠের পাটাতনে চেয়ার টেনে বসলো দু’জন। মুখচেনা অনেকের সঙ্গেই চোখাচোখি এবং হাসি বিনিময় হ’লো খোকার; এক একজন এক একটা দল নিয়ে ব’সে আছে, ফোয়ারা ছুটছে যুক্তিতর্কের।

আড্ডা শেষ ক’রে উঠে যাচ্ছিলো প্রভাত গঞ্জালেস ও ইয়াসিন। খোকার দিকে চোখ পড়ায় ফিরে এলো আবার।

ইয়াসিন বললে, ‘থাকিস কোথায়, দেখাই পাওয়া যায় না!’

খোকা বললে, ‘ইছাপুরায় ফিরে যাসনি এখনো?’

‘আর ইছাপুরা। মানুষজন ঢাকা ছেড়ে সব গ্রামাঞ্চলে ভাগছে আর আমি গ্রাম ছেড়ে ঢাকায়, দেখি বরাতে কি জোটে!’

‘সব লীলাখেলা তো এখন ঢাকায়-‘ মুরাদ বললে, ‘গোটা দুনিয়ার চোখ এখন ঢাকার দিকে; বিশ পকেটওলা নীলপ্যান্টে পথঘাট থৈথৈ!’

গঞ্জালেস একটা হাই তুলে জড় ভাঙলো। বললে, ‘সেই দুপুর থেকে এখানে, মেরুদণ্ড টনটন করছে, আর ভালো লাগছে না-‘

তার একটা হাত ধ’রে টেনে বসালো ইয়াসিন। বললে, ‘আরে বোস বোস, তুইই এখন একমাত্র ভরসা সকলের; যাবো তো আমিও।’

‘কথাটা মন্দ বলিসনি’ মুরাদ বললে, ‘পালানোর দরকার হ’লে তোর ওখানে গিয়ে উঠবো; কলাকোপা-বান্দুরা জায়গাটাও মন্দ নয়!’

গঞ্জালেস বললে, ‘কে যে কাকে জায়গা দেবে এখন এখানে ব’সে সেকথা তোলা মুশকিল, মাথায় কাপড় তুলে আমাদেরই যে একদিকে ছুটতে হবে না একথা জোর দিয়ে কারো পক্ষে বলা অসম্ভব। ভিতরের খবর খুবই খারাপ।’

খোকা বললে, ‘তোর তো আবার সব বিদেশীসূত্রের খবর। ভাগ্যিশ কনস্যুলেটে কেরানির চাকরিটা ছিলো, তা না হ’লে দেশের ভাগ্যে যে কি ঘটতো!’

গঞ্জালেস বললে, ‘অবস্থা খুবই কেরোসিন, ঠাট্টা নয়!’

ইয়াসিন মনমরা হ’য়ে বললে, ‘দেশের অবস্থা যে খারাপ দিকে যাচ্ছে তা’ বোঝার জন্যে তোর ওই ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ ছাঁদা করার দরকার নেই, এমনিই বোঝা যায়। ইশ, সারারাত কিভাবেই না কুকুর কাঁদে! আমার শালা ঘুমই আসে না, মনে হয় একটা মড়ক লাগবে-‘

মুরাদ বললে, ‘কুকুর আমাদের ওদিকেও কাঁদে, কিন্তু এটা একটা রদ্দিমার্কা কুসংস্কার!’

ইয়াসিন চ’টে উঠলো। বললে, ‘এড়ো তর্ক করাটা তোর একটা রোগ হ’য়ে দাঁড়িয়েছে যা দেখতে পাচ্ছি; নিছক নিজের কোট বজায় রাখার জন্যে গায়ের জোরে তুই কথা বলিস। কি ক’রে জানলি এটা কুসংস্কার; অভিজ্ঞতা আছে তোর কোনো?’

মুরাদ বললে, ‘লেখাপড়া শিখে এদেশের মানুষের কোনোদিন কোনো উন্নতি হবে না, সব শালা পিছনে হাঁটা মানুষ, তোদের দেখলে তাই মনে হয় আমার-‘

ইয়াসিন ক্ষেপে উঠে বললে, ‘কুকুরের কান্না সম্পর্কে তোর কোনো ধারণাই নেই!’

‘বললাম তো, অর্ধেক খনার বচন আর অর্ধেক পিথাগোরাস, তোরা হচ্ছিস এই মাল। দেশের ক’টা লোকে বিশ্বাস করে যে মানুষ চাঁদে গেছে? দাসত্বটা আমাদের চিরকেলে স্বভাব!’

জীবন আমার বোন (পর্ব-৬২)

১২:০০:০০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই ২০২৪

মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন। 

মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে। 

তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। 

তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক

মাহমুদুল হক

মুরাদ গায়ে মাখলো না। সে বললে, ‘রমনা রেস্তরাঁয় যাবি?’

খোকা রাজি হ’লো।

গিশগিশ করছে রমনা রেস্তরাঁ। লেকের উপর ঝুলন্ত কাঠের পাটাতনে চেয়ার টেনে বসলো দু’জন। মুখচেনা অনেকের সঙ্গেই চোখাচোখি এবং হাসি বিনিময় হ’লো খোকার; এক একজন এক একটা দল নিয়ে ব’সে আছে, ফোয়ারা ছুটছে যুক্তিতর্কের।

আড্ডা শেষ ক’রে উঠে যাচ্ছিলো প্রভাত গঞ্জালেস ও ইয়াসিন। খোকার দিকে চোখ পড়ায় ফিরে এলো আবার।

ইয়াসিন বললে, ‘থাকিস কোথায়, দেখাই পাওয়া যায় না!’

খোকা বললে, ‘ইছাপুরায় ফিরে যাসনি এখনো?’

‘আর ইছাপুরা। মানুষজন ঢাকা ছেড়ে সব গ্রামাঞ্চলে ভাগছে আর আমি গ্রাম ছেড়ে ঢাকায়, দেখি বরাতে কি জোটে!’

‘সব লীলাখেলা তো এখন ঢাকায়-‘ মুরাদ বললে, ‘গোটা দুনিয়ার চোখ এখন ঢাকার দিকে; বিশ পকেটওলা নীলপ্যান্টে পথঘাট থৈথৈ!’

গঞ্জালেস একটা হাই তুলে জড় ভাঙলো। বললে, ‘সেই দুপুর থেকে এখানে, মেরুদণ্ড টনটন করছে, আর ভালো লাগছে না-‘

তার একটা হাত ধ’রে টেনে বসালো ইয়াসিন। বললে, ‘আরে বোস বোস, তুইই এখন একমাত্র ভরসা সকলের; যাবো তো আমিও।’

‘কথাটা মন্দ বলিসনি’ মুরাদ বললে, ‘পালানোর দরকার হ’লে তোর ওখানে গিয়ে উঠবো; কলাকোপা-বান্দুরা জায়গাটাও মন্দ নয়!’

গঞ্জালেস বললে, ‘কে যে কাকে জায়গা দেবে এখন এখানে ব’সে সেকথা তোলা মুশকিল, মাথায় কাপড় তুলে আমাদেরই যে একদিকে ছুটতে হবে না একথা জোর দিয়ে কারো পক্ষে বলা অসম্ভব। ভিতরের খবর খুবই খারাপ।’

খোকা বললে, ‘তোর তো আবার সব বিদেশীসূত্রের খবর। ভাগ্যিশ কনস্যুলেটে কেরানির চাকরিটা ছিলো, তা না হ’লে দেশের ভাগ্যে যে কি ঘটতো!’

গঞ্জালেস বললে, ‘অবস্থা খুবই কেরোসিন, ঠাট্টা নয়!’

ইয়াসিন মনমরা হ’য়ে বললে, ‘দেশের অবস্থা যে খারাপ দিকে যাচ্ছে তা’ বোঝার জন্যে তোর ওই ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ ছাঁদা করার দরকার নেই, এমনিই বোঝা যায়। ইশ, সারারাত কিভাবেই না কুকুর কাঁদে! আমার শালা ঘুমই আসে না, মনে হয় একটা মড়ক লাগবে-‘

মুরাদ বললে, ‘কুকুর আমাদের ওদিকেও কাঁদে, কিন্তু এটা একটা রদ্দিমার্কা কুসংস্কার!’

ইয়াসিন চ’টে উঠলো। বললে, ‘এড়ো তর্ক করাটা তোর একটা রোগ হ’য়ে দাঁড়িয়েছে যা দেখতে পাচ্ছি; নিছক নিজের কোট বজায় রাখার জন্যে গায়ের জোরে তুই কথা বলিস। কি ক’রে জানলি এটা কুসংস্কার; অভিজ্ঞতা আছে তোর কোনো?’

মুরাদ বললে, ‘লেখাপড়া শিখে এদেশের মানুষের কোনোদিন কোনো উন্নতি হবে না, সব শালা পিছনে হাঁটা মানুষ, তোদের দেখলে তাই মনে হয় আমার-‘

ইয়াসিন ক্ষেপে উঠে বললে, ‘কুকুরের কান্না সম্পর্কে তোর কোনো ধারণাই নেই!’

‘বললাম তো, অর্ধেক খনার বচন আর অর্ধেক পিথাগোরাস, তোরা হচ্ছিস এই মাল। দেশের ক’টা লোকে বিশ্বাস করে যে মানুষ চাঁদে গেছে? দাসত্বটা আমাদের চিরকেলে স্বভাব!’