সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে আজ চতুর্থ দিনের মতো ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করছে ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’।
সারাক্ষণ ডেস্ক
গ্যাসের সংকট কাটেনি। গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। বকেয়া বিল জটিলতায় তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। কয়লা থেকে উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। তবুও বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না। এতে দুই দিন ধরে দেশের বিভিন্ন গ্রামে লোডশেডিং বেড়েছে। রাজধানী ঢাকায়ও গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে লোডশেডিং।
ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। এ দুটি সংস্থার দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, গতকাল ডিপিডিসি গড়ে ১০০ থেকে ২০০ মেগাওয়াট সরবরাহ কম পেয়েছে। এতে কোনো এলাকায় এক ঘণ্টা আর কোনো এলাকায় দুই ঘণ্টা লোডশেডিং দিতে হয়েছে।
তবে ডিপিডিসির চেয়ে বেশি ঘাটতি পেয়েছে ডেসকো। গতকাল বেলা দুইটায় ডেসকোর চাহিদা ছিল ১ হাজার ৩২৫ মেগাওয়াট। আর সরবরাহ হয়েছে এক হাজার মেগাওয়াট। এতে সব এলাকাতেই লোডশেডিং করতে হচ্ছে। গুলশান এলাকায়ও ৬১ মেগাওয়াট লোডশেডিং করেছে ডেসকো। বারিধারায় লোডশেডিং হয়েছে গতকাল ৫০ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ বিভাগ, পিডিবি ও পিজিসিবি সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট। গতকাল দিনের বেলায় সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল দুপুর ১২টায় ১৪ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট। ওই সময়ে ১ হাজার ৭৯৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে। বুধবার থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় গড়ে দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করা হচ্ছে। যদিও গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা বিতরণ সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃত লোডশেডিং আরও বেশি।
পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পিডিবির সব বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত আছে। জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এর ফলে চাহিদামতো উৎপাদন করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে শাহবাগে অবস্থান নিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এ সময় কিছু শিক্ষার্থীকে পুলিশের সাঁজোয়া যানের ওপর উঠে উল্লাস করতেও দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের এমন আচরণের পরও পুলিশ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন।
বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) বিকালে অতিরিক্ত কমিশনার গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, কোটা নিয়ে আদালতের নির্দেশনার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের অবকাশ ছিল না। তাই তাদের রাস্তায় না নামতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তারা নেমে পড়লেন। তারপরেও পুলিশ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। আশা করি আজকেই এটা (আন্দোলন) শেষ হবে। পুলিশ চায় না শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কিছু হোক। তাদেরও বোঝা উচিত। তাদেরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।
বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) বিকাল ৫টার পরে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। প্রথমে পুলিশ তাদের বাধা দেয়, পরে সরে যায়। সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শাহবাগ অবরোধ করে বিভিন্ন স্লোগানে আন্দোলন চালিয়ে যেতে দেখা গেছে। শিক্ষার্থীদের অবরোধের কারণে এখনও শাহবাগ এর আশপাশের এলাকায় যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।
দেশের ২০ জেলার ওপর দিয়ে দুপুরের মধ্যে বৃষ্টি অথবা বজ্রবৃষ্টিসহ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
শুক্রবার (১২ জুলাই) ভোর ৫টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত দেশের নদীবন্দরগুলোর জন্য দেওয়া আবহাওয়ার পূর্বাভাসে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, টাঙাইল, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, মাদারীপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং সিলেট দক্ষিণ অথবা দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
এসব এলাকার নদীবন্দরগুলোকে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা কিছুটা হ্রাস পেতে পারে
ভারত ও চীনের কাছ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নতুন কোনো অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি পায়নি বাংলাদেশ। নতুন অর্থবছরের শুরুতেও আঞ্চলিক প্রতিবেশী ও বন্ধু হিসেবে বিবেচিত দেশগুলোর কাছ থেকে তেমন কিছু মেলেনি। যদিও সরকার এখন ডলার সংকট কাটাতে বৈদেশিক ঋণে ব্যাপক মাত্রায় গুরুত্ব দিচ্ছে। নতুন সরকার গঠনের পরই প্রধান দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনে প্রথম দুই দ্বিপক্ষীয় সফর করেছেন সরকারপ্রধান। বর্তমান সরকারের অন্যতম রাজনৈতিক সমর্থক দেশ দুটি থেকে অর্থনীতির চলমান দুঃসময়ে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তার প্রত্যাশাও ছিল। কিন্তু অর্জনের ঝুড়িতে যোগ হয়েছে খুবই নগন্য। শুধু চীন থেকে এসেছে কেবল ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) রেনমিনবি বা ইউয়ান (১ হাজার ৬১৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ) সহায়তার প্রতিশ্রুতি। যদিও সফরের আগে শুধু চীন থেকেই প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তার ঘোষণার প্রত্যাশা ছিল বলে বিভিন্ন উৎসে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর সফর চলাকালে বাংলাদেশকে এ ১০০ কোটি রেনমিনবি অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দেন চীনের প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াং। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ গতকাল বেইজিংয়ে সাংবাদিকদের এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান। যদিও দেশটি থেকে শুধু বাণিজ্য সহায়তাই প্রত্যাশা করা হচ্ছিল ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ। এর সঙ্গে বাজেট সহায়তা ও মেট্রোরেল, ভাঙ্গা-বরিশাল রেললাইনসহ কয়েকটি বড় প্রকল্পে অর্থায়ন যুক্ত করে সব মিলিয়ে মোট ২০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থায়নের প্রত্যাশা করছিল বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক ভূ-অর্থনীতির পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রলম্বিত অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে দুই বন্ধু দেশের কাছ থেকে অর্থ সহায়তার বড় প্রত্যাশা তৈরি হলেও প্রাপ্তির পালে হাওয়া লাগেনি। তারা মনে করছেন, দেশ দুটি থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী দৃশ্যত তেমন কোনো অর্জন হয়নি। বিষয়গুলো নিয়ে যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান করে এর ভিত্তিতে দেশের ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অর্থ সহায়তা দেয়ার পেছনে দাতা দেশগুলোরও এক ধরনের প্রত্যাশা থাকে। দুই দেশের এসব প্রত্যাশার জায়গায় সামঞ্জস্য এলেই অর্থের আদান-প্রদান ঘটে। তিস্তাসহ কৌশলগত কিছু কারণে এমনটা ঘটতে পারে। দুই পক্ষ হয়তো একমত হতে পারেনি। তাই প্রত্যাশা অনুযায়ী দৃশ্যত তেমন কোনো অর্জন হয়নি।’
এদিকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে চীন ও ভারত থেকে নতুন অর্থায়নের কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না। অর্থবছরের শেষ মাস জুনেও দেশ দুটি থেকে নতুন কোনো অর্থায়নের খবর পাওয়া যায়নি। সে অনুযায়ী, গত এক বছরে চীন ও ভারত থেকে নতুন কোনো অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি আসেনি।
দেশের প্রলম্বিত অর্থনৈতিক চাপ থেকে পুনরুদ্ধারে বন্ধু দেশগুলোর কাছ থেকে বড় অর্থায়ন পাওয়ার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে অভিমত দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীরের। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দেশ দুটির সঙ্গে সংবেদনশীল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সৃষ্টিকারী কৌশলগত ও নিরাপত্তাবিষয়ক সমাধান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক কিংবা প্রকল্প ও ঋণ সহায়তার আশা পূরণ হয়নি। কেন এমনটা হয়েছে এটা গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। সেভাবেই দেশের ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণ করা উচিত।’
বাংলাদেশের তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে অনেক আগে থেকেই আগ্রহ দেখিয়ে আসছে চীন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে নয়াদিল্লির পক্ষ থেকেও তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। ওই সময় ভারত প্রকল্পটির দায়িত্ব পেতে পারে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে এমন ইঙ্গিত আসে। চীন হয়তো এ কারণেই বাংলাদেশকে বড় ধরনের অর্থ সহায়তা দেয়া থেকে পিছিয়ে এসেছে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চীন যা দেবে তা ১৫০ মিলিয়ন (১৫ কোটি) ডলারেরও সমান হবে না, যা হতাশ হওয়ার মতো চিত্র। তিস্তা প্রকল্পে চীন আর নেই এটা বেইজিং সফরের আগেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। চীন হয়তো এ কারণেই অর্থায়ন থেকে পিছিয়ে গেছে। চীন যদি মনে করে বাংলাদেশকে চাপে রাখলে লাভ হবে, তাহলে তারা তা-ই করবে।’
দেশের চীনপন্থী রাজনীতিবিদদের দাবি, তিস্তা প্রকল্পে ভারতকে জড়িত করার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তিস্তা প্রকল্পে চীন অর্থায়ন করলে টাকার অভাব হতো না। ভারত এত টাকা দিতে পারবে? ভারতকে খুশি করতে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিলাম আমরা। তিস্তা নিয়ে জাতীয় স্বার্থে শক্ত অবস্থান নেয়া সময়ের জরুরি দাবি ছিল।’
চীন ও ভারতের পক্ষ থেকে অতীতে করা ঋণ সহায়তার সব প্রতিশ্রুতির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। দেশ দুটির সঙ্গে বেশকিছু চুক্তি সই ও প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও সেগুলো বাস্তবায়ন ও অর্থছাড়ে ধীরগতির অভিযোগ রয়েছে ঢাকার।
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে স্বাক্ষরিত হয় ‘স্ট্রেংদেনিং অ্যান্ড প্রডাকশন ক্যাপাসিটি কো-অপারেশন’ শীর্ষক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ)। ওই চুক্তির আওতাভুক্তসহ নানা খাতে সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দেন শি জিনপিং। ওই এমওইউর আওতায় বাংলাদেশে চীনা ঋণে মোট ২৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু পরে ১০টি প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও অধিকাংশই আলোর মুখ দেখেনি।
ভারত তিনটি লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) অধীনে বাংলাদেশকে ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০১০ সালে দুই দেশের মধ্যে প্রথম এলওসি চুক্তি হয়। পরে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে আরো দুটি এলওসি চুক্তি হয়। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত এসব চুক্তির বিপরীতে অর্থায়ন মিলেছে দেড় বিলিয়ন ডলারের কম। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় চুক্তির বিপরীতে অর্থছাড় ধীরে হচ্ছে। চুক্তির শর্ত নিয়েও রয়েছে জটিলতা। এসব চুক্তির শর্ত নিয়ে বেশ কয়েকবার দরকষাকষিও করতে হয়েছে ঢাকাকে। এবারের সফরেও চুক্তির শর্ত শিথিল করা নিয়ে আলোচনা হলেও চূড়ান্ত কোনো পরিবর্তনের ঘোষণা সামনে আসেনি।
প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত ও চীন সফরের অর্থনৈতিক গুরুত্বের চেয়ে রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি বলে মনে করছেন সরকারের সাবেক নীতিনির্ধারকরা। এ বিষয়ে সরকারের সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভারসাম্য বজায় রাখা ও দরকষাকষির সক্ষমতা বাড়াতে এবারের দুটি সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রিজার্ভ সংকটের এ সময়ে ১ বিলিয়ন রেনমিনবির সহায়তাও কম না। পাশাপাশি চলমান প্রকল্পগুলো রয়েছে। আর ভারতের কাছ থেকে বেশি প্রত্যাশা করেও লাভ নেই। কারণ তাদের পক্ষে বিশাল আকারে অর্থায়ন করা সম্ভব না।’
দুই বছর ধরেই দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। টাকার মান ধরে রাখতে গিয়ে দেশের রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ নেমে এসেছে ১৬ বিলিয়ন ডলারে। মূল্যস্ফীতির হার দুই বছর ধরেই ৯ শতাংশের ওপরে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে গিয়ে সুদের হার উঠে গেছে ১৪ শতাংশের ওপরে। এমন অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে আওয়ামী লীগ নতুন করে সরকার গঠনের পর বাজেট সম্প্রসারণের পথ থেকে কিছুটা সরে এসেছে বাংলাদেশ। এ অর্থবছরের সংকুচিত বাজেটেও ঘাটতি ব্যয় মেটাতে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণের পরিকল্পনা করেছে সরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহুল আলোচিত চীন সফর শেষ হয়েছে। কিন্তু সফরটিকে ঘিরে সৃষ্ট আলোচনা এবং পর্যবেক্ষণ থামেনি। বরং সেটি আরও বিস্তৃত হয়েছে। দেশি-বিদেশি বোদ্ধারা এখন সফরটির আউটকাম বিশ্লেষণ করছেন। রিজার্ভ সংকটসহ বাংলাদেশের নানামুখি চ্যালেঞ্জের এই কঠিন সময়ে উন্নয়নবন্ধু চীনের ব্যাপক অর্থনৈতিক সাপোর্ট প্রত্যাশা করেছিল ঢাকা। অবশ্য সেই প্রত্যাশার পারদ তুঙ্গে তুলেছিল চীনই। বেইজিং প্রধানমন্ত্রীর সফরকে সম্পর্কের ‘গেমচেঞ্জার’ বলে আগাম মন্তব্য করেছিল। তাছাড়া গত ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের সাইড লাইনে আচমকা চীনা প্রতিনিধি বাণিজ্য সহায়তা হিসাবে বাংলাদেশকে ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ চীনা মুদ্রা প্রদানের প্রস্তাব করেন। যা নিয়ে গত চার মাস ধরে নেগোসিয়েশনে কাটায় দুই দেশ। পররাষ্ট্র সচিবের বেইজিং সফরে এবং ইআরডি’র সঙ্গে সিরিজ বৈঠকে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়।
সেই আলোচনার সূত্র ধরেই বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ইউয়ান সহায়তা পাচ্ছে বলে গত ৩রা জুলাই ব্লুমবার্গকে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। সেইসঙ্গে বাজেট সাপোর্ট হিসাবে বাংলাদেশ চীন থেকে আরও ২ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ইউয়ান আশা করছে বলে জানায় সেগুনবাগিচা। ধারণা দেয়া হয়, সরকার প্রধানের সফরে এসবের বিষয়ে ঘোষণা আসবে। কিন্তু না, দু’টি প্রস্তাবের বিষয়েই অস্পষ্টতা থেকে গেছে। অবশ্য চীনের তরফে ১০০ কোটি ইউয়ান সহায়তার একটি স্বতন্ত্র ঘোষণা এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজেট সহায়তায় ২০০ কোটি ডলার পাওয়ার প্রস্তাবটি দিয়েছিল ঢাকা। সেটি না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ চীন কাউকেই এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের বাজেট সহায়তা দেয়নি। তবে যে ৫০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য সহায়তার প্রস্তাব চীন দিয়েছে সেটির নেগোসিয়েশন এখনো বাকি। অর্থাৎ শর্ত কাটছাঁট করে এটি পাওয়ার সুযোগ আছে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের অর্জন বিশ্লেষণ করেছে দেশটির সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া গ্লোবাল টাইমস। তারা হাই প্রোফাইল ওই সফর নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন করেছে। তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে চীনের সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে বলে উল্লেখ করা হয়। এক্ষেত্রে তীব্র ভূ-রাজনৈতিক ‘গেম’ এর বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশ্লেষকদের উদ্ধৃত করে বলা হয়, বাংলাদেশ যদি দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি করতে চায় তাহলে অবশ্যই চীনের সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু তীব্র ভূ-রাজনীতির খেলার মধ্যে পড়ে গেছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশ। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা পেতে ঘনিষ্ঠ হওয়া দেশগুলোর ওপর অপরিহার্যভাবে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা চাপ বাড়াচ্ছে। সাংহাই একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনের রিসার্চ ফেলো হু ঝিয়োং বলেন, যখনই দক্ষিণ এশিয়ান কোনো নেতা চীন সফরে আসেন, তখন সবসময়ই নানা অজুহাতে বাধা সৃষ্টি এবং প্রচারণা শুরু করে ভারত। কিন্তু নয়াদিল্লির অতিমাত্রায় উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয় যে, চীনের সঙ্গে অন্য দেশের যোগাযোগ বা ঘনিষ্ঠতার কারণে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের ফলে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন হবে দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক। বুধবার চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তিনি বলেন, তৃতীয় কোনো পক্ষকে টার্গেট করবে না চীন-বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নয়ন। লি কিয়াং বলেন, চীন সবসময়ই ‘জিরো-সাম’ গেমের বিরোধী এবং চীনের অবস্থান হলো পারস্পরিক সুবিধা ও সহযোগিতার পক্ষে। তিনি আরও বলেন, জটিল ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কৌশলগত পছন্দকে সম্মান করে চীন। অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্কে বেইজিংয়ের যে আপত্তি নেই তা-ও খোলাসা করেন তিনি। চীনের আন্তর্জাতিক সম্প্রচারমাধ্যম সিজিটিএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই দেশ তাদের সম্পর্ককে একটি ‘বিস্তৃত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বে’ উন্নীত করেছে। চীনের প্রেসিডেন্টের বক্তব্যকে প্রাধান্য দিয়েই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের সরকার প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে শি বলেন, ১৯৭৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুই দেশ সব সময় পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রেখেছে ও পরস্পরকে সমর্থন দিয়েছে। একে অপরের সঙ্গে সমতাপূর্ণ আচরণ করেছে ও সমলাভের ভিত্তিতে সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। বৈশ্বিক দক্ষিণের (গ্লোবাল সাউথ) দেশগুলোর মধ্যে চীন-বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ও পারস্পরিক উপকারী অংশীদারিত্বের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ বলে উল্লেখ করেন শি। সিজিটিএন’র প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী বছর ‘জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের বর্ষকে (ইয়ার অব পিপল-টু-পিপল এক্সচেঞ্জস)’ সামনে রেখে দুই দেশকে সংস্কৃতি, পর্যটন, সংবাদমাধ্যম ও খেলাধুলার মতো খাতে বিনিময় এবং সহযোগিতা বাড়াতে চেষ্টা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন শি। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে এবং জাতিসংঘ ও অন্যান্য বহুপক্ষীয় কাঠামোর মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা জোরদার করতে চীন প্রস্তুত বলেও জানান তিনি।
Leave a Reply