মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
লুলু চৌধুরী বললে, ‘তবু যাহোক একটা কিছু খুঁজে পেলেন শেষ পর্যন্ত, আমার আসাটা সার্থক হ’লো। সবচেয়ে মুশকিল আপনাদের মতো ধ্যানী মানুষজনকে নিয়ে; ভাঁজ খুলতে গিয়ে হাঁপিয়ে পড়তে হয়।’
‘ ধ্যানী বলতে কি বোঝাচ্ছেন?’
‘সত্যি কথা বলবো?’ বড় বড় চোখে তাকায় লুলু চৌধুরী।
‘বলবেন না কেন!’
‘যারা শুধু অপচয় করে নিজেদের, জীবনভর–‘
‘তার মানে আপনার অভিধানে মূর্খরাই ধ্যানী। আপনার সঙ্গে আমি
একমত; এই একটা ব্যাপারেই কখনো কোনো কিছু জানার দরকার হয় না।’
কিছুটা দোমনা মনে হ’লো লুলু চৌধুরীকে এক সময়। কোলের উপরে ফেলে ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফিকের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আনমনা হ’য়ে যাচ্ছে এক একবার।
লুলু চৌধুরীর দু’টি পা এতোক্ষণে চোখে পড়ে খোকার, কি ধবধবে নিটোল ও মসৃণ। মনে হয় প্রতিদিন পা দু’টি দুধে ভেজানো থাকে; এখনো লেগে আছে সর। দেহের যাবতীয় কোমলতা গড়িয়ে গড়িয়ে পায়ের পাতায় এসে জমেছে; নীলঝর্ণার কোলে একজোড়া অলৌকিক রাজহংসী যে যার নিজের শুভ্রতায় তন্দ্রাচ্ছন্ন।
মন্ত্রমুগ্ধ হ’য়ে সে তাকিয়ে থাকে; তার দু’চোখ নির্লজ্জতার সম্মোহনে আত্মহারা হয়।
প্রতিটি আঙুল যেন নিস্তব্ধতার এক একটি ঠোঁট, মনে হয় একদিন এদের ভাষা ছিলো; প্রতিটি নখ যেন এক একটি মিজরাব, অসংখ্য অদৃশ্য তারে বিলোল আলস্যে মৃদু মৃদু সুর তুলে চলেছে, নৈরাকার স্মৃতির মতো অবিরল শিথিল অবসাদে এক একটি দিব্য মূর্ছনা অর্ঘ্য হ’য়ে ঝরে পড়ছে নাস্তিগর্ভে।
খোকার চোখ তার অতল মুগ্ধ সরোবরে অলৌকিক রাজহংসীদ্বয়কে এইভাবে অবগাহন করায়; তৃপ্ত হয়।
রৌদ্রের তেজ বাড়ছে বাইরে, আকাশের দিকে তাকালে চোখ ঝাঁ ঝাঁ করে। জানালার পর্দা গোটানো ছিলো, টেনে দিতে গিয়েও কি মনে ক’রে আবার ফিরে আসে খোকা; ব’সে সিগ্রেট ধরায়।
‘কেমন ভদ্রলোক আপনি, অফার করবেন না?’
প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে খোকা বললে, ‘চলে নাকি আপনার?’
‘কখনো-সখনো, তবে নেশা নেই। ভালোই লাগে–‘ আলতোভাবে আঙুলের ফাঁকে সিগ্রেট ধরিয়ে লুলু চৌধুরী বললে, ‘আমার কোনো প্রিজুডিস নেই–‘
‘এবার চায়ের কথা বলি বরং–‘
‘আমি ভেবেছিলাম ঠাণ্ডা বিয়ারের কথা বলবেন!’ আঁচল সামলাতে সামলাতে চটুল ভঙ্গিতে লুলু চৌধুরী বললে, ‘এক্কেবারে রসকষ নেই
আপনার।’
খোকা বললে, ‘ঘরে আমার একটি গার্জেন আছে, মেনে চলতে হয় ওকে। ওসব জিনিশ ঘরে তুলতে দেখলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে ছাড়বে। আপনার কিন্তু বিয়ার ছোঁয়া উচিত নয়
‘চামদড়ি হ’য়ে থাকতে বলেন নাকি, চর্বির কথা বলছেন তো??
‘তাই–‘
নিজের দিকে অগোছালো দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে লুলু চৌধুরী কৌতুক ক’রে বললে, ‘ছিটেফোঁটা মেদ থাকা তো ভালই; আমারটা কি খুবই দৃষ্টিকটু?’
‘এমন মুশকিল আপনাকে নিয়ে-‘
‘মুশকিল কিসের, সত্যিকথা বলতে আপনার এতো সঙ্কোচ কেন? এরপর আপনার হাতের জন্যে দু’সেট রেশমি চুড়ি আনার কথা ভাবতে হবে।’
‘এর চেয়ে বেশি হ’লে আপনি আড়াল হ’য়ে যাবেন–‘
এ্যাশটের উপর ঝুঁকে আধপোড়া সিগ্রেট গুঁজে দেবার সময় লুলু চৌধুরীর স্খলিত আঁচল মেঝের কার্পেটে ঝ’রে পড়লো। একফালি আঁটো চোলির কারাযন্ত্রণায় গুমরানো স্তনদ্বয়কে ভীষণ দুঃখিত মনে হয় খোকার! অসাধারণ লজ্জায় নিদারুণ বিস্মৃতির ভিতর জগতের এই একমাত্র উজ্জ্বল দুঃখে অঞ্জলি পূর্ণ ক’রে চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
‘এবার উঠা যাক-‘
‘উঠবেন?’
‘অনেক বোর করলাম আপনাকে!’
‘অনেক–‘
‘আমি কিন্তু আবার আসছি।’
পায়ে পায়ে গেট পর্যন্ত এগিয়ে গেল খোকা। বললে, ‘একটু পরে আমাকেও বেরুতে হবে, আসুন তাহলে–‘
ফিরে এসে ঝটপট স্নানাহার সেরে ফেললে খোকা। একটা সিগ্রেট ধরিয়ে আয়েশ ক’রে বিশ্রাম নিলো কিছুক্ষণ, তারপর বেরিয়ে পড়লো মতিঝিলের উদ্দেশ্যে।
Leave a Reply