রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি
জামাইবাড়ির দেশের সোয়ারি বেহারা। ভালোমতো আদর-যত্ন করিলে সে দেশে যাইয়া এদেশের সুনাম গাহিবে। বাড়ির গাইয়ের সের দুই দুধ, ৩০/৪০টি মিঠা গাছের আম, কলা, গুড় আর চিড়ামুড়ি দিয়া নানি তাহাদের নাস্তা করিতে দিলেন। নাস্তা শেষ হইলে পিতলের হাঁড়িতে চাল ডাল নুন মরিচ আর মাগুর মাছ দিলেন রান্না করিতে। নাস্তা খাইয়া বেহারারা বলে, আর পাক করিব না। এত খাইয়াছি যে এরপর আর ভাত খাইবার পেটে জায়গা নাই। কিন্তু কে শুনিবে সে কথা। কুটুম্ববাড়ির দেশের লোক। খাতির করিলে খাতির রাখিতেই হইবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেহারারা পাক করার সমস্ত বন্দোবস্ত করিতে লাগিল। বেহারাদের পাকের এই সময়টুকু নানির কাছে বড়ই মূল্যবান। যতটা সময় মেয়েকে চোখের সামনে ধরিয়া রাখিতে পারেন। বেহারাদের আরও একটা পদ বানাইতে দাও। দুইটা কুমড়ার ফুল ছিঁড়িয়া আনিয়া নানি বলেন, তেল দিয়া ভাজিয়া লইও। বাড়ির জাঙলায়-কনে-সাজানি শিম। এই প্রথম তুলিলাম। একটা নিরামিষ তরকারি করিয়া লও।
দেখিতে দেখিতে নানাবাড়ি ভরিয়া গেল। গরীবুল্লা মাতবরের বউ তার মেয়েকে লইয়া আসিল। ফেলি আসিল, আছিরন আসিল। মিঞাজানের বউ, মোকিমের বউ, তাহেরের মা, পাড়ার সমস্ত মেয়ে আসিয়া নানির বাড়িতে ভাঙিয়া পড়িল। আজ রাঙাছুটু বাপের বাড়ি হইতে শ্বশুরবাড়ি যাইবে। এ যে বাঙালিজীবনে যুগ-যুগান্তরের বিয়োগান্তক ঘটনা। এ দেশের কবিরা কতকাল ধরিয়া এই কারুণ কাহিনী নানা গাথায়, কবিতায়, গানে লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। এ বিয়োগ-বেদনা যে এদের, ওদের, তাদের সকলের। তাই একের ঘরের বেদনার সঙ্গে নিজের বেদনাকে মিলাইয়া ক্ষণেক সান্ত্বনা পাইবার ব্যর্থ প্রয়াস।
মাকে সামনে বসাইয়া নানি খাওয়াইতে বসিলেন। এটা/ওটা কত কি নানি রাঁধিয়াছেন। মা খাইতে চাহেন না। নানি বলেন, “মারে, কত দূরে যাইবি। পথে ক্ষুধা পাইবে। এই তরকারিটা আরও একটু খা। এই পিঠাটা তো তুই মুখেও দিলি না। তুই ভালোবাসিস কুশলী পিঠা। তাই বানাইয়াছি। নে, আর একটা মুখে দে।” “মা। তুমি আর জোর করিও না। দেখিতেছ না আর খাইতে পারিতেছি না।”
মা যে আজ খাইতে পারিবে না নানি তা জানেন-ভালোমতোই জানেন। নানিও তো একদিন এমনি করিয়া বাপের বাড়ি হইতে বিদায় হইতেন। তবু পীড়াপীড়ি না করিলে যে আজ মন ভরে না।
চলবে…