গ্রাম্য-মামলা
পূর্বেই বলিয়াছি আমার পিতার অবস্থা ভালো ছিল না। মাত্র সাত টাকা বেতনে তিনি ফরিদপুর হিতৈষী মাইনর স্কুলে মাস্টারি করিতেন। সামান্য যা জমিজমা ছিল তাহার ফসল হইতে আমাদের ছয় মাসের মাত্র খোরাক হইত। বাকি ছয় মাসের খরচ তাঁহাকে মাস্টারির বেতন ও মোল্লাকির আয় হইতে চালাইতে হইত। আমাদের গ্রামের কয়েকজন বর্ধিষ্ণু লোকের সঙ্গে বাজানের একটি বড় মামলা হওয়ায় (সেই মামলার কথা পরে বলিব) তাঁহার হাত হইতে গ্রামের মোল্লাকি ছুটিয়া গেল। ইহাতে বাজানের আয় আরও কমিয়া গেল। এই সময়ে বাজানকে দেখিয়াছি, ঘুমের ঘোরে আমাদের অভাব-অনটনের কথা বলিতেছেন।
চুপ করিয়া বসিয়া বসিয়া কোনো কোনো দিন তিনি জোরে জোরে চিন্তা করিতেন, কোথায় যাইব। কার নিকট হইতে টাকা ধার করিব? আজ চাউল না কিনিলে তো চলিবে না। জমিজমা লইয়া মাঝে মাঝে আমার পিতাকে মামলা করিতে কাছারি যাইতে হইত। খুব
ভোরে উঠিয়া তিনি পাস্তাভাত খাইয়া উকিলের বাড়ি যাইতেন। সেখান হইতে আর খাইবার জন্য বাড়ি ফিরিয়া আসিতেন না। সরাসরি কাছারিতে চলিয়া যাইতেন। সেকালে কাছারিতে মামলায় জিতিয়া কোনো কোনো লোক বন্ধুবান্ধবদের মিষ্টি খাওয়াইতেন। বাজানকে এরূপ মিষ্টি দিলে তাহা তিনি না খাইয়া কলার পাতায় জড়াইয়া আমাদের জন্য লইয়া আসিতেন। আমরা কয়েক ভাই মহা কলরবে সেই অল্প পরিমাণ মেঠাই খাইয়া শেষ করিয়া কলার পাতাটি পর্যন্ত চাটিয়া খাইতাম। আজ ভাবিতে দুই চক্ষু ভারাক্রান্ত হয়, সারাদিন অভুক্ত থাকিয়া দারুণ ক্ষুধার সময়ে পাওয়া সেই মিষ্টিটুকু তিনি নিজে না খাইয়া আমাদের জন্য লইয়া আসিতেন। সন্তানের জন্য এমন সর্বস্বত্যাগী পিতার দেখা কি আর জীবনে পাইব?
আজ ভাসাভাসা মনে পড়িতেছে। মামলা-মোকদমার সময় কত দিন বাজান রাত দশটা-এগারোটার সময় বাড়ি ফিরিয়াছেন। নানার মৃত্যুর পর তাঁর গাভী দুইটি আমরা পাইয়াছিলাম। সেই গাভী দুইটিকে মাঠে বাঁধিয়া দিয়া বাজান স্কুলে যাইতেন। স্কুল হইতে ফিরিয়া আসিয়া তাহাদিগকে মাঠ হইতে আনিয়া ঘাস পানি দিয়া ঘরে বাঁধিতেন। আমি এবং আমার বড় ভাই এই গাভী দুইটির কোনোই তালাশ লইতাম না। মামলা-মোকদমার সময় বাজান রাত দশটা-এগারোটার সময় অভুক্ত অবস্থায় বাড়ি আসিয়া গাই দুইটি আনিবার জন্য মাঠে ছুটিতেন। কত দিনের কথা মনে পড়িতেছে। মুষলধারে বৃষ্টি হইতেছে। ঘন ঘন বজ্রপাত হইতেছে। অনেক রাত্রে বাজান বাড়ি ফিরিয়া সেই ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই গরু দুইটিকে আনিবার জন্য মাঠে ছুটিতেছেন। আমরা বাজানের এইসব কাজে কোনো সাহায্যই করিতাম না। এজন্য আমাদের প্রতি বাজানেরও কোনো অভিযোগ ছিল না।
আমার চাচাতো ভাই নেহাজদ্দীন সাংসারিক কাজে তার বাপ-চাচাদের সাহায্য করিত। কিন্তু বাজান আমাদিগকে দিয়া কোনো সাংসারিক কাজই করাইতেন না। তাঁহার ধারণা ছিল সাংসারিক কাজ করাইলে আমাদের লেখাপড়া হইবে না। একবার বাজান একটি বড় মামলায় জয়লাভ করেন। এই মামলায় আমাদের গ্রামের পাঁচ-ছয় জন বর্ধিষ্ণু লোক আমাদের বিপক্ষে ছিল। বাজানের খুব অন্তরঙ্গ যে হানিফ মোল্লা আর কাজেম মোল্লা তাঁহারাও বাজানের বিপক্ষে গেলেন। সামান্য স্বার্থ কি করিয়া মানুষকে পর করিয়া দেয় এই ঘটনা তাহার একটি প্রমাণ। এই এতগুলি প্রভাবশালী লোক আমাদের বিপক্ষে যাওয়ায় গ্রামে আমাদের সপক্ষে কেহই রহিল না। তাই এই মামলায় সাক্ষী দেওয়ার জন্য নদীর ওপার হইতে লোক সংগ্রহ করিয়া আনিতে হইল।
মামলার আগের দিন বাজান তাহাদিগকে ডাকাইয়া আনিয়া হাকিমের সামনে কে কোন কথা বলিবে ভালোমতো শুনিয়া লইতেন। তারপর জেরার সময় বিপক্ষের উকিল কি কি জিজ্ঞাসা করিবে তাহা অনুমান করিয়া সাক্ষীদিগকে প্রশ্ন করিতেন। তাহাদের উত্তর যদি আমাদের অনুকূলে না হইত তখন কি বলিতে হইবে তাহা তিনি বারবার সাক্ষীদিগকে শিখাইয়া দিতেন।
চলবে…