কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের এই একতরফা আত্মসমর্পণ নিছক একটি ম্যাচ হার নয়—এটা আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত সমস্যার নগ্ন প্রকাশ। শ্রীলঙ্কা ৩০২ রান করে বাংলাদেশের সামনে যে পাহাড় গড়ে তোলে, সেটি কেবল স্কোরবোর্ডের পার্থক্য নয়; আসলে দুই দলের মানসিকতা, প্রস্তুতি আর পরিকল্পনার ব্যবধান।
বাংলাদেশ ১৬০ রানে অলআউট হয়ে ১৪২ রানে ম্যাচ হারল, যা ৫০ ওভারের ক্রিকেটে অপমানজনকই বলা যায়। এই পরাজয় বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রশাসন থেকে শুরু করে খেলোয়াড়দের মানসিকতা পর্যন্ত নতুন করে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
ব্যাটিং মানসিকতার ভঙ্গুরতা
এবারও দেখা গেল টপ-অর্ডারের সেই চিরচেনা বিপর্যয়। শুরুতেই লিটন দাস ও তানজিদ হাসান ছয় ওভারের মধ্যে বাজে শটে আউট হয়ে যান। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তও দায়িত্বহীন শটে ৭ রানে বিদায় নেন।
মিডল-অর্ডার বলতে মুশফিকুর রহিম আর সাকিব আল হাসান—দুই অভিজ্ঞ খেলোয়াড়—কিন্তু তারাও ব্যর্থ। মুশফিক অস্বস্তিতে ১২ রানে আউট, সাকিব আবার এলবিডব্লিউ হন ১৫ রানে।
এগুলো নিছক ব্যক্তিগত ভুল নয়। এটা দলগত মানসিক প্রস্তুতির ব্যর্থতা। ৩০৩ রান তাড়া করা কঠিন হলেও ভেঙে পড়া মানসিকতা আসল সমস্যার নাম।
বোলিংয়ের দিশাহীনতা ও পরিকল্পনার অভাব
শ্রীলঙ্কার ইনিংসে শেষ ১০ ওভারে ৯৮ রান এসেছে। বাংলাদেশের বোলারদের ইয়র্কার নেই, স্লোয়ার নেই, সঠিক লাইন-লেংথ নেই। তাসকিন-শরিফুলরা বারবার ফুলটস-হাফভলি উপহার দিয়েছেন।
স্পিনার মেহেদী মিরাজ বা নাসুম আহমেদও কোনো চাপ তৈরি করতে পারেননি। মিডল ওভারে সিঙ্গেল-ডাবল আটকানোর জন্য পরিকল্পিত ফিল্ডিং বা বোলিং দেখা যায়নি।
শ্রীলঙ্কার ইনিংস দেখলে বোঝা যায় তারা স্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে খেলেছে। অথচ বাংলাদেশের বোলিং পরিবর্তনগুলো ছিল প্রতিক্রিয়াশীল।
ফিল্ডিংয়ের ভয়াবহ চেহারা
যতবারই বলা হোক, বাংলাদেশের ফিল্ডিং উন্নত হচ্ছে—আবারও দেখা গেল সেটি ভাষার ফুলঝুরি মাত্র।
ড্রপ ক্যাচ, ওভারথ্রো, মিসফিল্ড—সবই ছিল। অন্তত ২০–২৫ রান এভাবে অতিরিক্ত দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন মান ফিল্ডিং করলে ম্যাচ জেতা তো দূরে থাক, সম্মান রক্ষাও কঠিন।
অধিনায়কত্ব ও টিম নির্বাচনে প্রশ্ন
অধিনায়ক শান্তর নেতৃত্বকৌশলও সমালোচনার বাইরে নয়। বোলিং পরিবর্তনগুলো ছিল পরিকল্পনাহীন। ফিল্ডিং সাজানোয় কোনো আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখা যায়নি। ইনিংস ধসে পড়লেও ড্রেসিংরুমে নাকি শৃঙ্খলা রাখতে পারেননি—এমন অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।
আর নির্বাচক কমিটিও দায় এড়াতে পারে না। যারা বারবার ব্যর্থ, তাদের ওপর আস্থা ধরে রাখা কি যৌক্তিক?
শ্রীলঙ্কা থেকে শেখার আছে
শ্রীলঙ্কা দেখিয়েছে কীভাবে একটি দল পরিকল্পনা, শৃঙ্খলা আর কাজ ভাগাভাগি করে সফল হয়। তাদের ব্যাটিং গভীরতা, বোলারদের বৈচিত্র্য, এবং ফিল্ডিং ইউনিট বাংলাদেশের কাছে পাঠ্যবই হয়ে থাকা উচিত।
শ্রীলঙ্কার কোচ স্পষ্ট করে বলেছেন, “দলের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ স্পষ্ট।” এ সরল বাক্যেই লুকিয়ে আছে বড় শিক্ষা।
এখন বাংলাদেশের জন্য কঠিন প্রশ্ন
- ওপেনিং জুটি গড়া যাবে কীভাবে?
- সিনিয়রদের বারবারের ব্যর্থতা মেনে নেওয়া হবে, নাকি বিকল্প খুঁজবে?
- ডেথ ওভারের বোলিংয়ে স্পেশালিস্ট তৈরি হবে কি?
- ফিল্ডিংয়ের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উঠবে কীভাবে?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—বাংলাদেশ দল কি নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ের মানসিকতা ফিরিয়ে আনতে পারবে? কলম্বোর এই ম্যাচে যেটা একেবারেই অনুপস্থিত ছিল।
একবারই জোর গলায় বলা দরকার—এখন আর কসমেটিক বদল নয়, প্রয়োজন ভিত্তিমূলক সংস্কার। নাহলে ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের পতন আরও গভীরে যাবে।