হানিফ মোল্লা
আমাদের গ্রামের হানিফ মোল্লার পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের বড়ই অন্তরঙ্গ ভাব ছিল। হানিফ মোল্লার এক ভাই কানু মোল্লা বাজানের সহপাঠী ছিলেন। কি অসুখ হইয়া কানু মোল্লা মারা যান। ছোট ভাই-এর মৃত্যুর পর আমার পিতাকে হানিফ মোল্লা আপন ভাই-এর মতো স্নেহ করিতেন। তাঁহার কোনো সন্তান-সন্ততি ছিল না। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী বড় চাচি আমাদের কয়েক ভাইকে আদর করিয়া আপনাদের বাৎসল্য-ক্ষুধা নিবারণ করিতেন।
বড় চাচির ঘরে কোলাভরা মুড়ি-মুড়কি থাকিত। তাহা ছাড়া তিলের পাটালি, লাডু-বাতাসাও হাঁড়িতে ভরা থাকিত। আমরা গেলে অতি আদরের সঙ্গে তিনি সেসব আমাদিগকে খাওয়াইতেন। আমাদের বাড়িতে ফলবান কোনো গাছ ছিল না। তাঁহাদের বাড়িতে বড় বড় আমগাছ জড়াইয়া আম ধরিত। সেই আমের অধিকাংশই আমরা খাইতাম। হানিফ মোল্লার বাড়িটি আরও নানা কারণে আমার নিকট রহস্যময় লাগিত। তাঁহার একখানা বড় নৌকা ছিল। সেই নৌকায় করিয়া গ্রামের বেপারীরা দেশ-দেশান্তরে ব্যবসা করিতে যাইত। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে যখন গাঙে নতুন পানি দেখা দিত তখন বচন মোল্লা বেপারী, তাঁর ভাগীদের সঙ্গে করিয়া নদীর তলা হইতে সেই বড় নৌকাখানা তুলিতেন। ৭/৮ দিন ভাগীরা নানা গল্প ও গান করিতে করিতে সেই নৌকায় গাবপানি দিত, পুরাতন ছইখানা মেরামত করিত। আমি সেখানে যাইয়া সেইসব গদ্য ও গান শুনিতাম।
কাজেম ফকির ছিল এই নৌকার ভাগীদের মধ্যে সবচাইতে বয়স্ক। বচন মোল্লা নৌকার মূল বেপারী। তাঁর কোমরে বাঁধা থাকিত মহাজনের টাকার খুতি। কাজেম ফকির ছিল বচন মোল্লার দক্ষিণ হস্ত। বচন মোল্লা হাল ধরিয়া পিছনে বসিতেন। কাজেম ফকির থাকিত আগা নৌকায় একটা লগি হাতে করিয়া। পদ্মা-যমুনা-মেঘনা নদীর কোনখানে কত পানি তা তার নখদর্পণে। তাহা ছাড়া নদীর স্রোত ও ঢেউ দেখিয়া সে পানির গভীরতা বুঝিতে পারিত। যেখানে চাচুড়ের ধার, সেইখানেই বালুয়ার চর। এইরূপ নদীর স্রোতের কত ছড়াই সে জানিত। নৌকায় আর-আর ভাগীরা যখন ছই-এর সলা এবং বাখারি চাঁছিতে ব্যস্ত, সে তখন তার বিগত বাণিজ্য-জীবনের কাহিনী বলিত। এক দেশে যাইয়া তাহারা দেখিল মেয়েলোকে ক্ষেত-খামারের কাজ করে-মেয়েলোকে হাটে-বাজারে যায়। পরনে সামান্য কয়েক আঙুল বস্ত্র। আর সমস্ত গা উদলা। কাজেম ভাগীদের বলিয়া দিল, “খবরদার! কেহ নৌকা ছাড়িয়া কেনারায় যাইবি না।” একজন ভাগী কথা শুনিল না। সেই যে সে তীরে নামিয়া গেল, আর ফিরিল না।
এক দেশে যাইয়া দেখি নৌকায় চাউল ঝাড়ার কুলা নাই। একজন ভাগীকে পাঠাইলাম, তীরের কোনো বাড়ি হইতে একখানা কুলা লইয়া আয়। ভাগী যাইয়া কোনো বাড়ির একটি মেয়েকে বলিল, “মা জননী। তোমাদের কুলাখানা দাও। আমরা চাউল ঝাড়িয়া আবার ফেরত দিব।” শুনিয়া মেয়েটি ঝাঁটা উচাইয়া তাহাকে মারিতে আসিল। “আরে গোলামের বেটা। তুই আমাকে তোর বাপের বউ বানাইলি কোন সাহসে?”
ভাগী ফিরিয়া আসিয়া কাজেমকে সকল বলিল। কাজেম নিজে তখন যাইয়া মেয়েটিকে বলিল, “হ্যাদে মাগি। তোর ধাপড়াখান দে থাপড়ায়ে লই।” মেয়েটি খুশি হইয়া বলিল, “আয়। আয়। লইয়া যা।” এক দেশের বুলি অন্য দেশের গালি। এইসব গল্প শুনিতে শুনিতে ভাগীরা কাজেমের নানা অভিজ্ঞতার কথা জানিয়া তাহার প্রতি আরও অনুরক্ত হইত। কাজেম যখন গল্প করিত না তখন রহিম মল্লিক উচ্চসুরে বারোমাসি গান ধরিত:
কৃষ্ণ দাঁড়ারে
আমি তোর দেখি চন্দ্র মুখরে।
কৃষ্ণ দাঁড়ারে।
ওপারকার পরাঙ্গী ধান টিয়ায় কাটিয়া নিল,
বন্ধুর আগে কইও খবর যৌবন বয়া গেলরে,
কৃষ্ণ দাঁড়ারে।
চলবে…