আর্কাদি গাইদার
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
এরপর তিমুক্কা আর আমি উঠে এলুম ফেক্কার জাহাজে। ওদিকে শত্রুর নৌসেনাদের মাথাগুলো জলের ওপর জেগে রইল।
অবিশ্যি উদারতার পরিচয় দিলুম আমরা। শত্রুর উল্টোনো জাহাজ দুটোয় পরাজিত নৌসেনাদের উঠে বসার সুযোগ দিয়ে দড়ি বেধে ও দুটোকে টেনে নিয়ে ফিরলুম। যুদ্ধজয়ের চিহ্ন আর যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে নিয়ে বিজয়গর্বে আমরা যখন বন্দরে প্রবেশ করলুম, তখন বাগানের বেড়ার ওপর সার দিয়ে-বসা বাচ্চা ছেলেরা তুমুল চিৎকার আর হর্ষধ্বনি জুড়ে দিয়েছে।
বাবার কাছ থেকে খুব কমই চিঠিপত্র পেতুম আমরা। কিন্তু যখনই চিঠি লিখতেন তিনি, তখন তাতে ঘুরে ফিরে এই একটি কথাই থাকত: ‘আমি বে’চে আছি। ভালো আছি। সব সময়ে বসে থাকি ট্রেন্ডে, কবে যে এর শেষ হবে তা দেখতে পাই নে।’
ওই সব চিঠি পড়ে আমি তো হতাশ। নাঃ, সত্যি, ভাবো একবার ব্যাপারখানা! খোদ ফ্রন্টে বসে আছেন ভদ্রলোক, অথচ মজার কিছু লেখার খুঁজে পাচ্ছেন না! আচ্ছা, একটা বেশ যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে একটা বেশ বীরত্বপূর্ণ কাজের খবর দিয়ে যেমন, একটা আক্রমণ কিংবা কোনো- চিঠি লিখতে কী হয়। ওইসব চিঠি পড়ে মনে হত, আমাদের সেই কাদামাখা হেমন্তের আজামাস শহরের চেয়েও যেন ফ্রন্টের ব্যাপারস্যাপার বেশি ক্লান্তিকর, একঘেয়ে।
অথচ অন্যেরা যেমন, ধর, মিত্কার দাদা খুদে অফিসার তুপিকভ যুদ্ধের আর বিভিন্ন বীরত্বপূর্ণ কাজের বর্ণনা দিয়ে সপ্তায় সপ্তায় বাড়িতে চিঠিই বা লেখে কী করে, ছবিই বা পাঠায় কী ভাবে? তুপিকভের পাঠানো ছবির কোনোটাতে দেখা যেত সে দাঁড়িয়ে আছে কামানের পাশে, কোনোটাতে মেসিন-গানের পাশে, আবার কোনোটাতে খোলা তরোয়াল হাতে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে। একটা ছবিতে এরোপ্লেন থেকে মাথা বের করে থাকতেও দেখা গিয়েছিল তাকে! বাবা কিন্তু কখনও ট্রেন্টে-বসা অবস্থার ছবি তোলেন নি, এরোপ্লেন থেকে মুখ বের করা তো দূরস্থান। চিঠিতে মজার কোনো ঘটনার কথাও লিখে জানাতেন না কোনোদিন।
একদিন সন্ধের দিকে কে যেন আমাদের সদর দরজায় ধাক্কা দিল। দরজা খুলতে ক্রাচে ভর দিয়ে কাঠের পা-ওয়ালা একজন সৈনিক ভেতরে এসে মায়ের খোঁজ করলেন। মা বাড়ি ছিলেন না। বললুম, শিগগিরই ফিরবেন। সৈনিকটি তখন বাবার একজন সাথী বলে নিজের পরিচয় দিলেন। বললেন, উনি আর বাবা একই রেজিমেন্টে আছেন। তখন সৈনিক-জীবন থেকে ছাড়া পেয়ে উনি আমাদের ওই জেলারই এক গ্রামে ওঁর ঘরে ফিরে যাচ্ছিলেন। জানালেন, আমাদের জন্যে উনি বাবার শুভ কামনা আর চিঠি নিয়ে এসেছেন।
উনোনের গায়ে হাতের ক্রাচটা দাঁড় করিয়ে উনি চেয়ারে বসলেন। তারপর জামার ভেতর দিকের একটা পকেট হাঁটকে বের করলেন একখানা তেলকালিমাখা চিঠি।