কৃষি ও কৃষক
চতুর্থ অধ্যায়
১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দে কোম্পানি বাৎসরিক চুক্তি তুলে দিয়ে ৫ বছর চুক্তিতে প্রকাশ্য টাউন- হলে নীলামের মধ্য দিয়ে ভূমি রাজস্ব নির্ধারণ করার ব্যবস্থা করল। বাংলার বিখ্যাত ব্যবসায়ীরা এসব জমিদারি কেনার ব্যাপারে উদ্যোগী হল। সাতক্ষীরার বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী, খাসবালান্দার মুনসী আমির, নদীয়ার পালচৌধুরী, টাকীর শ্রীনাথ মুনসীরা সুন্দরবনের জমিদারি কেনার ব্যাপারে এগিয়ে এলেন, এর সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের বংশধররাও ছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের বেনিয়ান কান্তবাবু এ সময়ে ১৪ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সুন্দরবন, মেদিনীপুর, রঙপুর এলাকার ১৯টি পরগণা লীজ নিচ্ছেন হেস্টিংস নিজে উদ্যোগী হয়ে কালেকটরদের চিঠি দিচ্ছেন to take care of kanto and prevent his raiyats from harrassing him’.
ইংরেজ আমলে এই ইজারাদারি প্রথা ১৭৯২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত চালানো হল। রাজশক্তির সহায়তায় জমিদাররা কৃষকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই ইজারাদারি প্রথাকে অনেকে বলেছেন লুটপাটের অপর নাম। আলিবর্দি খাঁ পরবর্তীকালের নবাবরা ভূমি রাজস্ব বাড়াননি; কেবলমাত্র আবয়াব বিভিন্ন সময়ে প্রজাদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে কিন্তু কোম্পানির আমলে ভূমি রাজস্বের হার ভীষণভাবে বেড়ে গেল। প্রজাদের বাধ্য করা হল মুদ্রায় ভূমি রাজস্ব শোধ করতে এবং সে যুগে মুদ্রার সঙ্কট লেগেই ছিল।
মুদ্রা সংগ্রহের জন্য প্রজারা বাধ্য হল নীলকর সাহেব কিংবা লবণের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিতে। ভূমিরাজস্বের পাশাপাশি নানারকম আবয়াব দিতে প্রজাদের বাধ্য করা হল-সেলামি, মাঙ্গন, বাটা, পার্বণী, ভিক্ষা প্রভৃতি নামে নানারকম খাজনা আদায় না করতে পেরে অনেকের জমিদারি চলে গেল কিংবা জমিদারির সীমা ছোট হয়ে গেল। হিঙ্গলগঞ্জ, ডায়মন্ডহারবার, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট প্রভৃতি এলাকা সেদিন কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারির মধ্যে ছিল কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জমিদারির সীমা খর্বীকৃত হয়ে এক-চতুর্থাংশ হয়ে গেল। খুলনা সাতক্ষীরার জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতা বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী নদীয়া রাজের করণিক ছিলেন এবং পরবর্তীকালে দেবোত্তর সম্পত্তি লাভ করেন।
১৮০৪ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ২০,০৮৯ টাকার ভূমি রাজস্বের এক বিশাল জমিদারির অধিকারী তিনি হন। সরকারি গ্রান্টের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত শহরের বেনিয়ানরা, কোম্পানির কর্মচারীরা নিত্যনতুন জমিদারির মালিকহয়ে উঠতে শুরু করে। সুন্দরবনের বিশাল বনাঞ্চল প্রতিনিয়ত বিলি করা হতে লাগল; জমি উদ্ধার করার ব্যাপারে গ্রাম্য প্রধান মোড়লদের সাহায্য নেওয়া হল; এরা বিভিন্ন এলাকা থেকে চাষিদের নিয়ে এসে জমি উদ্ধার করার কাজে লেগে গেল- এদের ভূমিকা সে যুগে অনেকটা আজকের লেবার কন্ট্রাকটরদের মতো ছিল। দূরের চাষিদের উৎসাহিত করার জন্য বাসযোগ্য ভূমি এবং নামমাত্র খাজনার লোভ দেখাল এসব গ্রাম্য মোড়লরা। মোড়লদের জমির খাজনার হার ছিল নামমাত্র এবং আরও নানা সুবিধা জমিদারের কাছ থেকে এরা পেত। এরাই প্রকৃতপক্ষে জমিদারির মধ্যে প্রধান ব্যক্তি হিসাবে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল।