কৃষি ও কৃষক
চতুর্থ অধ্যায়
তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এবং যশোরের কালেকটর হেঙ্কেল সাহেব কোম্পানির রাজত্বে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে ভূমিরাজস্ব নিয়ে যে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন পরবর্তীকালে তা বাতিল করা হল। ইংলন্ডেশিল্প পুঁজি ও বাণিজ্যপুঁজির দ্বন্দ্ব তখন তুঙ্গে-এরকম অবস্থায় কোর্ট অব ডাইরেকটরস নতুন সাম্রাজ্যকে গড়ে তোলার স্বার্থে নিশ্চিত ভূমি রাজস্বের সন্ধানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করা হলেও সুন্দরবনের জমির ক্ষেত্রে প্রথমে তা প্রয়োগ করা হল না; এক বিশাল এলাকা তখনও চাষযোগ্য করা হয়নি এটা মনে রাখা দরকার। কান্তবাবুর মত আরও অনেক উঠতি বড়লোক সেদিন জমিদারি কেনার ব্যাপারে এগিয়ে এলেন এবং আমাদের সমাজ নেতারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন।
আমাদের মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা (যদিও এর সংখ্যা সেদিন নামমাত্র) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে সমাজ জীবনে আগামী দিনে কৃষির ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তন আসতে চলেছে (Structural Change) তা দীর্ঘকাল অনুধাবন করতে পারেননি। মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের আবির্ভাব ঘটেছিল জমিদার ও তাদের আশ্রয়ে লালিতপালিত গ্রামীণ সম্ভ্রান্ত পরিবার, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মধ্য থেকে, যার জন্য প্রথম থেকে কৃষকদের সমস্যা সম্পর্কে তাদের দ্বিধা ছিল, অনেকে স্বাদেশিকতার পরিচয় দিয়েছেন, সমাজসংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, সামন্ততান্ত্রিক সমাজের কুসংস্কার দূর করার ব্যাপারে আন্দোলনে অংশও নিয়েছেন, কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে নীরবতা পালন করেছেন।
আধুনিক ভারতের প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা রামমোহন পর্যন্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে সমর্থন করেছেন যদিও খাজনা বৃদ্ধির ব্যাপারে তাঁর আপত্তি ছিল। ব্যতিক্রম ছিল না তা নয় কিন্তু সে যুগে সেটা ব্যতিক্রমই বটে। ডিরোজিও শিষ্য দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে বিকৃত করেছিলেন এবং বুঝেছিলেন খাজনা আদায়কারী জমিদারদের জমির মালিকানা দেবার মধ্য দিয়ে কৃষকের ওপর অবর্ণনীয় দুঃখ নেমে আসবে। অবশ্য পরবর্তীকালে এই দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় জমিদারি প্রথার বিশ্বস্ত সেবক হিসাবে। উত্তরপ্রদেশ জমিদার সভার নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং প্রথম জীবনের ভাবনার বিপরীত মেরুতে তার অবস্থান ঘটেছিল।
১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে অভয়চরণ দাস The Indian riyat এ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অবসান চেয়েও জমিদার ও চাষিদের উভয়পক্ষকে ক্ষতিপূরণ দেবার কথা বলেছিলেন। এমনকী বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে Land Problems of India তে ডঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় ভারতের কৃষিসমস্যার ওপর সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেও মন্তব্য করেছেন- জমিদাররা জঙ্গল ও অনাবাদী জমি উদ্ধার করে চাষের আওতায় এনেছেন তাদের নিজস্ব খরচায়। বেশ কিছুদিন এটা করতে গিয়ে প্রজাদের খাজনা মুকুব করতে হয়েছে এবং প্রজাদের প্রথম প্রথম নানাধরণের সাহায্য করতে হয়েছে, দূর থেকে প্রজাদের উৎসাহিত করে জমিদারদের খরচে তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
Sarakhon Report 



















