কৃষি ও কৃষক
চতুর্থ অধ্যায়
বারাসত- নারকেলবেড়িয়ার তিতুর বিদ্রোহকে দীর্ঘকাল ধরে ইংরেজ শাসক ও তার অনুগামীরা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বলে চালাবার চেষ্টা করেছেন। সম্প্রতিকালে বিভিন্ন গবেষক এই বিদ্রোহকে ধর্মীয় আবরণে কৃষক বিদ্রোহের মর্যাদা দিয়েছেন। বিদ্রোহ- পরবর্তীকালে হিন্দু জমিদাররা তিতুর বিদ্রোহের পিছনে হাড়োয়ার জমিদার মুনসী আমিরের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল বলে চালাবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তা প্রমাণিত হয়নি। তিতর আন্দোলন সর্বধর্মের ধনী মহাজন জমিদারদের বিরুদ্ধে ছিল তা সমকালীন বিভিন্ন রিপোর্টের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। বিদ্রোহ পরবর্তীকালে হিন্দুমুসলমানদের উভয় সম্প্রদায়ের জমিদার সুদখোর মহাজনরা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন জানিয়েছিল।(১১) কলভিন তার রিপোর্টে পরিষ্কার উল্লেখ করেছেন সরকারি প্রশাসন যন্ত্র রায়তদের ন্যায় বিচার দিতে ব্যর্থ হওয়ায় চাষিরা এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে।
এই বিদ্রোহ তৎকালীন জমিদারি ব্যবস্থার অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল। জমিদারদের সহযোগী তৎকালীন থানার দারোগারাও বিদ্রোহীদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে তিতুর লড়াই-এর মূল লক্ষ্য ছিল চাষিদের নীলচাষের চুক্তির কাগজপত্র নষ্ট করা, হিসাবের খাতা পুড়িয়ে ফেলা। ওয়াহাবি আন্দোলন, সর্বপ্রথমে ধর্মীয় ব্যাপার হলেও শেষ পর্যন্ত তা ধর্মের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে চাষীর স্বার্থের ব্যাপারটা বড় হয়ে দেখা দেয়। তাই তিতুর বিদ্রোহ স্মরণে এখনও হিন্দু-মুসলমান চাষিরা গান গায়।
তিতুর আন্দোলনের ঢেউ থামতে না থামতে ঢাকা থেকে বাখরগঞ্জ, খুলনা, ফরিদপুরের এক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে শুরু হল চাষিদের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ-ইতিহাসে ফরাজি বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ফরিদপুরের হাজি সরিতুল্লাহ এই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তীকালে তার পুত্র দুদুমিঞা নেতৃত্বে আসেন। জমিদারের খাজনা ছাড়া অন্যান্য নানাধরণের বাজে খাজনার বিরুদ্ধে চাষিদের সংঘবদ্ধ করলেন সুন্দরবনের উত্তরাংশের চাষিদের মধ্যে ১৮৫০ ৭০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে এই বিদ্রোহ বিশেষ প্রভাব ফেলে। ফরাজিরা বিভিন্ন জমিদার কাছারির ওপর আক্রমণ করত এবং একস্থান থেকে দ্রুত অন্য স্থানে সরে যেত। জমিদারদের পাশাপাশি নীলকর সাহেবরা এই আন্দোলনকে সুনজরে দেখেননি।
– ফরিদপুরের নীলকর সাহেব, খুলনার নীলকুঠির এজেন্ট এর সঙ্গে দুদু মিঞার বিবাদ শুরু হল ১৮৪২ খ্রীষ্টাব্দের দিকে। ১৮৪৬ এর ১৫ই সেপ্টেম্বর নীলকর ডানলপ দুদু মিঞার বাড়িঘর পুড়িয়ে দিল। ফরাজী চাষিরা ২৫ বছর ধরে বাংলার বিভিন্ন অংশে জমিদার নীলকুঠি এবং গ্রাম্য মহাজনদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এবং দুদু মিঞা দীর্ঘকাল কারাগারের অভ্যন্তরে থাকতে বাধ্য হন। অনেকটা কৃষকদের গেরিলা বাহিনীতে পরিণত করে লড়াই করার কৃতিত্ব ফরাজী চাষিরা দেখাতে পেরেছিলেন সে যুগে। ১৮৫৩ এবং ১৮৮৫ সালে সরকার বাধ্য হল প্রজাদের খাজনার ব্যাপারে নতুনভাবে আইন তৈরি করতে। ফরাজী বিদ্রোহ সুন্দরবনের এই প্রান্তে ১৮৫০/৫৫ এর মধ্যে স্তিমিত হয়ে এল, কিন্তু এরাই পরবর্তীকালে নীলবিদ্রোহে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল তা ঐতিহাসিকদের বিবরণীতে লক্ষ করা যায় Though the movement was checked by 1859, many of the peasents who participated in the indigo disterbances were Ferzis skilled in military Organisation and the use of arms.
Ferzi Sect: Encyclopedia of Islam ,London 1927.