১১:২৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যায় মামলার সংখ্যা কম কেন?

  • Sarakhon Report
  • ০৫:২৮:৩৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪
  • 15

বিচার নিশ্চিত করতে না পারায় মামলা করার ক্ষেত্রেও অনেক নারী পারিবারিক সহিংসতার জন্য আইনের দ্বারস্থ হতে ভয় পান

তাহসিনা ইসলাম

বাংলাদেশে ২০২১ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৫৬ জন নারী স্বামীর হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র বা আসক৷

এর মধ্যে মাত্র ৩৪১টি ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে৷ শতকরা হিসেবে এটি ৪৫ শতাংশের কিছু বেশি৷

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে আসক৷ বাস্তবে সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি হতে পারে বলে তারা সতর্ক করেছে৷

মামলা কম হওয়া প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ডিডাব্লিউকে বলেন, নারীরা দারিদ্র্যের শিকার ও অসহায় হওয়ায় অনেক সময় তাদের পক্ষে মামলা করা সম্ভব হয় না৷ পরিবার থেকে শেখানো হয় যে, সংসারে টিকে থাকতে হলে নির্যাতন সহ্য করতে হবে৷

তিনি বলেন, বাংলাদেশে নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পারিবারিক নির্যাতন সহ্য করে মুখ বন্ধ রাখেন৷ ‘‘সাধারণত স্বামীরা প্রভাবশালী থাকেন৷ এছাড়া সমাজ ব্যবস্থার কারণে নারীরা স্বামী, শ্বশুরবাড়ির লোক ও পরিবারের হাতে নির্যাতনের শিকার হন,” বলে জানান কাজী রিয়াজুল হক৷

এছাড়া বিচারিক প্রক্রিয়ায় সঠিকভাবে তদন্ত ও শাস্তি নিশ্চিত না হওয়াও অন্যতম একটি কারণ বলে মনে করেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক এই চেয়ারম্যান৷ ‘‘অপরাধীদের শাস্তি না হলে অপরাধ প্রবণতা বাড়ে, কারণ অপরাধীরা পার পেয়ে যায়,” বলেন তিনি৷

থানা পুলিশের দায়িত্ব পালনে গাফিলতির কথাও উল্লেখ করেন কাজী রিয়াজুল হক৷ তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ যখন মামলা নেয়, তখন অনেক সময় তা সঠিকভাবে তদন্ত করা হয় না৷ নারী অসহায় হওয়ার কারণে পুলিশ অনেক সময় প্রভাবিত হয়৷ মামলাগুলো কোর্টে গেলেও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মামলার গুরুত্ব কমে যায়৷ শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, শাস্তি যৎসামান্য হয়৷”

কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘‘যখন অপরাধী দেখে যে অপরাধ করেও পার পাওয়া যায়, তখন অপরাধ প্রবণতা বাড়ে৷ দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মামলাগুলোতে বিচার বিলম্বিত হয়, যা নারীদের মনোবল ভেঙে দেয়৷”

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও মেডিকেল ডিপার্টমেন্টের কাজে গাফিলতির কথাও উল্লেখ করেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক৷ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কঠোর শাস্তি নির্ধারণ থাকলেও তার সঠিক প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে বলে তিনি জানান৷

এদিকে, বাংলাদেশে স্বামীর হাতে নারী হত্যা ও নির্যাতনের পরিসংখ্যানকে ‘কম’ মনে করছেন মানবাধিকার কর্মী ও ‘আমরাই পারি’ জোটের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক৷ ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, চলতি বছর বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণ এবং সংবাদমাধ্যমের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক ঘটনা প্রকাশিত হয়নি৷ অনেকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাদের কাছে সহায়তা চেয়ে যোগাযোগ করেছেন, যা সংবাদমাধ্যমে উঠে আসেনি বলে জানান তিনি৷

জিনাত আরা হক বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার হার গত কয়েক বছরে কমেনি, বরং পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থেকেছে৷ সামনের দিনগুলোতে এ ধরণের সহিংসতা বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি৷ ‘‘নারীরা এখন লেখাপড়া করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চাইছে, যা অনেক স্বামীর জন্য চাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ নারীরা এখন তাদের অধিকার ও মতামত প্রকাশে বেশি সচেতন, এবং তাদের এই স্বাধীনতা অনেক পুরুষের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দিচ্ছে, যা সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে,” বলে মনে করেন জিনাত আরা হক৷

তিনি আরও বলেন, পুরুষরা এখন নানারকম সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে আছে৷ চাকরি হারানোর ভয় ও অন্যান্য চাপ তাদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা তৈরি করছে, যা তারা পরিবারের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে৷ এছাড়া অনলাইন যোগাযোগ ও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের সুযোগও সহিংসতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে৷

আদালতে এধরনের ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় বহু ঘটনায় সঠিক বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না বলেও মনে করেন জিনাত আরা হক৷ সাক্ষী ও তথ্য সংগ্রহের সমস্যার কারণে অনেকেই ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না, যা এধরনের সহিংসতার অবসানে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

ডিডাব্লিউ ডটকম

স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যায় মামলার সংখ্যা কম কেন?

০৫:২৮:৩৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪

তাহসিনা ইসলাম

বাংলাদেশে ২০২১ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৫৬ জন নারী স্বামীর হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র বা আসক৷

এর মধ্যে মাত্র ৩৪১টি ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে৷ শতকরা হিসেবে এটি ৪৫ শতাংশের কিছু বেশি৷

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে আসক৷ বাস্তবে সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি হতে পারে বলে তারা সতর্ক করেছে৷

মামলা কম হওয়া প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ডিডাব্লিউকে বলেন, নারীরা দারিদ্র্যের শিকার ও অসহায় হওয়ায় অনেক সময় তাদের পক্ষে মামলা করা সম্ভব হয় না৷ পরিবার থেকে শেখানো হয় যে, সংসারে টিকে থাকতে হলে নির্যাতন সহ্য করতে হবে৷

তিনি বলেন, বাংলাদেশে নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পারিবারিক নির্যাতন সহ্য করে মুখ বন্ধ রাখেন৷ ‘‘সাধারণত স্বামীরা প্রভাবশালী থাকেন৷ এছাড়া সমাজ ব্যবস্থার কারণে নারীরা স্বামী, শ্বশুরবাড়ির লোক ও পরিবারের হাতে নির্যাতনের শিকার হন,” বলে জানান কাজী রিয়াজুল হক৷

এছাড়া বিচারিক প্রক্রিয়ায় সঠিকভাবে তদন্ত ও শাস্তি নিশ্চিত না হওয়াও অন্যতম একটি কারণ বলে মনে করেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক এই চেয়ারম্যান৷ ‘‘অপরাধীদের শাস্তি না হলে অপরাধ প্রবণতা বাড়ে, কারণ অপরাধীরা পার পেয়ে যায়,” বলেন তিনি৷

থানা পুলিশের দায়িত্ব পালনে গাফিলতির কথাও উল্লেখ করেন কাজী রিয়াজুল হক৷ তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ যখন মামলা নেয়, তখন অনেক সময় তা সঠিকভাবে তদন্ত করা হয় না৷ নারী অসহায় হওয়ার কারণে পুলিশ অনেক সময় প্রভাবিত হয়৷ মামলাগুলো কোর্টে গেলেও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মামলার গুরুত্ব কমে যায়৷ শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, শাস্তি যৎসামান্য হয়৷”

কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘‘যখন অপরাধী দেখে যে অপরাধ করেও পার পাওয়া যায়, তখন অপরাধ প্রবণতা বাড়ে৷ দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মামলাগুলোতে বিচার বিলম্বিত হয়, যা নারীদের মনোবল ভেঙে দেয়৷”

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও মেডিকেল ডিপার্টমেন্টের কাজে গাফিলতির কথাও উল্লেখ করেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক৷ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কঠোর শাস্তি নির্ধারণ থাকলেও তার সঠিক প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে বলে তিনি জানান৷

এদিকে, বাংলাদেশে স্বামীর হাতে নারী হত্যা ও নির্যাতনের পরিসংখ্যানকে ‘কম’ মনে করছেন মানবাধিকার কর্মী ও ‘আমরাই পারি’ জোটের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক৷ ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, চলতি বছর বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণ এবং সংবাদমাধ্যমের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক ঘটনা প্রকাশিত হয়নি৷ অনেকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাদের কাছে সহায়তা চেয়ে যোগাযোগ করেছেন, যা সংবাদমাধ্যমে উঠে আসেনি বলে জানান তিনি৷

জিনাত আরা হক বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার হার গত কয়েক বছরে কমেনি, বরং পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থেকেছে৷ সামনের দিনগুলোতে এ ধরণের সহিংসতা বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি৷ ‘‘নারীরা এখন লেখাপড়া করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চাইছে, যা অনেক স্বামীর জন্য চাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ নারীরা এখন তাদের অধিকার ও মতামত প্রকাশে বেশি সচেতন, এবং তাদের এই স্বাধীনতা অনেক পুরুষের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দিচ্ছে, যা সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে,” বলে মনে করেন জিনাত আরা হক৷

তিনি আরও বলেন, পুরুষরা এখন নানারকম সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে আছে৷ চাকরি হারানোর ভয় ও অন্যান্য চাপ তাদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা তৈরি করছে, যা তারা পরিবারের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে৷ এছাড়া অনলাইন যোগাযোগ ও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের সুযোগও সহিংসতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে৷

আদালতে এধরনের ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় বহু ঘটনায় সঠিক বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না বলেও মনে করেন জিনাত আরা হক৷ সাক্ষী ও তথ্য সংগ্রহের সমস্যার কারণে অনেকেই ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না, যা এধরনের সহিংসতার অবসানে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

ডিডাব্লিউ ডটকম