০৬:৩৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫
গ্র্যামির ডাবল মনোনয়নে কেটসআইয়ের জয়যাত্রা — বৈচিত্র্য, প্রতিভা ও সংস্কৃতির গ্লোবাল উদযাপন যুক্তরাষ্ট্রে শাটডাউন সমাপ্তির সম্ভাবনায় ডলার স্থিতিশীল, অস্ট্রেলীয় ডলার শক্তিশালী, ইয়েন দুর্বল প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩২১) হলিউডের ‘হাইল্যান্ডার’ রিবুটে যোগ দিলেন কোরিয়ান তারকা জিওন জং-সিও অক্ষরের রহস্য: কেন ‘Q’-এর প্রয়োজন ‘U’ — ভাষার আত্মার এক বিস্ময়কর ইতিহাস নাসার চন্দ্র মিশনের গতি ফেরাতে ‘সবকিছু করবে’ ব্লু অরিজিন” ট্রাম্প বনাম সুপ্রিম কোর্ট: শুল্ক সংকটে নতুন আইনি লড়াই সম্ভাব্য বাজার ধসের পূর্বাভাস: ওয়াল স্ট্রিটও জানে না কখন আসবে পতন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৫২) শেয়ারবাজারে ধস অব্যাহত: ডিএসই-তে লেনদেন ৩০০ কোটি টাকার নিচে

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১০১)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৫৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪
  • 22

সন্ন্যাসী ঠাকুর

আমি বাবার একখানা ফটো তোমাকে দিব। সেই ফটোর দিকে চাহিয়া আমার তুমি বাবাকে জীবস্ত দেখিতে পাইবে।” সুহাদদা বলিলেন, “বাবা চলিয়া গেলেন, জাহিয়া তো রহিলাম। আমার বাসায় যখন-তখন আসিও। ভালো কিছু খাবার দরকার হইলে আেমনা বৌদিদিকে বলিও। টাকা-পয়সার দরকার হইলে আমাকে বলিও। জসী। তুমি বড় হইয়া একজন উঁচু দরের সাধু হইবে, তখন আমাদের কথা ভুলিও না।”

ইথারদিন সকালে জলধর-দাদার সঙ্গে দেখা করিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরের একখানা বাঁধানো ফটো লইয়া আসিলাম। সেই ফটো শ্মশানঘাটে সন্ন্যাসী ঠাকুরের ঘরে টানাইয়া একদৃষ্টিতে সেই ফটোর দিকে চাহিয়া রহিলাম। বিকাল হইলে রেল-সড়ক হইতে একটি বল্টু কুড়াইয়া আনিয়া ফটোর সামনে শিবমূর্তি বলিয়া স্থাপন করিলাম। তাহার সামনে ধূপ-ধুনা জ্বালাইয়া মনে মনে নানা প্রার্থনা করিলাম। কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সম্ভাবশতক বই হইতে একটি স্তোত্র মুখস্থ করিয়া রাখিয়াছিলাম। তাহা কয়েকবার আবৃত্তি করিলাম।

তারপর বসিয়া বসিয়া মনে মনে নানা কল্পনা-জল্পনা করিতে লাগিলাম। সন্ন্যাসী ঠাকুর বলিয়াছিলেন, “ভয়কে জয় করিতে হইবে। কোনোপ্রকার ভয়ই যেন তোমাকে আচ্ছন্ন করিতে না পারে।” স্থির করিলাম, এই শ্মশানঘাটে রাত্রে আসিতে সকলেই তো ভয় পায়। আচ্ছা, আমি যদি এখানে সন্ন্যাসী ঠাকুরের ঘরে রাত্রযাপন করি তবে কেমন হয়? সন্ধ্যার আগেই বাড়ি হইতে সামান্য কিছু খাইয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরের ঘরে আসিয়া হারিকেন লণ্ঠন দুইটি পরিষ্কার করিয়া জ্বালাইলাম। তারপর সেই লোহার বল্টুটির সামনে ধূপ-ধুনা জ্বালাইয়া আগের মতোই প্রার্থনা করিলাম। এ কয়দিনের নানা উত্তেজনায় ভালো করিয়া ঘুমাইতে পারি নাই। প্রার্থনা করিতে করিতে কখন যে ঘুমাইয়া পড়িলাম টেরও পাইলাম না। সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙিয়া গেল।

ঘুম হইতে উঠিয়া মুখ-হাত ধুইয়া জলধর-দাদার বাড়ি গেলাম। আমার শ্মশানবাসের খবর শুনিয়া রানীদিদি আর জলধর-দাদা তাজ্জব হইলেন। সেই আট-নয় বৎসরের একটি ছোট ছেলে যে একাকী শ্মশানঘাটে রাত্রযাপন করিতে পারে ইহা সহজে অপর কেহ বিশ্বাস করিতে পারে না। কিন্তু আমি কোনোদিন মিথ্যা কথা বলি না, ইহা তাঁহারা জানিতেন। আমার ভবিষ্যৎ সাধু-জীবনের প্রতিও তাঁহাদের গভীর বিশ্বাস ছিল। জলধর-দাদা বলিলেন, “তুমি যদি শ্মশানে এমনি একাকী থাকিতে চাও, আমি এখান হইতে প্রতিদিন তোমার খাওয়ার ব্যবস্থা করিব।”

রানীদিদি আমার উপর আরও খুশি হইলেন। সন্ন্যাসী ঠাকুর চলিয়া যাওয়ায় তিনি বড়ই ব্যথা পাইয়াছিলেন। তিনি আমাকে বলিলেন, “জইসারে! শ্মশানে বসিয়া বাবাকে ভালো করিয়া ডাকিস। তোর ডাকে নিশ্চয় তিনি ফিরিয়া আসিবেন।”

রানীদিদির কথাগুলি আমার মনে যেন বিদ্যুতের মতো বাসা বাঁধিয়া ঝলমল করিতে লাগিল। এই দিদিটির খুশির জন্য আমি যেন সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে পারিতাম, আগুনে লম্ফ প্রদান করিতে পারিতাম।

নাচিতে নাচিতে শ্মশানঘাটে ফিরিয়া আসিলাম। তখন শহরে কলেরায় বহুলোক মরিতেছে। সেদিন তিন-চারিটি দল শ্মশানে আসিয়া মড়া পোড়াইয়া গেল। দুপুরবেলা শোভারামপুরের ভিটা-বাড়ির বাগান হইতে চুরি করিয়া তিন-চার ছড়া সিঁদুরে গাছের কাঁচা…………

 

চলবে…

জনপ্রিয় সংবাদ

গ্র্যামির ডাবল মনোনয়নে কেটসআইয়ের জয়যাত্রা — বৈচিত্র্য, প্রতিভা ও সংস্কৃতির গ্লোবাল উদযাপন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১০১)

১১:০০:৫৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

সন্ন্যাসী ঠাকুর

আমি বাবার একখানা ফটো তোমাকে দিব। সেই ফটোর দিকে চাহিয়া আমার তুমি বাবাকে জীবস্ত দেখিতে পাইবে।” সুহাদদা বলিলেন, “বাবা চলিয়া গেলেন, জাহিয়া তো রহিলাম। আমার বাসায় যখন-তখন আসিও। ভালো কিছু খাবার দরকার হইলে আেমনা বৌদিদিকে বলিও। টাকা-পয়সার দরকার হইলে আমাকে বলিও। জসী। তুমি বড় হইয়া একজন উঁচু দরের সাধু হইবে, তখন আমাদের কথা ভুলিও না।”

ইথারদিন সকালে জলধর-দাদার সঙ্গে দেখা করিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরের একখানা বাঁধানো ফটো লইয়া আসিলাম। সেই ফটো শ্মশানঘাটে সন্ন্যাসী ঠাকুরের ঘরে টানাইয়া একদৃষ্টিতে সেই ফটোর দিকে চাহিয়া রহিলাম। বিকাল হইলে রেল-সড়ক হইতে একটি বল্টু কুড়াইয়া আনিয়া ফটোর সামনে শিবমূর্তি বলিয়া স্থাপন করিলাম। তাহার সামনে ধূপ-ধুনা জ্বালাইয়া মনে মনে নানা প্রার্থনা করিলাম। কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সম্ভাবশতক বই হইতে একটি স্তোত্র মুখস্থ করিয়া রাখিয়াছিলাম। তাহা কয়েকবার আবৃত্তি করিলাম।

তারপর বসিয়া বসিয়া মনে মনে নানা কল্পনা-জল্পনা করিতে লাগিলাম। সন্ন্যাসী ঠাকুর বলিয়াছিলেন, “ভয়কে জয় করিতে হইবে। কোনোপ্রকার ভয়ই যেন তোমাকে আচ্ছন্ন করিতে না পারে।” স্থির করিলাম, এই শ্মশানঘাটে রাত্রে আসিতে সকলেই তো ভয় পায়। আচ্ছা, আমি যদি এখানে সন্ন্যাসী ঠাকুরের ঘরে রাত্রযাপন করি তবে কেমন হয়? সন্ধ্যার আগেই বাড়ি হইতে সামান্য কিছু খাইয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরের ঘরে আসিয়া হারিকেন লণ্ঠন দুইটি পরিষ্কার করিয়া জ্বালাইলাম। তারপর সেই লোহার বল্টুটির সামনে ধূপ-ধুনা জ্বালাইয়া আগের মতোই প্রার্থনা করিলাম। এ কয়দিনের নানা উত্তেজনায় ভালো করিয়া ঘুমাইতে পারি নাই। প্রার্থনা করিতে করিতে কখন যে ঘুমাইয়া পড়িলাম টেরও পাইলাম না। সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙিয়া গেল।

ঘুম হইতে উঠিয়া মুখ-হাত ধুইয়া জলধর-দাদার বাড়ি গেলাম। আমার শ্মশানবাসের খবর শুনিয়া রানীদিদি আর জলধর-দাদা তাজ্জব হইলেন। সেই আট-নয় বৎসরের একটি ছোট ছেলে যে একাকী শ্মশানঘাটে রাত্রযাপন করিতে পারে ইহা সহজে অপর কেহ বিশ্বাস করিতে পারে না। কিন্তু আমি কোনোদিন মিথ্যা কথা বলি না, ইহা তাঁহারা জানিতেন। আমার ভবিষ্যৎ সাধু-জীবনের প্রতিও তাঁহাদের গভীর বিশ্বাস ছিল। জলধর-দাদা বলিলেন, “তুমি যদি শ্মশানে এমনি একাকী থাকিতে চাও, আমি এখান হইতে প্রতিদিন তোমার খাওয়ার ব্যবস্থা করিব।”

রানীদিদি আমার উপর আরও খুশি হইলেন। সন্ন্যাসী ঠাকুর চলিয়া যাওয়ায় তিনি বড়ই ব্যথা পাইয়াছিলেন। তিনি আমাকে বলিলেন, “জইসারে! শ্মশানে বসিয়া বাবাকে ভালো করিয়া ডাকিস। তোর ডাকে নিশ্চয় তিনি ফিরিয়া আসিবেন।”

রানীদিদির কথাগুলি আমার মনে যেন বিদ্যুতের মতো বাসা বাঁধিয়া ঝলমল করিতে লাগিল। এই দিদিটির খুশির জন্য আমি যেন সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে পারিতাম, আগুনে লম্ফ প্রদান করিতে পারিতাম।

নাচিতে নাচিতে শ্মশানঘাটে ফিরিয়া আসিলাম। তখন শহরে কলেরায় বহুলোক মরিতেছে। সেদিন তিন-চারিটি দল শ্মশানে আসিয়া মড়া পোড়াইয়া গেল। দুপুরবেলা শোভারামপুরের ভিটা-বাড়ির বাগান হইতে চুরি করিয়া তিন-চার ছড়া সিঁদুরে গাছের কাঁচা…………

 

চলবে…