০৯:১২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১১৭)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫
  • 9

ফরিদপুর জেলা স্কুলে

আমি যখন ফরিদপুর হিতৈষী স্কুলের চতুর্থ শ্রেণী হইতে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠিলাম, আমার পিতা আমাকে ফরিদপুর জেলা স্কুলে ভর্তি করিতে লইয়া গেলেন। সেখানে খোঁজ লইয়া জানিলেন, মাত্র সাতটি সিট খালি আছে। তাহার জন্য প্রায় একশত ছেলে দরখাস্ত করিয়াছে। সুতরাং সেখানে ভর্তি হইবার কোনোই সম্ভাবনা নাই।

তখনকার দিনে ফরিদপুরের মুসলমানদের একচ্ছত্র নেতা ছিলেন খান-বাহাদুর গনি মিঞা সাহেব। মোক্তারি করিয়া তিনি প্রচুর আয় করিতেন। তাঁহার কোনোই অহঙ্কার ছিল না। যে তাঁহার কাছে কোনো কাজের জন্য যাইত তাহাকেই তিনি সাহায্য করিতেন। তিনি নিজে ইংরেজি জানিতেন না। চাকরি-বাকরির জন্য যে-কেহ তাঁহার নিকট যাইত, সার্টিফিকেটের জন্য যাইত, তাহাকেই তিনি বলিয়া দিতেন, “তোমার যা যা প্রশংসা করার দরকার ভালো কাউকে দিয়া ইংরেজিতে লেখাইয়া আন। আমি দস্তখত করিয়া দিব।” এইসব কাজে তিনি আপন-পর জ্ঞান করিতেন না। তিনি বলিতেন, “হিন্দুদের মতো মুসলমানদের তো উচ্চপদে অধিষ্ঠিত বহুলোকের সঙ্গে পরিচয় নাই। তাই আমার কাছে আসিলে আমি চক্ষু মুদিয়া তাহাদের সার্টিফিকেটে দস্তখত দেই।”

আমার পিতা গনি মিঞা সাহেবকে যাইয়া ধরিলেন, “যেমন করিয়াই হউক আমার ছেলেকে ভর্তি করিয়া দিতে হইবে।” সে-বছর তিনি তাঁহার নিজের ছেলেকেও জেলা স্কুলে ভর্তি করিতে মনস্থ করিয়াছিলেন। আমার পিতার মতে। আরও চারজন অভিভাবক তাঁহাদের নিজ নিজ পুত্রকে জেলা স্কুলে ভর্তি করাইবার জন্য গনি মিঞা সাহেবকে যাইয়া ধরিলেন।

গনি মিঞা সাহেব একটি কাগজে সকলের নাম লিখিয়া আমাদিগকে সঙ্গে করিয়া ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের এজলাসে যাইয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি সাহেবকে বলিলেন, “সরকারি স্কুলের শতকরা ৯৫ জন ছাত্রই হিন্দু। আমার এই ছয়জন ছাত্রকে স্কুলে ভর্তি করার হুকুম দিন।” ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সেই লিস্টের উপর স্কুলের হেডমাস্টারকে লিখিলেন, “ইহাদিগকে ভর্তি কর।”

এই কাগজ লইয়া গনি মিঞা সাহেব স্কুলের হেডমাস্টারের সঙ্গে দেখা করিলেন। তখনকার দিনে জেলা স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন শ্রীঈশানচন্দ্র সেন; তুখড় হেডমাস্টার হিসাবে তাঁহার খুব নামডাক ছিল। গনি মিঞা সাহেবের হাতের কাগজখানা পড়িয়া তাঁহার চক্ষু তো চড়কগাছ। এত হিন্দু ছাত্র ফেলিয়া মলিন বসন-পরা আমাদের মতো কয়েকজন অপগণ্ড মুসলিম ছাত্রকে তিনি ভর্তি করিবেন। প্রথমে তিনি গনি মিঞা সাহেবকে বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন। “ছেলেরা সকলেই একসঙ্গে পরীক্ষা দিক। যারা যারা পারিবে তাহাদিগকে ভর্তি করিব।”

গনি মিঞা সাহেব বলিলেন, “আমার গোটা মুসলিম সমাজ অজ্ঞানতার অন্ধকারে পড়িয়া আছে। ছাত্র-বেতনে যাহা আদায় হয় তাহা মাত্র এই স্কুলের দুই-তিন মাসের খরচ। বাকি টাকার অর্ধেকেরও বেশি দেয় আমার মুসলমান ভাইরা নানারকম ট্যাক্স আর খাজনা বাবদে। কিন্তু এই স্কুল হইতে কোনো প্রতিদানই তাহারা পায় না। আপনারা হিন্দুরা অগ্রসর জাতি। আমাদিগকে আপনাদের টানিয়া তুলিতে হইবে। এইভাবে প্রতিযোগিতায় জয়ী হইয়া যদি মুসলমান ছাত্রদিগকে ভর্তি হইতে হয় তবে দুইশত বৎসরেও তাহারা আপনাদের সমান হইতে পারিবে না।”

হেডমাস্টার মহাশয় তখন গনি মিঞা সাহেবের হাতখানি ধরিয়া বলিলেন, “দেখুন খানবাহাদুর সাহেব। এক কাজ করি। সাতটি মাত্র সিট খালি আছে। চারটি হিন্দু ছাত্র ভর্তি করি আর আপনার লিস্ট হইতে তিনটি মুসলমান ছাত্রকে লই।”

 

চলবে…

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১১৭)

১১:০০:২১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫

ফরিদপুর জেলা স্কুলে

আমি যখন ফরিদপুর হিতৈষী স্কুলের চতুর্থ শ্রেণী হইতে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠিলাম, আমার পিতা আমাকে ফরিদপুর জেলা স্কুলে ভর্তি করিতে লইয়া গেলেন। সেখানে খোঁজ লইয়া জানিলেন, মাত্র সাতটি সিট খালি আছে। তাহার জন্য প্রায় একশত ছেলে দরখাস্ত করিয়াছে। সুতরাং সেখানে ভর্তি হইবার কোনোই সম্ভাবনা নাই।

তখনকার দিনে ফরিদপুরের মুসলমানদের একচ্ছত্র নেতা ছিলেন খান-বাহাদুর গনি মিঞা সাহেব। মোক্তারি করিয়া তিনি প্রচুর আয় করিতেন। তাঁহার কোনোই অহঙ্কার ছিল না। যে তাঁহার কাছে কোনো কাজের জন্য যাইত তাহাকেই তিনি সাহায্য করিতেন। তিনি নিজে ইংরেজি জানিতেন না। চাকরি-বাকরির জন্য যে-কেহ তাঁহার নিকট যাইত, সার্টিফিকেটের জন্য যাইত, তাহাকেই তিনি বলিয়া দিতেন, “তোমার যা যা প্রশংসা করার দরকার ভালো কাউকে দিয়া ইংরেজিতে লেখাইয়া আন। আমি দস্তখত করিয়া দিব।” এইসব কাজে তিনি আপন-পর জ্ঞান করিতেন না। তিনি বলিতেন, “হিন্দুদের মতো মুসলমানদের তো উচ্চপদে অধিষ্ঠিত বহুলোকের সঙ্গে পরিচয় নাই। তাই আমার কাছে আসিলে আমি চক্ষু মুদিয়া তাহাদের সার্টিফিকেটে দস্তখত দেই।”

আমার পিতা গনি মিঞা সাহেবকে যাইয়া ধরিলেন, “যেমন করিয়াই হউক আমার ছেলেকে ভর্তি করিয়া দিতে হইবে।” সে-বছর তিনি তাঁহার নিজের ছেলেকেও জেলা স্কুলে ভর্তি করিতে মনস্থ করিয়াছিলেন। আমার পিতার মতে। আরও চারজন অভিভাবক তাঁহাদের নিজ নিজ পুত্রকে জেলা স্কুলে ভর্তি করাইবার জন্য গনি মিঞা সাহেবকে যাইয়া ধরিলেন।

গনি মিঞা সাহেব একটি কাগজে সকলের নাম লিখিয়া আমাদিগকে সঙ্গে করিয়া ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের এজলাসে যাইয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি সাহেবকে বলিলেন, “সরকারি স্কুলের শতকরা ৯৫ জন ছাত্রই হিন্দু। আমার এই ছয়জন ছাত্রকে স্কুলে ভর্তি করার হুকুম দিন।” ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সেই লিস্টের উপর স্কুলের হেডমাস্টারকে লিখিলেন, “ইহাদিগকে ভর্তি কর।”

এই কাগজ লইয়া গনি মিঞা সাহেব স্কুলের হেডমাস্টারের সঙ্গে দেখা করিলেন। তখনকার দিনে জেলা স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন শ্রীঈশানচন্দ্র সেন; তুখড় হেডমাস্টার হিসাবে তাঁহার খুব নামডাক ছিল। গনি মিঞা সাহেবের হাতের কাগজখানা পড়িয়া তাঁহার চক্ষু তো চড়কগাছ। এত হিন্দু ছাত্র ফেলিয়া মলিন বসন-পরা আমাদের মতো কয়েকজন অপগণ্ড মুসলিম ছাত্রকে তিনি ভর্তি করিবেন। প্রথমে তিনি গনি মিঞা সাহেবকে বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন। “ছেলেরা সকলেই একসঙ্গে পরীক্ষা দিক। যারা যারা পারিবে তাহাদিগকে ভর্তি করিব।”

গনি মিঞা সাহেব বলিলেন, “আমার গোটা মুসলিম সমাজ অজ্ঞানতার অন্ধকারে পড়িয়া আছে। ছাত্র-বেতনে যাহা আদায় হয় তাহা মাত্র এই স্কুলের দুই-তিন মাসের খরচ। বাকি টাকার অর্ধেকেরও বেশি দেয় আমার মুসলমান ভাইরা নানারকম ট্যাক্স আর খাজনা বাবদে। কিন্তু এই স্কুল হইতে কোনো প্রতিদানই তাহারা পায় না। আপনারা হিন্দুরা অগ্রসর জাতি। আমাদিগকে আপনাদের টানিয়া তুলিতে হইবে। এইভাবে প্রতিযোগিতায় জয়ী হইয়া যদি মুসলমান ছাত্রদিগকে ভর্তি হইতে হয় তবে দুইশত বৎসরেও তাহারা আপনাদের সমান হইতে পারিবে না।”

হেডমাস্টার মহাশয় তখন গনি মিঞা সাহেবের হাতখানি ধরিয়া বলিলেন, “দেখুন খানবাহাদুর সাহেব। এক কাজ করি। সাতটি মাত্র সিট খালি আছে। চারটি হিন্দু ছাত্র ভর্তি করি আর আপনার লিস্ট হইতে তিনটি মুসলমান ছাত্রকে লই।”

 

চলবে…