লাভীশ ভান্ডারী, ফ্রানজিস্কা ওহনসরগে
সারাংশ
১. বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে যৌন নির্যাতনের কথা জানালে সমস্যার সৃষ্টি হয়
২. মুজুরি কম বলে ভারতে নারী শ্রমিকের অংশ গ্রহন কমে যাচ্ছে
৩. নেপালে প্রশিক্ষণের অভাব
৪. পাকিস্তানে শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা
আজকের দিনে দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ বিশ্বে সর্বনিম্নের মধ্যে রয়েছে। এই অঞ্চলের ৪০০ মিলিয়নেরও বেশি কর্মক্ষম নারী শ্রমবাজারের বাইরে রয়ে গেছেন, যা অর্থনৈতিক উৎপাদনে বড় ধরনের ক্ষতি সৃষ্টি করছে। কর্মজীবী নারীরা সরবরাহ ও চাহিদার সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি প্রতিকূল সামাজিক রীতিনীতির মুখোমুখি হচ্ছেন।
সম্প্রতি, সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক প্রগ্রেস (CSEP) এবং বিশ্বব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য কার্যকর নীতিগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। শিক্ষাবিদ এবং নীতিনির্ধারকরা উল্লেখযোগ্য কিছু প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছেন, যা দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা কর্মজীবনে প্রবেশ করতে গিয়ে সম্মুখীন হন।
নিরাপত্তা: দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা নিরাপত্তার অভাবে বাড়ির বাইরে কাজ করতে অনিচ্ছুক বা অসমর্থ হন। কর্মস্থলে নিরাপত্তার অভাবের কারণে অনেক নারী চাকরির সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন না। কর্মস্থলের নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রথম ধাপ হচ্ছে যৌন হয়রানির সঠিক প্রতিবেদন নিশ্চিত করা। বাংলাদেশি পোশাক শিল্পে দেখা গেছে, নির্যাতনের ঘটনা সঠিকভাবে রিপোর্ট করলে এর ব্যাপকতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যা সমস্যার বিস্তৃতি তুলে ধরে।
সামাজিক নেটওয়ার্ক: চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা প্রায়ই প্রয়োজনীয় সংযোগ থেকে বঞ্চিত থাকেন, বিশেষ করে বিবাহিত হওয়ার পর। ডিজিটাল প্রযুক্তি এই ব্যবধান দূর করতে পারে। জর্ডানে, ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি পেলে নারীদের চাকরির সন্ধানের হার এবং শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। ভারতে, স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলো নারীদের কর্মসংস্থানে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। নেপালে দেখা গেছে, সামাজিকভাবে সংযুক্ত বন্ধুদের সাথে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলে নারী উদ্যোক্তা তৈরির সম্ভাবনা বাড়ে।
মজুরি বৃদ্ধি: বিশেষ করে ভারতের ক্ষেত্রে, নারীদের শ্রমশক্তিতে যোগদানের প্রবণতা কমে গেছে, কারণ তাদের মজুরি বৃদ্ধির হার স্বামীর তুলনায় কম। ভারতে, পুরুষদের তুলনায় নারীদের মজুরি বৃদ্ধির হার অর্ধেকেরও কম, যা ২০১৯ সাল পর্যন্ত নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ।
প্রশিক্ষণ: দক্ষতার অভাব দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের জন্য একটি বড় বাধা। নেপালে, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নারীদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশে, পোশাকশিল্পের নারী কর্মীদের প্রশিক্ষণ তাদের উচ্চ পদে উন্নীত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যা সামগ্রিকভাবে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং কর্মপরিবেশ উন্নত করতে সহায়তা করেছে।
নিয়োগে বৈষম্য: দক্ষিণ এশিয়ার অনেক চাকরির ক্ষেত্রে নারীরা প্রবেশাধিকার পান না। লাহোরে দেখা গেছে, পাকিস্তানি নারীরা অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষাগত যোগ্যতার চাকরির ক্ষেত্রেও পিছিয়ে রয়েছেন, বিশেষ করে যেখানে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয় বা রাতের শিফট থাকে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রথম ধাপ হতে পারে কাজের শর্তাবলী সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক বিধিনিষেধ অপসারণ করা।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, ভারতে নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ গত কয়েক বছরে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে—২০১৮-১৯ সালে এটি ছিল মাত্র ২১.৬%, যা ২০২৩-২৪ সালে বেড়ে ৩৫.৬% হয়েছে। তবে এই প্রবৃদ্ধির বেশিরভাগই গ্রামীণ অঞ্চলে অবৈতনিক ও স্ব-কর্মসংস্থান ভিত্তিক, যা উচ্চমানের চাকরির অভাবের ইঙ্গিত দেয়।
সামাজিক রীতিনীতির প্রভাব: দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক রীতিনীতিও নারীদের কর্মসংস্থানের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতে, বাড়িতে বসে কাজ করার সুযোগ পেলে নারীদের কর্মসংস্থান গ্রহণের সম্ভাবনা বেড়েছে। কল সেন্টারগুলোর মিশ্র লিঙ্গভিত্তিক দল নিয়ে পরিচালিত এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, এতে উৎপাদনশীলতা বাড়েনি, বরং পুরুষদের লিঙ্গগত দৃষ্টিভঙ্গি আরও নেতিবাচক হয়েছে। এর ফলে কর্মস্থলে লিঙ্গ সংবেদনশীল প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়েছে। নেপালে, রক্ষণশীল পরিবারের নারীরা চাকরির সন্ধানে যাওয়ার প্রবণতা কম দেখিয়েছেন।
তবে সামাজিক রীতিনীতির পরিবর্তন সম্ভব। সৌদি আরবে পরিচালিত এক গবেষণা দেখিয়েছে যে, ব্যক্তিগত বিশ্বাস যদি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির তুলনায় উদার হয়, তবে ধীরে ধীরে রীতিনীতিতে পরিবর্তন আসতে পারে। ভারতেও দেখা গেছে যে, আদিবাসীদের প্রভাবিত এলাকায় বসবাসকারী হিন্দু পরিবারগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটে।
একের পর এক এসব উদ্যোগ নেয়া হলেও, এর কোনোটিই এককভাবে দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের শ্রমশক্তিতে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রবেশ করাতে পারবে না। সৌদি আরবের উদাহরণ আমাদের দেখিয়েছে যে, ব্যাপক সামাজিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ নারীর কর্মসংস্থান সম্ভব। তবে একবার পরিবর্তন শুরু হলে, তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আরও পরিবর্তনের পথ সুগম করতে পারে। সুইডেনের পিতৃত্বকালীন ছুটি এবং মার্কিন শ্রমবাজারে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন দেখিয়েছে যে, সময়ের সাথে সাথে এমন উদ্যোগগুলোর ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
এক হাজার মাইলের যাত্রা শুরু হয় এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে।
প্রথম প্রকাশিত: ব্রুকিংস ফিউচার ডেভেলপমেন্ট ব্লগ, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫।