০২:৩৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৩৪)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৫৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • 15

ধীরেনদের বাসায়

পরদিন হইতে রোগিণীর যাহা যাহা কাজ-ঔষধ খাওয়ানো, মাথা ধোয়ানো সবকিছু আমার উপর পড়িল। সকালে ঠাকুর বাটি ভরিয়া বার্লি আনিয়া দিল। মা বলিলেন, “বাবা! তোর হাতে যখন জল খাইয়াছি তখন বার্লি খাইলে আর কি ক্ষতি হইবে?” আমি বার্লির বাটি আনিয়া চামচে করিয়া ধীরে ধীরে মাকে খাওয়াইয়া দিতে লাগিলাম। সাত-আট দিন পরে মা ভালো হইয়া উঠিলেন। তারপর চার-পাঁচ দিন কাটিয়া গেল। যে-চৌকিতে বসিয়া আমরা পড়াশুনা করিতাম, সেই চৌকিতে বসিয়া মাঝে মাঝে তিনি আসিয়া আমাদের সঙ্গে গল্প-গুজব করিতেন। ভাবিলাম, তাঁর ছোঁয়াছুঁয়ির বাছবিচার বুঝি কাটিল। একদিন স্নান করিয়া আসিয়া চার-পাঁচটি তুলসী পাতা মাথায় দিয়া মা আসিয়া আমাকে বলিলেন, “সাধু! আজ আমি স্নান করিয়া আসিয়াছি। এখন হইতে তুমি আর আমাকে ভূঁইবে না।”

কিন্তু এরপর হইতে আর তাঁহাকে ছোঁয়াছুয়ির অত বাছবিচার করিতে দেখি নাই।

ধীরেনের বাবা ছিলেন একজন অসামান্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাসভারী মানুষ। বাড়ির চাকরটি হইতে আরম্ভ করিয়া গৃহিণী পর্যন্ত তাঁহার ভয়ে সর্বদা থরহরি কম্পিত হইত। তিনি কখনও কাহারও প্রতি রাগারাগি করিতেন না। কাউকে কখনও মারধরও করিতেন না। তবু কেন যে অত লোক তাঁহাকে ভয় করিয়া চলিত বুঝিতে পারি নাই। চোখ দুইটি ছিল প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড, আজানুলম্বিত বাহু, দীর্ঘ দেহ, গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল গৌর। এই চোখ দুইটির এমনই শক্তি ছিল যে, যখন যাহার দিকে চাহিতেন সে-ই ভয়ে দুরুদুরু করিয়া কাঁপিত। আমরা নিচের তলায় পড়াশুনা করিতাম। তিনি উপরের তলায় থাকিতেন। কোনোদিন আমরা পড়াশুনা ছাড়িয়া গল্পগুজব করিতেছি, টের পাইয়া তিনি নীরব পায়ে উপর হইতে নিচে নামিয়া আসিতেন।

তাঁহার আগমনের বার্তা আগে হইতেই চাকরদের মারফত অথবা বাড়ির গৃহিণীর মারফত আমাদের কাছে আসিয়া পৌঁছিত। আমরা তাড়াতাড়ি যার যার বই লইয়া জোরে জোরে পড়িতে আরম্ভ করিতাম। তিনি নীরবে আসিয়া আলমারি হইতে কয়েকটি আইন-পুস্তক নাড়িয়া-চাড়িয়া আবার উপরে চলিয়া যাইতেন। এই সময়টা আমাদের সকলের বুক ভয়ে টিপ টিপ করিত। তারপর আমরা আর গল্পগুজব করিতে সাহস করিতাম না। তাঁহার শাসনের ধারাটি এইরকমের ছিল। বাড়ির গৃহিণী সাংসারিক প্রয়োজনে স্বামীর নিকট যাইতে সামনের ঘরে কালীর ছবিখানার সামনে গলবস্ত্র হইয়া বারবার প্রার্থনা করিয়া তবে রওয়ানা হইতেন।

কত বছর আমি এ-বাড়িতে আনাগোনা করিয়াছি। কোনোদিন তাঁকে কাহারও সহিত গাল-গল্প করিতে দেখি নাই-কোনোদিন কাহারও সহিত হাসি-তামাশা করিতে দেখি নাই। ছেলেমেয়েদেরও কোনোদিন কোলে লইয়া আদর করিতে দেখি নাই। পান-তামাক কোনো প্রকার নেশাই তাঁহার ছিল না। বাড়িতে সামান্য একটু জিনিসেরও তিনি অপব্যয় দেখিতে পারিতেন না। যেমন পোশাক-পরিচ্ছদ না হইলে ভদ্রসমাজে চলা যায় না তেমন পোশাক-পরিচ্ছদই তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের কিনিয়া দিতেন। তিনি ফরিদপুর জেলার ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন। কিন্তু কি ছেলেমেয়েদের জন্য, কি নিজের জন্য কোথাও তিনি ব্যয়বাহুল্য পছন্দ করিতেন না। সন্ধ্যাবেলায় তিনি কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সাথে বেড়াইতে যাইতেন। তখন কি আলাপ হইত জানি না। মাঝে মাঝে তিনি ব্রাহ্ম-সমাজের উপাসনায় যোগ দিতেন। তিনি গভর্নমেন্টের উকিল ছিলেন। কয়েকটি আলমারি ভর্তি অসংখ্য আইন-পুস্তক শোভা পাইত। সেই পুস্তকগুলি তিনি তন্ন তন্ন করিয়া পড়িতেন। উপরতলায় তিনি শয়ন করিতেন। নিচের তলায় থাকিত তাঁর আইন-পুস্তকগুলি। গভীর রাত্রে প্রায়ই দেখিতাম তিনি মোমবাতি জ্বালাইয়া উপরতলা হইতে নিচে নামিয়া আসিতেন। সাত-আটখানা আইন-পুস্তক কাঁধে বগলে করিয়া তিনি আবার উপরে চলিয়া যাইতেন। মাঝে মাঝে তিনি সারারাত্র জাগিয়া আইন-পুস্তক অধ্যয়ন করিতেন। তাই মামলায় তাঁর তুখড় বুদ্ধির কাছে অন্যান্য উকিলেরা পারিয়া উঠিতেন না।

চলবে…

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৩৪)

১১:০০:৫৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ধীরেনদের বাসায়

পরদিন হইতে রোগিণীর যাহা যাহা কাজ-ঔষধ খাওয়ানো, মাথা ধোয়ানো সবকিছু আমার উপর পড়িল। সকালে ঠাকুর বাটি ভরিয়া বার্লি আনিয়া দিল। মা বলিলেন, “বাবা! তোর হাতে যখন জল খাইয়াছি তখন বার্লি খাইলে আর কি ক্ষতি হইবে?” আমি বার্লির বাটি আনিয়া চামচে করিয়া ধীরে ধীরে মাকে খাওয়াইয়া দিতে লাগিলাম। সাত-আট দিন পরে মা ভালো হইয়া উঠিলেন। তারপর চার-পাঁচ দিন কাটিয়া গেল। যে-চৌকিতে বসিয়া আমরা পড়াশুনা করিতাম, সেই চৌকিতে বসিয়া মাঝে মাঝে তিনি আসিয়া আমাদের সঙ্গে গল্প-গুজব করিতেন। ভাবিলাম, তাঁর ছোঁয়াছুঁয়ির বাছবিচার বুঝি কাটিল। একদিন স্নান করিয়া আসিয়া চার-পাঁচটি তুলসী পাতা মাথায় দিয়া মা আসিয়া আমাকে বলিলেন, “সাধু! আজ আমি স্নান করিয়া আসিয়াছি। এখন হইতে তুমি আর আমাকে ভূঁইবে না।”

কিন্তু এরপর হইতে আর তাঁহাকে ছোঁয়াছুয়ির অত বাছবিচার করিতে দেখি নাই।

ধীরেনের বাবা ছিলেন একজন অসামান্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাসভারী মানুষ। বাড়ির চাকরটি হইতে আরম্ভ করিয়া গৃহিণী পর্যন্ত তাঁহার ভয়ে সর্বদা থরহরি কম্পিত হইত। তিনি কখনও কাহারও প্রতি রাগারাগি করিতেন না। কাউকে কখনও মারধরও করিতেন না। তবু কেন যে অত লোক তাঁহাকে ভয় করিয়া চলিত বুঝিতে পারি নাই। চোখ দুইটি ছিল প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড, আজানুলম্বিত বাহু, দীর্ঘ দেহ, গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল গৌর। এই চোখ দুইটির এমনই শক্তি ছিল যে, যখন যাহার দিকে চাহিতেন সে-ই ভয়ে দুরুদুরু করিয়া কাঁপিত। আমরা নিচের তলায় পড়াশুনা করিতাম। তিনি উপরের তলায় থাকিতেন। কোনোদিন আমরা পড়াশুনা ছাড়িয়া গল্পগুজব করিতেছি, টের পাইয়া তিনি নীরব পায়ে উপর হইতে নিচে নামিয়া আসিতেন।

তাঁহার আগমনের বার্তা আগে হইতেই চাকরদের মারফত অথবা বাড়ির গৃহিণীর মারফত আমাদের কাছে আসিয়া পৌঁছিত। আমরা তাড়াতাড়ি যার যার বই লইয়া জোরে জোরে পড়িতে আরম্ভ করিতাম। তিনি নীরবে আসিয়া আলমারি হইতে কয়েকটি আইন-পুস্তক নাড়িয়া-চাড়িয়া আবার উপরে চলিয়া যাইতেন। এই সময়টা আমাদের সকলের বুক ভয়ে টিপ টিপ করিত। তারপর আমরা আর গল্পগুজব করিতে সাহস করিতাম না। তাঁহার শাসনের ধারাটি এইরকমের ছিল। বাড়ির গৃহিণী সাংসারিক প্রয়োজনে স্বামীর নিকট যাইতে সামনের ঘরে কালীর ছবিখানার সামনে গলবস্ত্র হইয়া বারবার প্রার্থনা করিয়া তবে রওয়ানা হইতেন।

কত বছর আমি এ-বাড়িতে আনাগোনা করিয়াছি। কোনোদিন তাঁকে কাহারও সহিত গাল-গল্প করিতে দেখি নাই-কোনোদিন কাহারও সহিত হাসি-তামাশা করিতে দেখি নাই। ছেলেমেয়েদেরও কোনোদিন কোলে লইয়া আদর করিতে দেখি নাই। পান-তামাক কোনো প্রকার নেশাই তাঁহার ছিল না। বাড়িতে সামান্য একটু জিনিসেরও তিনি অপব্যয় দেখিতে পারিতেন না। যেমন পোশাক-পরিচ্ছদ না হইলে ভদ্রসমাজে চলা যায় না তেমন পোশাক-পরিচ্ছদই তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের কিনিয়া দিতেন। তিনি ফরিদপুর জেলার ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন। কিন্তু কি ছেলেমেয়েদের জন্য, কি নিজের জন্য কোথাও তিনি ব্যয়বাহুল্য পছন্দ করিতেন না। সন্ধ্যাবেলায় তিনি কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সাথে বেড়াইতে যাইতেন। তখন কি আলাপ হইত জানি না। মাঝে মাঝে তিনি ব্রাহ্ম-সমাজের উপাসনায় যোগ দিতেন। তিনি গভর্নমেন্টের উকিল ছিলেন। কয়েকটি আলমারি ভর্তি অসংখ্য আইন-পুস্তক শোভা পাইত। সেই পুস্তকগুলি তিনি তন্ন তন্ন করিয়া পড়িতেন। উপরতলায় তিনি শয়ন করিতেন। নিচের তলায় থাকিত তাঁর আইন-পুস্তকগুলি। গভীর রাত্রে প্রায়ই দেখিতাম তিনি মোমবাতি জ্বালাইয়া উপরতলা হইতে নিচে নামিয়া আসিতেন। সাত-আটখানা আইন-পুস্তক কাঁধে বগলে করিয়া তিনি আবার উপরে চলিয়া যাইতেন। মাঝে মাঝে তিনি সারারাত্র জাগিয়া আইন-পুস্তক অধ্যয়ন করিতেন। তাই মামলায় তাঁর তুখড় বুদ্ধির কাছে অন্যান্য উকিলেরা পারিয়া উঠিতেন না।

চলবে…