সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাংশ
- চীন থেকে সস্তা পণ্যের ব্যাপক প্রবাহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনছে, বিশেষ করে উৎপাদন খাতে
- থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতে উৎপাদন হ্রাস, চাকরি হারানো এবং কারখানা বন্ধ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে
- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সরকারগুলো চীনা পণ্যের প্রভাব কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, যেমন – কর বৃদ্ধি, বিধিনিষেধ আরোপ এবং এন্টিডাম্পিং শুল্ক
- ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে উচ্চ মূল্য সংযোজনকারী সেবা বা চীনা উৎপাদকদের সরবরাহকারী হিসেবে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে
ভূমিকা
একজন ব্যাংকক-ভিত্তিক দোকানদার অভিযোগ করছেন যে, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশে তৈরি আধুনিক পোশাক বিক্রি করে তাঁর ব্যবসা এখন কঠিন সময় পার করছে। একই সময়ে, ইন্দোনেশিয়া পূর্ববর্তী বন্দরগুলোর দিকে আরও জাহাজ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে, আর মালয়েশিয়ার এক রাজনীতিবিদ একটি নতুন করকে “ভারী” বলে আক্ষেপ করেছেন যা দরিদ্র শ্রেণীর উপর চাপ সৃষ্টি করবে। এসব সমস্যার মূল কারণ হিসেবে চীনা পণ্যের বন্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
২. চীনের উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধির প্রেক্ষাপট
- অভ্যন্তরীণ চাহিদার অবক্ষয়:
চীনে সম্পত্তি সঙ্কট, হতাশ কনজিউমার এবং আর্থিক উদ্দীপনার অভাবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা দুর্বল। - উৎপাদন খাতে জোর:
নতুন প্রবৃদ্ধির সন্ধানে, চীন উৎপাদন খাতে জোর দিচ্ছে। ২০২৪ সালে চীনের নিট রপ্তানি প্রায় তার জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধির সমান ছিল। - বিকল্প বাজারে প্রবাহ:
পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে, চীনা পণ্য বিকাশশীল বাজার, বিশেষ করে আসিয়ান দেশগুলিতে প্রবাহিত হচ্ছে। গত তিন বছরে আসিয়ানে চীনা রপ্তানি মূল্য ২৪% বৃদ্ধি পেয়েছে, আর আমদানির হার অপরিবর্তিত থাকায় চীনের বাণিজ্য সারপ্লাস দ্বিগুণ হয়েছে।
৩. দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব
- নিম্ন-মূল্য সংযোজন খাতে আঘাত:
প্লাস্টিক ও লৌহ-ইস্পাতের মতো খাতে চীনা আমদানির শেয়ার যথাক্রমে ৬ ও ১২ শতাংশ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। - আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা:
আসিয়ানের নিজস্ব রপ্তানি বিশ্ববাজারে থমকে যাওয়ায় আঞ্চলিক উৎপাদকদের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে।
৪. উৎপাদন খাতের সংকট
- থাইল্যান্ডে উৎপাদনের পতন:
ডিসেম্বর ২০২১ থেকে থাইল্যান্ডের উৎপাদন খাতে ১১% হ্রাস লক্ষ্য করা গেছে। - টেক্সটাইল খাতে ব্যাপক ক্ষতি:
ইন্দোনেশিয়ার শ্রম-নির্ভর টেক্সটাইল খাতে ২০২৪ সালে ৮০,০০০ কর্মচারী চাকরি হারিয়েছে, আর সরকারি অনুমানে এই বছর ২৮০,০০০ চাকরি বিপদের মুখে থাকতে পারে। - দুর্ভাগ্যবশত বড় ও ছোট উভয় প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত:
উদাহরণস্বরূপ, ইন্দোনেশিয়ার Sritex, যা ফাস্ট-ফ্যাশন ব্র্যান্ড হ্যান্ডেল করতো, তা চীনা অতিরিক্ত টেক্সটাইল সরবরাহের অভিযোগে দেউলিয়া হয়ে পড়ে। - শিল্পায়নে স্থবিরতা:
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান পাঁচটি অর্থনীতিতে (সিঙ্গাপুর বাদে) শিল্প উৎপাদন ২০২২ সালের মাত্রায় আটকে আছে, যা শিল্পায়নের ধীরগতি নির্দেশ করে।
৫. সরকারি প্রতিক্রিয়া ও নিয়ন্ত্রণ
- নির্বাচনমূলক পদক্ষেপ:
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সরকারগুলো চীনের উৎপাদন চাপ মোকাবিলায় প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। - কর ও বিধিনিষেধ:
জনপ্রিয় চীনা ই-কমার্স অ্যাপস (যেমন Lazada, TikTok Shop) এবং সস্তা আমদানিকৃত পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি বা সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। - এন্টিডাম্পিং শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞা:
কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে এন্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া সোশ্যাল মিডিয়ায় (যেমন TikTok) বিদেশি বিক্রেতাদের অনলাইন বাজারে বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে এবং অক্টোবর মাসে চীনা প্ল্যাটফর্ম Temu-কে অ্যাপ স্টোর থেকে সরিয়ে ফেলেছে। - চীনা পোশাক নিয়ে সতর্কতা:
৫ ফেব্রুয়ারি, ইন্দোনেশিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রী বুদি সান্তোশো চীনা তৈরিকৃত অবৈধ পোশাকের উদাহরণ দেখিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। - তবে আমদানিতে বৃদ্ধি:
এ সব ব্যবস্থাপনা সত্ত্বেও, গত ছয় মাসে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে চীনা আমদানিতে যথাক্রমে ২৫% ও ২০% বৃদ্ধি দেখা গেছে।
৬. বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও দ্বন্দ্ব
- গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক:
১০টি আসিয়ান দেশের ৯টির জন্য চীন হচ্ছে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার এবং বিনিয়োগের তৃতীয় বৃহৎ উৎস। - অনানুষ্ঠানিক ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক:
“বাঁশ নেটওয়ার্ক” নামে পরিচিত চীনা প্রবাসীদের সম্পর্ক চীনের প্রভাব আরও বাড়িয়ে দেয়। - সুরক্ষাবাদী নীতির প্রভাব:
অতিরিক্ত সুরক্ষাবাদী নীতিতে গ্রাহকদের জন্য খরচ বেড়ে যেতে পারে, যেমন ব্যাংককের রাতের বাজারে সাশ্রয়ী মূল্যের চীনা পোশাকের জনপ্রিয়তা। - মালয়েশিয়ার কর সমস্যা:
মালয়েশিয়ায় নিম্ন-মূল্যের আমদানিকৃত পণ্যের ওপর গত বছরের ১০% করকে নিম্ন আয়ের ৪০% মানুষের উপর নেতিবাচক প্রভাব হিসেবে দেখা হয়েছে।
৭. ভবিষ্যতের ঝুঁকি ও পরামর্শ
- সরকারের দ্বিধা:
ইন্দোনেশিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রী জুনে চীনা পণ্যের ওপর ১০০-২০০% শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিলেন, কিন্তু এক সপ্তাহ পর তা প্রত্যাহার করতে হয়। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের মন্ত্রীও সতর্কতা অবলম্বন করছেন। - আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা:
যদি আমেরিকা (যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প) আসিয়ানের মতো রপ্তানিকারক অর্থনীতির ওপর শুল্ক বাড়ায়, তাহলে আসিয়ান দেশগুলো এমন দ্বন্দ্বের মুখে পড়তে পারে যেখানে আমেরিকা তাদের পণ্য গ্রহণে অনিচ্ছুক, আর চীন স্থানীয় উৎপাদকদের স্থানচ্যুত করছে। - ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরামর্শ:
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে উচ্চ মূল্য সংযোজনকারী সেবা বা চীনা উৎপাদকদের সরবরাহকারী হিসেবে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে, তবে এই পরিবর্তন অল্প সময়ে সম্ভব বলে আশা করা হচ্ছে না।
সারাংশ:
চীনা পণ্যের বন্যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উৎপাদন খাত, বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও সরকারের নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনছে। উৎপাদন সংকট, বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব এবং সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপগুলি এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে, যার ফলে ভবিষ্যতে আরও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে।