সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাংশ
- জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ ও মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য খাত বর্তমানে কঠিন চাপের মুখে
- ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তায় ঋণ ও অনুদান প্রদান করা হচ্ছে
- পাপুয়া নিউ গিনিতে কৃষকদের বাজারজাতকরণের প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে আয় ও ফলন বৃদ্ধি করা হচ্ছে
- হাইতির রোজেলিন জোজিলের মতো ব্যক্তিদের উদ্দীপনা ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বিভিন্ন দেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব হচ্ছে
ভূমিকা
বিশ্বব্যাপী খাদ্য খাত বর্তমানে কঠিন চাপে রয়েছে। আবহাওয়ার পরিবর্তন ফসল সংগ্রহে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে, আবার সংঘর্ষ ও মহামারী সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে—ফলে দাম বৃদ্ধি, ক্ষুধা ও কুপুষ্টি বাড়ছে। একই সাথে, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবহার প্রক্রিয়ায় গ্রীনহাউস গ্যাসের এক তৃতীয়াংশ নির্গমন এবং বিশ্বব্যাপী ৭০% বন উজাড়ই অন্যতম কারণ। তবে কৃষক, প্রযুক্তিবিদ, বিনিয়োগকারী ও নীতি প্রণেতারা নতুন উদ্ভাবনী সমাধানের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ সুরক্ষা ও ক্ষুদ্র কৃষকদের উন্নত বাজার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছেন।
ইউক্রেন ও মরক্কো: খাদ্য সরবরাহে চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
ইউক্রেন
- পূর্ববর্তী অবস্থান: যুদ্ধের আগের সময়ে, ইউক্রেনের হাজারো কৃষক সমৃদ্ধ ছিল এবং কর্ন, বার্লি, তেলবীজ ও গমের প্রধান রপ্তানিকারক হিসেবে এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের লক্ষাধিক মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ করত।
- বর্তমান চ্যালেঞ্জ: রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে কৃষিকাজে ব্যাপক ক্ষতি, কৃষকদের স্থানচ্যুতি ও গুদাম ধ্বংস হয়ে দেশীয় বাজারে দাম দ্বিগুণ হয়েছে।
- সমাধান: ARISE প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১০,০০০ কৃষক ঋণ ও ২৫,০০০ ক্ষুদ্র উৎপাদক অনুদানে সুবিধা পেয়েছে, যার মাধ্যমে মোট ৯০,০০০ কৃষক সাশ্রয়ী ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে কৃষিকাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
মরক্কো
- পরিস্থিতি: দীর্ঘদিন শুকনো আবহাওয়ার কারণে ফসলের ফলন হ্রাস পাচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা ও রপ্তানি আয়ের উপর হুমকি সৃষ্টি করছে।
- উদ্ভাবনী সমাধান: কৃষি উদ্যোক্তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক একটি টুল ব্যবহার করছেন, যা টমেটো ফসল স্ক্যান করে পানি চাহিদা পূর্বাভাস দেয়।
- সরকারি ও আন্তর্জাতিক সহায়তা: মরক্কো সরকার ও বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় টেকসই কৃষি, উন্নত সেচ ব্যবস্থা, তরুণ প্রজন্মের আকর্ষণ, জৈব ও সংরক্ষণশীল চাষাবাদ, কৃষি বীমা ও পুষ্টি উন্নয়নে একটি বহুমুখী কর্মসূচি শুরু হয়েছে।
জাম্বিয়া ও উরুগুয়ে: কার্বন নির্গমন হ্রাস ও পরিবেশ সুরক্ষা
জাম্বিয়া
- চ্যালেঞ্জ: ব্যাপক কৃষি সম্প্রসারণ ও কাঠের উচ্চ চাহিদা বন উজাড়কে ত্বরান্বিত করছে, যা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের অন্যতম কারণ।
- কৃষকের উদ্যোগ: মিশ্র চাষ, ফসল ঘূর্ণন ও বৈচিত্র্যমূলক চাষাবাদের মাধ্যমে মাটি ও বন সংরক্ষণে স্থানীয় কৃষকরা মনোযোগ দিচ্ছেন। এই উদ্যোগে ১৬২,০০০-এরও বেশি মানুষের উপকৃত হওয়ার সাথে কিছু ক্ষেত্রে ফসলের ফলনে ৩০% পর্যন্ত বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে।
- ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: মাটিতে সংরক্ষিত কার্বন থেকে অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ চলছে।
উরুগুয়ে
- অর্থনৈতিক প্রভাব: পশুপালন দেশের মোট জিডিপির ১৯% এবং রপ্তানির ৭৮% অবদান রাখে, লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা নির্বাহে সহায়তা করে।
- উদ্ভাবনী উদ্যোগ: উন্নত কম্পোস্ট, খাদ্য ও বীজ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ছোট ও মাঝারি দুধ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। বিশেষ প্রকল্পে গোবরকে বাগানের সার হিসেবে ব্যবহার করে পানি দূষণ রোধ করা হয়েছে।
- অর্থায়নের ব্যবস্থা: কর্মক্ষমতা-নির্ভর সার্বভৌম ঋণের মাধ্যমে বিফ শিল্পের মিথেন নির্গমন কমানোর কাজ চলছে, যা দেশের আর্থিক ব্যয় হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ভারত ও পাপুয়া নিউ গিনিয়া: ক্ষুদ্র কৃষকদের বাজার প্রবেশ ও অর্থায়ন
ভারত
- চ্যালেঞ্জ: ক্ষুদ্র কৃষকরা কম ফলন, আবহাওয়ার ঝুঁকি, সীমিত বাজার ও তথ্যের অভাবে অনেক বাধার সম্মুখীন হন।
- নারীর নেতৃত্ব: নারীদের নেতৃত্বাধীন গ্রামীণ উদ্যোগে ২৭ মিলিয়ন মানুষের কর্মসংস্থান থাকলেও ঋণ, বিপণন ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান।
- সহায়তা ও বিনিয়োগ: ২০১১ সাল থেকে বিশ্বব্যাংকের ৭৫০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগে ৯ মিলিয়নেরও বেশি স্ব-সহায়তা গ্রুপ ও ১০০ মিলিয়নেরও অধিক গ্রামীণ নারীকে মোবিলাইজ করা হয়েছে। তামিলনাড়ুর গ্রামীণ রূপান্তর প্রকল্পের মাধ্যমে ডিজিটাল পোর্টালের সাহায্যে কৃষকের বায়োমেট্রিক, ক্রেডিট ইতিহাস ও অনলাইন লেনদেন সহজ করে ১০০,০০০-এরও বেশি ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান সম্ভব হয়েছে।
পাপুয়া নিউ গিনিয়া
- চ্যালেঞ্জ: বিস্তৃত দূরত্ব, দুর্বল অবকাঠামো ও উচ্চ পরিবহন খরচের কারণে কৃষকদের বাজারে প্রবেশে অসুবিধা হচ্ছে।
- উপস্থিতি: দেশের ৮০% মানুষ গ্রামীণ এলাকায় বাস করে এবং ৭৫% কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কফি ও কোকো প্রধান নগদ ফসল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- সমাধান: ক্ষুদ্র কৃষকদের বাজারজাতকরণের প্রশিক্ষণ ও স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে প্রায় ৭০,০০০ কফি ও কোকো চাষীর আয় ও ফলনে ৪০% বৃদ্ধি হয়েছে। ২৪,০০০ নারীর আয় এই ফসল থেকে তাদের শিক্ষা, পরিবহন ও স্বাস্থ্যসেবার খরচ মেটাতে সাহায্য করছে।
টেকসই উন্নয়নে গেম চেঞ্জারস
নতুন উদ্ভাবনী সমাধানগুলো খাদ্য উৎপাদন, বিতরণ ও ভোগের ধারাকে দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়নের পথে নিয়ে যাচ্ছে:
- পরিষ্কার বায়ু ও নীল আকাশ: সুস্থ সমাজ ও পরিবেশ নিশ্চিত করা।
- জলবায়ু-প্রতিরোধী সেচ ব্যবস্থা: খাদ্য উৎপাদন, জীবিকা বৃদ্ধি ও জ্বালানি নির্গমন কমাতে সহায়ক।
- বন সংরক্ষণ: প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করে সম্প্রদায়ের উন্নয়ন ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা।
- কার্বন বাজার: স্বচ্ছ ও কার্যকর কার্বন বাজারের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সরাসরি উপকার প্রদান।
- জলবায়ু ঝটকায় অভিযোজন: দুর্যোগের সময় দুর্বল জনগোষ্ঠীকে রক্ষা ও প্রস্তুতির ব্যবস্থা গ্রহণ।
- টেকসই শহুরে পরিবহণ: নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
- সৌর শক্তির ব্যবহার: নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে শক্তি চাহিদা পূরণ ও কার্বন নির্গমন হ্রাসে সহায়তা।
হাইতির উদ্দীপনা
হাইতির দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার মাঝেও, রোজেলিন জোজিলের অনবদ্য উদ্দীপনা অনেকের জন্য প্রেরণার উৎস। তার সহায়তা ও বিনিয়োগের প্রচেষ্টা, বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতার মাধ্যমে বাস্তবায়িত, যা বহু মানুষের জন্য অগ্রগতির দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করছে।
উপসংহার
ইউক্রেন, মরক্কো, জাম্বিয়া, উরুগুয়ে, ভারত ও পাপুয়া নিউ গিনিয়ার বিভিন্ন উদ্যোগ তাৎক্ষণিক সহায়তা প্রদান করে এবং দীর্ঘমেয়াদী খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব নিশ্চিত করছে। কৃষিকাজ শুধু জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম নয়, বরং টেকসই উন্নয়নের শক্তিশালী প্রবর্তক হিসেবে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।