গ্লোবাল টাইমস সম্পাদনা পর্ষদ
২০২৫ সালের বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএএফএ)-এর বার্ষিক সম্মেলন বৃহস্পতিবার উদ্বোধন করা হয় “বদলে যাওয়া বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আস্থা নির্মাণ” শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে। এ বছর ৬০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলের ১,৫০০-র বেশি প্রতিনিধি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। একপাক্ষিকতার উত্থান, বাণিজ্যযুদ্ধের হুমকি এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির দুর্বল পুনরুদ্ধারের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সমাজ আজ “এশিয়ার পথ” ও “এশীয় সমাধান”-এর দিকে তাকিয়ে আছে। এই ফোরাম এশিয়ার শক্তিশালী গর্জন বিশ্বকে শুনিয়ে দিয়েছে, আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রজ্ঞা দিয়ে বিশ্বে নিশ্চিততা এনে দিয়েছে।
বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনীতি এক কঠিন সময় পার করছে। কিছু দেশের বাণিজ্য সুরক্ষা নীতি ও জনতাবাদী প্রবণতা বিশ্বব্যাপী শিল্প সরবরাহ ব্যবস্থাকে খণ্ডবিখণ্ড করে দিচ্ছে। এই কঠিন ও অনিশ্চিত বহির্বিশ্বে এশিয়ার অর্থনীতি এখনও প্রবল সহনশীলতা প্রদর্শন করছে।
বোয়াও ফোরাম প্রকাশিত “এশীয় অর্থনৈতিক প্রবণতা ও একীভবন অগ্রগতি বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২৫”-এ বলা হয়েছে, এ বছর এশিয়ার ওজনভিত্তিক প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪.৫ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। ক্রয়ক্ষমতা সমতা অনুযায়ী বৈশ্বিক মোট জিডিপিতে এশিয়ার অংশ ২০২৫ সালে ৪৮.৬ শতাংশে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হয়েছে। চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, মঙ্গোলিয়া, কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো ৫ শতাংশেরও বেশি হারে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখবে। এশিয়া এখন বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির মূল ইঞ্জিন এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির একটি নির্ভরযোগ্য স্থিতিশীল নোঙর।
এশিয়ার উন্নয়নের পেছনে একটি মূল্যবান ঐকমত্য হলো “উন্মুক্ততা”, যা অর্থনৈতিক পরিপূরকতাকে দ্রুত উন্নয়নে রূপান্তর করেছে। আজ চীনের “নতুন তিন” পণ্য – নতুন জ্বালানিচালিত যান, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ও সৌরবিদ্যুৎ সরঞ্জাম – লানছাং-মেকং এক্সপ্রেস পরিষেবার মাধ্যমে চীন-লাওস রেলপথ ধরে লাওস, থাইল্যান্ডসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশে যাচ্ছে। একই সঙ্গে, চীনের নির্মিত বৃহৎ প্রমোদতরী ‘অডোরা ম্যাজিক সিটি’ চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার পর্যটকদের নিয়ে সাংহাই, ফুকুওকা ও জেজু দ্বীপে যাচ্ছে।
চীন-লাওসের যৌথভাবে গড়ে তোলা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণা ও উদ্ভাবন কেন্দ্র থেকে শুরু করে ভবিষ্যতে চীনের মহাকাশ স্টেশনে প্রবেশ করতে যাওয়া পাকিস্তানি নভোচারীদের প্রসঙ্গ পর্যন্ত—সবই প্রমাণ করে যে সহযোগিতার মাধ্যমে দেশগুলো একে অপরকে শক্তিশালী করে তুলছে এবং এক আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, ২০২৩ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে আঞ্চলিক সামগ্রিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব (আরসিইপি)-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জিডিপি ১০.৯ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়বে এবং যেসব এশীয় দেশ উন্মুক্ততা গ্রহণ করেছে তারা উন্নয়নের সুবিধাগুলো আগে উপভোগ করছে।
এশিয়ার এই উন্নয়নশীল সহনশীলতার শিকড় রয়েছে বিকাশমান মডেল উদ্ভাবনে। বর্তমানে গবেষণা ও উন্নয়নে (আরএন্ডডি) বিনিয়োগ এবং পেটেন্ট আবেদনের দিক থেকে এশিয়া বিশ্বের অন্য সব অঞ্চলকে ছাড়িয়ে গেছে, এবং বৈশ্বিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।
ডিজিটাল অর্থনীতি ও সবুজ অর্থনীতির ক্ষেত্রেও এশিয়া শক্তিশালী সম্ভাবনা দেখিয়েছে। ৫জি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও বিগ ডেটার মতো প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগের ফলে এশিয়ার ডিজিটাল অবকাঠামো দ্রুত এগোচ্ছে, যা অর্থনৈতিক রূপান্তর ও উন্নয়নে জোরালো সহায়তা দিচ্ছে। এশিয়া ইতোমধ্যেই নতুন শিল্প বিপ্লবের অগ্রভাগে পৌঁছে গেছে।
এ বছরের বোয়াও ফোরাম সময়ের স্পন্দন ধরতে সক্ষম হয়েছে। আরও প্রাসঙ্গিক ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন আলোচ্য বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে এটি “বৈচিত্র্যময় এশিয়া”-র প্রাণবন্ত বিকাশের সম্ভাবনাকে প্রতিফলিত করেছে এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের কণ্ঠস্বরকে জোরালো করেছে। এই পরিবর্তন বোয়াও ফোরামের বহুপাক্ষিকতার পুনঃসংজ্ঞা তুলে ধরে—এটি এখন আর কেবল কয়েকটি প্রধান শক্তির কর্তৃত্বাধীন “আলোচনার মঞ্চ” নয়, বরং একটি “কার্যকরী দল” যা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজ করে।
আজ “বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া” নামটি বহাল থাকলেও এর প্রভাব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়ে, ইতালি সহ বহু দেশের শিক্ষাবিদ ও উদ্যোক্তারা এতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন এবং উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করছেন। এটি “এশিয়ান ডাভোস” থেকে পরিণত হয়েছে “বৈশ্বিক জনসম্পদ”-এ। এই ফোরাম শুধু এশীয় দেশগুলোকে যৌথভাবে উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করার সুযোগই দিচ্ছে না, বরং বিশ্বব্যবস্থাপনায় চীন ও এশিয়ার প্রজ্ঞাকে যুক্ত করছে।
পশ্চিম যখন এখনও “ইতিহাসের সমাপ্তি”র মায়ায় বিভোর, তখন এশিয়ার দেশগুলো বোয়াও ফোরামে একত্র হয়ে তাদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরেছে—বিকাশকে সংঘাত সমাধানের মাধ্যম হিসেবে দেখা, নিয়মের মাধ্যমে সহযোগিতাকে শক্তিশালী করা এবং সাংস্কৃতিক সংযোগের মাধ্যমে ঐক্যমত্য গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও বোয়াও ফোরামের বর্তমান চেয়ারম্যান বান কি-মুন বলেছেন, বহুপাক্ষিকতা, মুক্ত বাণিজ্য ও বৈশ্বিকীকরণের ক্ষেত্রে এশিয়া এখন এক অগ্রণী কণ্ঠস্বর। তিনি উল্লেখ করেন, “এশীয় অলৌকিকতা” অনেকাংশে বৈশ্বিকীকরণ এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে গভীর একীভবনের ফল। থাইল্যান্ডের সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডন প্রামুদউইনাই বলেন, পূর্বে দেশগুলো বৈশ্বিক অর্থনীতির “মহাসড়কে” দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু বর্তমানে নতুন নতুন “বাধা” সেই রাস্তায় দেখা দিয়েছে, এবং এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা অপরিহার্য। প্রতিটি দেশই আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য অবদান রাখতে পারে। এই বক্তব্যগুলো আবারও প্রমাণ করে, এশিয়ার উন্নয়ন আসলে একটি আঞ্চলিক সহযোগিতার সুরেলা সিম্ফনি।
এই বছর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং “ভবিষ্যত ভাগ্যের জন্য এশীয় সমাজ” গঠনের প্রস্তাবের ১০ বছর পূর্তি। সব পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, যা বৈশ্বিক উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছে। শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের সময়ে এশিয়া একটি বিশাল জাহাজের মতো, যা তরঙ্গ পেরিয়ে এগিয়ে চলছে, একদিকে যেমন রূপান্তর ঘটছে, তেমনি হয়ে উঠছে বৈশ্বিক শান্তির নোঙর, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নতুন পথপ্রদর্শক।
২০২৫ সালের বোয়াও সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ডিং শুয়েশিয়াং তাঁর মূল বক্তৃতায় বিশ্বের সব দেশের ব্যবসায়ীদের চীনে বিনিয়োগ ও কার্যক্রম পরিচালনার আন্তরিক আমন্ত্রণ জানান। তিনি চীনের আধুনিকায়নের যাত্রায় অংশ নিতে এবং চীনের বিকাশের সুযোগে অংশীদার হতে আহ্বান জানান। চীন বরাবরই এশিয়া ও বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য একটি স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে কাজ করে এসেছে, এবং আমরা বিশ্বাস করি—এশীয় দেশগুলো একসঙ্গে কাজ করে আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবে।