সারাক্ষণ রিপোর্ট
প্রেক্ষাপট: ব্রিকস থেকে ব্রিকস প্লাস
২০০৯ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষাপটে উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর স্বার্থ রক্ষায় গঠিত হয় ব্রিকস—ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন নিয়ে। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে গোষ্ঠীটি পূর্ণতা পায়।
২০২৪ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ১৬তম ব্রিকস সম্মেলনে মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সদস্য হয়। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ব্রাজিল ইন্দোনেশিয়াকে যুক্ত করে এবং আরও ৯টি দেশকে পার্টনার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। এভাবে গোষ্ঠীটি ‘ব্রিকস প্লাস’-এ রূপান্তরিত হয়।
ব্রিকস প্লাসের নতুন উদ্যোগ
ব্রিকস প্লাস বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন:
- নতুন উন্নয়ন ব্যাংক (NDB)
- ব্রিকস পে ও ব্রিকস ব্রিজ (ফিনটেক প্ল্যাটফর্ম)
- এআই, স্টার্টআপ ফোরাম ও ভবিষ্যৎ নেটওয়ার্ক
- ই-কমার্স, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, এমএসএমই—নানা খাতে ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন
- বিকল্প মুদ্রা ও ‘ব্রিকস ক্লিয়ার’ নামে আন্তঃদেশীয় আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা
- সাইবার নিরাপত্তা ও দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপন
উন্নয়ন সূচকে পরিবর্তন
ব্রিকস প্লাসভুক্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ভিন্নমাত্রিক:
- রাশিয়া (২০২৩): উচ্চ আয়ের দেশ
- চীন (২০১০): উচ্চ-মধ্যম আয়
- ভারত: নিম্ন-মধ্যম আয় (মাথাপিছু প্রায় ২,৭০০ ডলার)
- ইউএই: মাথাপিছু ৪৮,০০০ ডলার
- ইন্দোনেশিয়া: মাথাপিছু প্রায় ৫,০০০ ডলার
ভারতের বাণিজ্য: অগ্রগতি ও অসামঞ্জস্য
ব্রিকস প্লাসের দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য হলেও ভারসাম্যহীন:
- মোট বাণিজ্য (২০২৩-২৪): ৩৩৫ বিলিয়ন ডলার
- রপ্তানি: ৮২ বিলিয়ন ডলার (মোট রপ্তানির ১৯%)
- আমদানি: ২৫৩ বিলিয়ন ডলার (মোট আমদানির ৩৭%)
- বাণিজ্য ঘাটতির ৭১% এই দেশগুলো থেকে, যার মধ্যে চীনের অংশ ৩৫%-এর বেশি
এই চিত্র থেকে স্পষ্ট, ভারতের আমদানি রপ্তানির চেয়ে অনেক বেশি, বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া থেকে তেল ও শিল্পপণ্য আমদানির কারণে ঘাটতি বেড়েছে।
মূল চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
১. রপ্তানি বাড়াতে সক্রিয় উদ্যোগ দরকার – ব্রিকস বাজারকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগানো হয়নি
২. রপ্তানিপণ্যের বৈচিত্র্য কম – সম্ভাবনাময় পণ্যের তালিকা তৈরি করা জরুরি
৩. ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ বাধা চিহ্নিত করে আলোচনার প্রয়োজন – ভারসাম্য ফেরাতে যৌথ কৌশল দরকার
বিনিয়োগের অবস্থা
ব্রিকস প্লাসে ভারতের বিনিয়োগ চিত্র মিশ্র:
- ইউএই: ভারতের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী (প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার), ভারতে বিনিয়োগও সর্বাধিক
- ভারত-ইউএই পারস্পরিক বিনিয়োগ: ১৬ বিলিয়ন ডলার
- রাশিয়া: প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার
- চীন: গত ৪ বছরে মাত্র ২০০ মিলিয়ন ডলার
সার্বিকভাবে, ভারতের প্রত্যাশামতো বিনিয়োগ বা বাণিজ্যিক লাভ হয়নি, যদিও এটি ব্রিকসের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি।
ব্রিকস বনাম যুক্তরাষ্ট্র: উত্তেজনা ও প্রতিক্রিয়া
প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্রিকসের বিকল্প মুদ্রা উদ্যোগকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন:
- ডি-ডলারাইজেশন রুখতে ১০০% ট্যারিফ হুমকি
- ব্রিকসকে ‘মৃত’ আখ্যা
- মার্কিন ডলার নিয়ে ‘খেলা’ করলে ‘শাস্তি’ দেবে—এমন ভাষ্য
সদস্য দেশগুলো একযোগে নয়, আলাদাভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়। ভারতের জন্য এটি একটি কৌশলগত সুযোগ—বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থার বিপরীতে ইউপিআই (UPI) ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে নিজস্ব অবস্থান জোরদার করা সম্ভব।
ভবিষ্যতের পথ: ভারতের সুযোগ
- ব্রিকস প্লাস গ্লোবাল সাউথের জন্য একটি আকর্ষণীয় প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে
- কিন্তু এখনো ট্যারিফ, নন-ট্যারিফ বাধা, মান ও কোড সংক্রান্ত আলোচনা নেই
- ভারত চাইলে এই খাতে নেতৃত্ব দিয়ে নিজস্ব বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করতে পারে
- স্থায়ী সচিবালয় গঠন দরকার, যাতে ফোরামের ধারাবাহিকতা রক্ষা হয় ও কেবল সভাপতিত্ব পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করতে না হয়
নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (NDB): সম্ভাবনার দিগন্ত
- ৯৬টি প্রকল্পে ৩২.৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদান, মূলত টেকসই উন্নয়নের জন্য
- ভবিষ্যতে শুধু সরকারি প্রকল্প নয়, বেসরকারি খাতেও বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা
ডিজিটাল অর্থনীতি ও নিরাপত্তা
- ব্লকচেইন-ভিত্তিক লেনদেন, ডিজিটাল মুদ্রা ও সাইবার নিরাপত্তা
- ব্রিকস পে, ব্রিকস ব্রিজ ও ব্রিকস ক্লিয়ার – বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় থাকা গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ
উপসংহার: নেতৃত্বের দিকে ভারত
ব্রিকস প্লাস ভারতের জন্য একটি কৌশলগত প্ল্যাটফর্ম, যা আন্তর্জাতিক নেতৃত্বে ভারতের স্থান মজবুত করতে পারে।এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে ভারতকে সক্রিয় নেতৃত্ব, নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণ এবং একটি স্থায়ী কাঠামো গঠনের দিকে অগ্রসর হতে হবে।